খেলাধুলা

কোটি বাঙালির আক্ষেপ : মাত্র ২টি রান

মাঠের সীমানা দড়ির কাছেই দাঁড়িয়ে সাকিব আল হাসান, যেমনটা দাঁড়ান অন্য যেকোনো দিন ম্যাচ শেষে। কিন্তু সেদিনটা ছিলো ভিন্ন। তার বুকে ছিলেন মুশফিক, পাশে নাসির-বিজয়, পেছনে বন্ধু তামিম, খানিক দূরে হাটুতে মাথা রেখে বসে আছেন মাশরাফি। কারো মুখে কোনো শব্দ নেই, সুনসান নীরবতা পুরো স্টেডিয়ামে।

Advertisement

মন খারাপ করে মাটিতে বসে ছিলেন মুশফিক। সাকিবকে কাছে আসতে দেখে কোনোমতে দাঁড়ানোর শক্তি সঞ্চয় করে চলে গেলেন তার বুকে। এতক্ষণ ধরে আটকে রাখা কান্নার স্রোত আর থামাতে পারলেন না মুশফিক। সাকিবের বুকে মুখ লুকিয়ে শুরু করলেন অঝোরে কান্না।

সামলাতে পারলেন না সাকিবও। বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের মধ্যে সবচেয়ে কম আবেগ যার- সেই সাকিবও হাসিমুখের আড়ালে লুকোতে পারলেন না নিজের অশ্রুভেজা। পেছনে দাঁড়ানো তামিম হতবাক, জার্সির নিচে মুখ লুকিয়ে কাঁদছেন নাসির, তখনো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পা না রাখা এনামুল বিজয় নখ কামড়ে শেষ করে ফেলছেন, তবু বাঁধ মানছে না অশ্রুধারা।

সে দিনটি ছিলো বৃহস্পতিবার, সাত বছর আগের আজকের তারিখ। সরকারিভাবে অর্ধদিবস কর্মবিরতি থাকলেও, সেদিন পুরো দেশের জন্যই যেন আধাবেলার ছুটি। সবার চোখ ছিলো মিরপুরের শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামের দিকে। যেখানে লড়বে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল, একটি শিরোপার জন্য, এশিয়ান শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা।

Advertisement

সে শিরোপা থেকে হাত ছোঁয়া দুরত্বে দাঁড়িয়ে ফাইনাল ম্যাচে মুশফিকবাহিনীর শেষ কাঁটা ছিলো পাকিস্তান ক্রিকেট দল। তখনো পর্যন্ত ১৩ বছরেও যাদের হারানো যায়নি। সে দলকে ভূপাতিত করে শিরোপায় চুম্বন বসাতে করতে হতো মাত্র ২৩৭ রান। ঘরের মাঠে এ রান করা খুব একটা কঠিন হওয়ার নয়। কিন্তু দিনটি যে ছিলো না বাংলাদেশের।

রান তাড়া করতে ইনিংসের সূচনা করলেন দুর্দান্ত ফর্মে থাকা তামিম ইকবাল এবং ডানহাতি নাজিমউদ্দিন। আগের তিন ম্যাচেই ফিফটি করে তামিম ছিলেন আত্মবিশ্বাসের তুঙ্গে, সে তুলনায় অনেকটা খোলসবন্দীই ছিলেন নাজিমউদ্দিন।

যার ছাপ পড়ে ফাইনাল ম্যাচেও। একপ্রান্তে অবলীলায় আইজাজ চিমা, উমর গুল, সাঈদ আজমলদের বাউন্ডারি ছাড়া করছিলেন তামিম। কিন্তু অন্যপ্রান্তে ব্যাটে-বলেই সংযোগ হচ্ছিলো না নাজিমউদ্দিনের। তবু তামিমের কল্যাণে রানরেট নিয়ে চিন্তায় পড়তে হয়নি বাংলাদেশের।

Advertisement

আসরের টানা চতুর্থ ফিফটিতে তামিম খেলেন ৬৮ বলে ৬০ রানের ইনিংস। প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে গড়েন টানা চার ম্যাচে পঞ্চাশ পেরুনোর রেকর্ড। উদ্বোধনী জুটিতে আসে ১৬.৪ ওভারে ৬৮ রান। যেখানে অর্ধেকের বেশি, ৫২ বল খেলে মাত্র ১৬ রান করতে সক্ষম হন নাজিমউদ্দিন।

তার বিদায়ের রানের খাতা খোলার আগেই ফেরেন জহুরুল ইসলাম অমি। চাপে পড়ে যায় বাংলাদেশ। ১৬ ওভারে বিনা উইকেটে ৬৫ রান থেকে, ২৩ ওভারে ২ উইকেটে ৮১ রানের দলে পরিণত হয় টাইগাররা। চাপ সরাতে গিয়ে ২৪তম ওভারের প্রথম বলে তামিমও ফেরেন সাজঘরে। বিপদ বাড়ে বাংলাদেশের।

তখনই চতুর্থ উইকেটে তরুণ নাসির হোসেনকে সঙ্গে নিয়ে দলের হাল ধরেন বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান। দুজনের জুটিতে জয়ের স্বপ্ন রঙিন হতে থাকে বাংলাদেশের। কিন্তু উদ্বোধনী জুটির মতোই নাসির হোসেন উইকেটে টিকে থাকলেও, বল খরচ করছিলেন অনেক বেশি। তবু সাকিবের কল্যাণে রানরেটের বোঝা বাড়েনি খুব বেশি।

সাকিব-নাসির দুজন মিলে চতুর্থ উইকেটে গড়েন ৮৯ রানের জুটি। ৪৩তম ওভারের তৃতীয় বলে নাসির ফিরে যাওয়ার সময় বাংলাদেশের প্রয়োজন ৪৫ বলে ৬৭ রান, ওভারপ্রতি প্রায় ৯ রান করে। মাত্র ২৮ রান করতে ৬৩ বল খরচ করা নাসির মাঠ ছাড়ার পথে বিদগ্ধ হচ্ছিলেন অনুশোচনায়।

তবু তখনো টাইগারদের আশার আলো হয়ে জ্বলছিলেন সাকিব আল হাসান, সঙ্গে যোগ দেন মুশফিকুর রহীম। ভারতের বিপক্ষে এর চেয়েও কঠিন পরিস্থিতে থেকে মাত্র ২৫ বলে ৪৬ রানের টর্ণেডো ইনিংস খেলে ম্যাচ বের করেছিলেন মুশফিক। সেদিন ৩১ বলে ৪৯ রানের ইনিংস খেলে ভীতটা গড়ে দিয়েছিলেন সাকিবই।

কোটি বাঙালির আশা ফাইনাল ম্যাচে শেষবারের মতো জয়ের বন্দরটা চেনাবেন এ দুই পরীক্ষিত যোদ্ধাই। কিন্তু চাপ নিতে পারলেন না সাকিব। নাসিরের ফিরে যাওয়ার পরে ওভারেই ফাইন লেগ দিয়ে স্কুপ করতে গিয়ে বোল্ড হয়ে গেলেন তিনি। মাত্র ৭২ বলে ৬৮ রানের ইনিংস খেললেও, অমন অবস্থায় দলকে ফেলে আসায় চোখে-মুখে অবিশ্বাসের ছাপ।

সাকিবের বিদায়ে লক্ষ্যমাত্রা দাঁড়া ৩৮ বলে ৫৮ রান। অধিনায়ক মুশফিকের সামনে তখন প্রতি ওভারে বাউন্ডারি হাঁকানো ছাড়া কোনো পথ খোলা নেই। সে চেষ্টাই তিনি করলেন আইজাজ চিমার ৪৫তম ওভারের প্রথম বলে, যেমনটা করেছিলেন ভারতের বিপক্ষে ইরফান পাঠানের বোলিংয়ের বিপক্ষে।

প্রায় একই ধরনের ফ্লিক শট খেললেন মুশফিক। কিন্তু সেদিনটি ছিলো বাংলাদেশের, ফলে ভারতের বিপক্ষে যেটি আছড়ে পড়ে সীমানার ওপারে, সেই একই শট সেদিন জমা পড়ে ডিপ স্কয়ার লেগে থাকা নাসির জামশেদের হাতে। দলকে রেখে মুশফিক যখন ড্রেসিংরুমের পথে, তখনো জয়ের জন্য বাকি ২৯ বলে ৪৭ রান।

স্বীকৃত ব্যাটসম্যান বলতে ছিলেন শুধু মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। তার সঙ্গী হন মাশরাফি বিন মর্তুজা, বড় শট খেলতে যার পরিচিতি রয়েছে বেশ। কোটি মানুষের প্রার্থনায় তখন মাশরাফির ব্যাট থেকে বড় ছক্কার আশা। হতাশ করেননি মাশরাফি।

শেষের ২৪ বলে জয়ের জন্য যখন প্রয়োজন ৩৯ রান, তখন উমর গুলের ওভারে জোড়া বাউন্ডারি হাঁকিয়ে চাহিদাটা ১৮ বলে ২৫ রানে নামিয়ে আনেন তিনি। মাশরাফির ব্যাট থেকে বড় শট আসায় আশার আলো জ্বলতে শুরু করে টাইগার ভক্ত-সমর্থকদের মনে।

কিন্তু! গণ্ডগোল বাঁধে সাঈদ আজমলের করা ৪৮তম ওভারে। সে ওভারের প্রথম তিন বলেই ৬ রান করে বাংলাদেশ। চতুর্থ বলে স্কুপ শটে বাউন্ডারি হাঁকাতে গিয়ে শর্ট ফাইন লেগে ধরা পড়েন ৯ বলে ১৮ রান করা মাশরাফি। শেষের দুই বল ডট খেলেন ৯ নম্বরে নামা আব্দুর রাজ্জাক। ফলে ১২ বলে বাকি থাকে আরও ১৯ রান।

একমাত্র ব্যাটসম্যান হিসেবে উইকেটে টিকে ছিলেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। উমর গুলের করা ৪৯তম ওভারে কোনো বাউন্ডারি হাঁকাতে পারেননি তিনি। কিন্তু আব্দুর রাজ্জাকের সঙ্গে দৌড়েই ১০ রান তোলেন, শেষের ৬ বলে শিরোপা থেকে মাত্র ৯ রান দূরে থেকে যায় বাংলাদেশ।

আশার কথা ছিলো শেষ ওভারের প্রথম বলটি খেলবেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। কিন্তু আইজাজ চিমার করা সে ওভারের প্রথম বলে ১ রান নেয়ায় স্ট্রাইক চলে যায় রাজ্জাকের কাছে। দ্বিতীয় বলে পড়িমড়ি করে মাহমুদউল্লাহকে স্ট্রাইক ফিরিয়ে দেন রাজ্জাক। তৃতীয় বল ডট খেলে চাপ বাড়িয়ে ফেলেন মাহমুদউল্লাহ।

চতুর্থ বলে পাকিস্তানি ফিল্ডারদের ভয়াবহ ভুলের সুযোগ নিয়ে ওভারথ্রো থেকে ২ রানসহ মোট ৩ রান পায় বাংলাদেশ। কিন্তু স্ট্রাইক চলে যায় রাজ্জাকের কাছে, যা কাল হয়ে দাঁড়ায় শেষপর্যন্ত। জয়ের জন্য ২ বলে করতে হতো ৪ রান।

ওভারের পঞ্চম বলে মাহমুদউল্লাহকে স্ট্রাইকে আনার পরিবর্তে বড় শট খেলার কথাই ভাবলেন রাজ্জাক। কিন্তু ব্যাটে-বলে করতে পারেননি তিনি, সরাসরি বোল্ড হয়ে ফেরত যান সাজঘরে, সঙ্গে নিয়ে যান বাংলাদেশের শিরোপা স্বপ্নটাও।

ফাইনাল ম্যাচের শেষ বলটি খেলতে আসেন শাহাদাত হোসেন রাজীব, যিনি করেছিলেন পাকিস্তানের ইনিংসের শেষ ওভারটি। দুইটি নোবলসহ মোট ১৯ রান খরচ করে পাকিস্তানকে ২৩৬ রানের পুঁজি গড়তে 'সাহায্য'ই করে রাজীব।

তবু সে রাগ ভুলে কোটি বাঙালির প্রার্থনায় তখন রাজীবের নাম। তার ব্যাট থেকে চাই মাত্র ১টি চার। লেগস্টাম্পের বাইরে বল করলেন চিমা, জায়গা ছেড়ে খেলতে গেলেন রাজীব। পারেননি ব্যাটে-বলে করতে। প্যাডে লেগে কোনোমতে নেন ১টি রান।

 

ননস্ট্রাইকে থাকা মাহমুদউল্লাহ ১ রান সম্পন্ন করে বসে পড়েন পিচের ওপরেই। ১৬ বলে ১৭ রান করে জয়ের আশা বাঁচিয়ে রাখলেও, পারেননি তুলির শেষ আঁচড় দিতে। যে কারণে তৎক্ষণাৎ আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন তিনি।

ড্রেসিংরুমে সতীর্থরা অপেক্ষায় ছিলেন ম্যাচ জিতে দৌড়ে মাঠে প্রবেশ করতে। কিন্তু মাত্র ২ রানের আক্ষেপে ড্রেসিংরুম থেকে পিচ পর্যন্ত ৭০-৮০ মিটার দূরত্বটাও তখন যেনো কয়েক হাজার মাইল দূরে কোনো দ্বীপ।

উল্লাস করতে করতে কেউ ঢোকেননি মাঠের মধ্যে, গ্যালারীতে থাকা ২৫-২৬ হাজার দর্শকের কারো মুখে নেই কোনো শব্দ। পিনপতন নীরবতা পুরো মাঠে। এখানে ওখানে অনেকেই হাঁটুতে মাথা গুজে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদছে। অচেনা কাউকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদছে কেউ কেউ। সবার চোখের ভাষা এক, সবার বুকের কষ্ট এক, সবার ভালবাসাও এক! বাংলাদেশ!

আর মাঠের মধ্যে? মাঠের মধ্যে সীমানা দড়ির কাছেই দাঁড়িয়ে সাকিব আল হাসান, যেমনটা দাঁড়ান অন্য যেকোনো দিন ম্যাচ শেষে। কিন্তু সেদিনটা ছিলো ভিন্ন। তার বুকে ছিলেন মুশফিক, পাশে নাসির-বিজয়, পেছনে বন্ধু তামিম, খানিক দূরে হাটুতে মাথা রেখে বসে আছেন মাশরাফি। কারো মুখে কোনো শব্দ নেই, সুনসান নীরবতা পুরো স্টেডিয়ামে।

মন খারাপ করে মাটিতে বসে ছিলেন মুশফিক। সাকিবকে কাছে আসতে দেখে কোনোমতে দাঁড়ানোর শক্তি সঞ্চয় করে চলে গেলেন তার বুকে। এতক্ষণ ধরে আটকে রাখা কান্নার স্রোত আর থামাতে পারলেন না মুশফিক। সাকিবের বুকে মুখ লুকিয়ে শুরু করলেন অঝোরে কান্না।

সামলাতে পারলেন না সাকিবও। বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের মধ্যে সবচেয়ে কম আবেগ যার- সেই সাকিবও হাসিমুখের আড়ালে লুকোতে পারলেন না নিজের অশ্রুভেজা। পেছনে দাঁড়ানো তামিম হতবাক, জার্সির নিচে মুখ লুকিয়ে কাঁদছেন নাসির, তখনো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পা না রাখা এনামুল বিজয় নখ কামড়ে শেষ করে ফেলছেন, তবু বাঁধ মানছে না অশ্রুধারা।

আজ থেকে ঠিক সাত বছর আগের ২২ মার্চ তারিখটি ছিলো কোটি বাঙালির একটি আক্ষেপের দিন, যার নাম 'মাত্র ২টি রান'। তবে সেদিনের পর ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেট, যেমনটা ম্যাচ শেষে পুরষ্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে বলেছিলেন তৎকালীন অধিনায়ক মুশফিকুর রহীম।

২২ মার্চ ২০১২ তারিখ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ৩৫৩টি ম্যাচ খেলে ৭৯টি ম্যাচে জয় পেয়েছিল বাংলাদেশ দল। সেদিন এশিয়া কাপের ফাইনালে ২ রানের হারার পর থেকে ২০৪ ম্যাচ খেলেই ৭৮টি জয় তুলে নিয়েছে টাইগাররা।

এসএএস/এমএস