দেশজুড়ে

ঋণের ২০ হাজার টাকা শেষ, আইসিইউ থেকে ইবি শিক্ষার্থীকে ফেরত

মুমূর্ষু অবস্থায় গত ১৮ মার্চ রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি হয়েছিলেন সেলিম হোসেন। কিন্তু অর্থাভাবে দুদিন পরই চলে আসেন ৭ নম্বর ওয়ার্ডে। চিকিৎসকদের ধারণা, তিনি বিরল গুলেন বারি সিনড্রোমে (Guillain–Barré syndrome) আক্রান্ত।

Advertisement

১৬ দিন ধরে হাসপাতালের এ ওয়ার্ডেই চিকিৎসাধীন সেলিম হোসেন। তিনি কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত পুষ্টি ও খাদ্য প্রযুক্তি বিভাগের ১৯তম ব্যাচের মেধাবী শিক্ষার্থী।

সেলিম জেলার পুঠিয়া উপজেলার বারুইপাড়া এলাকার দিনমজুর লুৎফর রহমানের ছেলে। স্থানীয় বিদ্যালয় থেকে গোল্ডেন জিপিএ-৫ পেয়ে মাধ্যমিক পাস করেন। কৃতিত্বের সঙ্গে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে জায়গা করে নেন বিশ্ববিদ্যালয়ে।

একমাত্র ছেলের চোখেই আগামীর স্বপ্ন দেখছিলেন মা নূরনাহার। স্বামীর দিনমজুরির উপার্জনে ছেলের পড়ালেখার খরচ জোগানো কষ্টকর হচ্ছিলো। তিনি গরু-ছাগল পালন করে সেটি জোগান দেন। কিন্তু অজানা রোগে আক্রান্ত হয়ে ছেলে এখন বিছানায়। ফিকে হয়ে আসছে তার রঙিন স্বপ্ন।

Advertisement

সেলিম হোসেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু হলের ১০৪ নম্বের কক্ষের আবাসিক শিক্ষার্থী। তার বন্ধু শাওন খন্দকার জানান, মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকে পুরোদমে ক্লাস শুরু হয়েছে। কিন্তু হাসপাতালের বেডে যন্ত্রণায় ছটফট করছে সেলিম। এটি তারা মানতে পারছেন না। বিভাগের শিক্ষক-সহপাঠীরা নিয়মিত খোঁজখবর নিচ্ছেন সেলিমের। তার চিকিৎসায় সাধ্যমত সহায়তাও করছেন।

তিনি আরও বলেন, বিভাগের অত্যন্ত মেধাবী শিক্ষার্থী সেলিম। সবসময় পড়ালেখা নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। গত ২৮ জানুয়ারি দ্বিতীয় বর্ষের চূড়ান্ত পরীক্ষা শেষ হয়। তিনি পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি এসেছিলেন। মার্চে ক্লাস শুরু হলেও তিনি উপস্থিত হননি। পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি।

হাসপাতালে ছেলের সেবা রয়েছেন মা নূরনাহার বেগম। সেখানেই কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি জানান, কিছুদিন ধরেই সেলিম অসুস্থ। সামর্থ্য অনুযায়ী একমাত্র ছেলের চিকিৎসা করিয়েছেন। কিন্তু এখন ছেলে শয্যাশায়ী। চিকিৎসক জানিয়েছেন, তার চিকিৎসায় অন্তত ১০ লাখ টাকা খরচ হবে। এ খরচ জোগানোর সামর্থ্য তাদের নেই। ছেলের প্রাণ বাঁচাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সহায়তা চান অসহায় এ মা।

তিনি আরও বলেন, বড় মেয়ে সুমাইয়া আক্তারের বিয়ে হয়েছে সাত বছর আগে। অনেক কষ্টে ছেলের পড়ালেখার খরচ জোগাচ্ছিলেন তারা। কিন্তু তার এ অসুস্থতায় মাথার ওপর আকাশ ভেঙে পড়েছে।

Advertisement

প্রতিবেশীদের কাছ থেকে ২০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে ছেলের চিকিৎসায় খরচ করেছেন। এখন সেই অর্থ শেষ। 

ছেলেকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরাতে সমাজের বিত্তবান ও হৃদয়বানদের সহায়তা চেয়ে মা বলেন, ১৮ মার্চ শঙ্কটাপন্ন অবস্থায় সেলিমকে হাসপাতালের আইসিইউতে নেয়া হয়। দুদিনে তাদের খরচ হয়েছে প্রায় ১৫ হাজার টাকা।

এই দুদিনে তার কিছুটা উন্নতিও হয়েছে। চিকিৎসক আরও তিন-চারদিন রাখতে চাইছিলেন। কিন্তু অর্থ না থাকায় অনুরোধ করে আবারও ওয়ার্ডে ফিরিয়ে আনেন। ঝাঁপসা চোখে ছেলের ভবিষ্যৎও ঝাঁপসা দেখছেন তিনি।

৭ নম্বর ওয়ার্ডের ৭ নম্বর বেডে চিকিৎসাধীন সেলিম হোসেন। উঠে বসা তো দূরের কথা, নড়াচড়া করতে পারছেন না একেবারেই। তিনি জানান, শরীরের বাম পাশ পুরোপুরি অবশ। মেরুদণ্ডের জয়েন্টে জয়েন্টে ব্যথা। ফুলে গেছে পুরো শরীর। চোখেমুখে তার বাঁচার আর্তি। সুস্থ হয়ে ফিরে যেতে চান বিশ্ববিদ্যালয়ে। মানুষের মতো মানুষ হয়ে জীবন কাটাতে চান মানবতার সেবায়।

রাজশাহী হাসপাতালের নিউরো মেডিসিনের বিভাগীয় প্রধান কফিল উদ্দীনের অধীনে সেলিম উদ্দিনের চিকিৎসা চলছে । রোববার দুপুরের পর গিয়ে হাসপাতালে পাওয়া যায়নি তাকে।

তবে দায়িত্বরত চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, বেশকিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরও তার রোগ নির্ণয় করা যায়নি। সর্বশেষ রক্ত পরীক্ষার প্রতিবেদন পেতে সময় লাগবে আরও ১০ দিন। সেটি হাতে পেলেই নিশ্চিত হওয়া যাবে তার শরীরে কোন রোগ বাসা বেঁধেছে। আপাতত লক্ষণ বুঝেই চিকিৎসা চলছে তার।

চিকিৎসকদের ধারণা, তিনি গুলেন বারি সিনড্রোমে আক্রান্ত। এটি একধরনের প্যারালাইসিস। এটি প্রান্তিয় স্নায়ুতন্ত্রকে আক্রমণকারী অ্যাকিউট বা তীব্র পলিনিউরোপ্যাথি রোগ। এতে হাত-পা দ্রুত দুর্বল হয়ে পড়ে। অনুভূতিতে ভিন্নতা কিংবা ব্যথার পর হাতে এবং পায়ে দুর্বলতা দেখা যায় যা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।

রোগ খুব তীব্র হলে প্রাণঘাতী হতে পারে, তখন কৃত্রিমভাবে শ্বাসকার্য চালানোর জন্য নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়। স্বয়ংক্রিয় স্নায়ুতন্ত্রে ডিসঅটোনমিয়া হলে হৃদস্পন্দন ও রক্তচাপে গোলযোগ দেখা যায়। বিরল এই রোগ প্রতি এক লাখ লোকের মধ্যে এক-দুজন আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া যায়।

ফেরদৌস সিদ্দিকী/এমএএস/জেআইএম