একটা সময় আমাদের সমাজে ধারণা ছিল, নারীরা শুধু ঘরের কাজই করবে। রান্না করা, ঘর গোছানো, ছেলে-মেয়ে লালন-পালনের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল তাদের জগৎ। সংসারের বাইরে উৎপাদনশীল অর্থনীতির মূলধরায় নারীরা সরাসরি সম্পৃক্ত হবেন- এটা অনেকে কল্পনাও করতে পারতেন না।
Advertisement
‘নারীরা বাইরের কাজ পারবে না, তাদের ঘরের কাজই সামলাতে হবে’- এমন ভ্রান্ত ধারণা যারা মনের মধ্যে পুষে রেখেছিলেন গত দুই দশকে তাদের সেই ধারণা ভুল প্রমাণ করেছেন হাজার হাজার সাহসী নারী। সংখ্যাটি হাজার না বলে লক্ষাধিক বলাই ভালো।
সবক্ষেত্রে নারীরা যে এগিয়ে- সেটা এখন খুবই দৃশ্যমান। সর্বোচ্চ আদালত, সশস্ত্র বাহিনী, ছত্রীসেনা (প্যারাট্রুপার), ট্রেনচালক, ওসি, ডিসি, ইউএনও, সংসদ সদস্য- সবক্ষেত্রে নারীদের এখন জয়জয়কার। প্রায় ২৮ বছর ধরে যে দেশের সরকারপ্রধানের দায়িত্বে নারী, সেই দেশের নারীরা কী করে অর্থনীতির প্রাণশক্তি ব্যবসায় পিছিয়ে থাকবেন?
তাই তো সংসারের পাশাপাশি নারীদের একটি বড় অংশ নিজ হাতে সামলাচ্ছেন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের হাল। হাজার হাজার সফল নারী উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। চাকরির জন্য অপেক্ষা না করে ছোট মূলধন নিয়েই শুরু করেছেন ব্যবসা। যোগ্যতা আর মেধা দিয়ে সেই ছোট মূলধন আজ রূপ নিয়েছে বড় পুঁজিতে। নিজেদের পাশাপাশি অসংখ্য বেকারের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন তারা।
Advertisement
আরও পড়ুন >> তিন হাজারে শুরু, এখন মজুতই ৩৫ লাখ টাকার পণ্য
এমনই একজন সফল নারী উদ্যোক্তা যশোরের সুলতানা জামান। যিনি মাত্র ৬০০ টাকা নিয়ে দুই দশক আগে নেমে পড়েন ব্যবসায়। এক বান্ধবীকে সঙ্গে নিয়ে শুরু করেন বুটিকসের কাজ। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি স্বপ্নবাজ এ নারী উদ্যোক্তাকে। আস্তে আস্তে বড় করেছেন নিজের প্রতিষ্ঠান। যশোর শহরে গড়ে তুলেছেন ‘চারুলিপি বুটিকস’। কর্মসংস্থানের সুযোগ করেছেন ১৫০ জনের।
আত্মপ্রত্যয়ী সফল এ উদ্যোক্তার সঙ্গে জাগো নিউজের কথা হয় রাজধানীর আগারগাঁওয়ের বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে। যেখানে এসএমই ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হচ্ছে সপ্তাহব্যাপী সপ্তম জাতীয় এসএমই মেলা। এ মেলায় একটি স্টল নিয়ে নিজের প্রতিষ্ঠানের বাহারি নকশীকাঁথা, বেডশিট, শাড়ি, থ্রি-পিস, টু-পিস, ওয়ান পিসের পসরা সাজিয়েছেন তিনি।
ব্যবসায় সম্পৃক্ত হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে সুলতানা জামান বলেন, নিজের পায়ে দাঁড়াব, কারও বোঝা হব না- ছোটবেলা থেকেই মনের মধ্যে এমন স্বপ্ন লালন-পালন করেছি। আমার সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপও দিয়েছি। ছোট প্রতিষ্ঠানকে তিলে তিলে বড় করেছি। বহু মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছি।
Advertisement
তিনি বলেন, ১৯৯৮ সালে প্রথম ব্যবসা শুরু করি। মাত্র ৬০০ টাকা পুঁজি নিয়ে আমার এক বান্ধবীর সঙ্গে ব্যবসায় নেমে পড়ি। ২০০০ সালে ব্যবসার জন্য ট্রেড লাইসেন্স সংগ্রহ করি। ছোট পরিসরে ব্যবসা করতে করতে যুব উন্নয়ন প্রশিক্ষণের সন্ধান পাই। ২০০৮ সালে যুব উন্নয়ন থেকে প্রশিক্ষণ নেই।
‘ব্যবসা শুরুর পর বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছি। কিন্তু কখনও স্বপ্নযাত্রা থেকে পিছপা হইনি। তিলে তিলে নিজের ছোট প্রতিষ্ঠানকে বড় করেছি। আজ আমার সঙ্গে নিয়মিত ১৫০ জন কাজ করেন। যশোরে আমার নিজস্ব শোরুম আছে। ঢাকায়ও শোরুম দিয়েছি’- বলেন সফল এ নারী উদ্যোক্তা।
‘৬০০ টাকা দিয়ে শুরু করা আপনার প্রতিষ্ঠানের মূলধন এখন কত’- এমন প্রশ্ন করা হলে সুলতানা জামান বলেন, ‘বর্তমান মূলধনের বিষয়টি আমি বলতে চাচ্ছি না। তবে এটুকু জেনে রাখেন, ৬০০ টাকা দিয়ে শুরু করা ব্যবসা আজকের এ অবস্থানে নিয়ে আসতে আমি কোনো দিন কোনো ঋণ করিনি।’
সপ্তম জাতীয় এসএমই মেলায় নিয়ে আসা নিজের প্রতিষ্ঠানের পণ্যের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমি মেলায় বিশেষ ধরনের বেডশিট নিয়ে এসেছি। ক্রেতারা ২২০০ টাকা দিয়ে এ বেডশিট কিনতে পারবেন। আমার স্টলে নকশীকাঁথা আছে চার ধরনের। এগুলোর দাম ৪ হাজার থেকে ৭ হাজার টাকার মধ্যে। শাড়ি আছে ২ হাজার থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকার মধ্যে। থ্রি-পিস ও টু-পিস আছে ১ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকা মধ্যে। এছাড়া ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকা দামের ওয়ান পিস আছে।’
তিনি বলেন, ব্যবসায় সফল হওয়ার মূলমন্ত্র হলো সততা ও পণ্যের গুণগত মান বজায় রাখা। আমি সবসময় এ দুটিকে গুরুত্ব দিয়েছি। সততাই আমার মূল পুঁজি। পণ্যের মানের ক্ষেত্রে আমি কখনও আপস করিনি। সময়ের সঙ্গে তালমিলিয়ে সবসময় পণ্যের মধ্যে বৈচিত্র্য আনার চেষ্টা করেছি।
নতুন নারী উদ্যোক্তাদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ব্যবসায় সফল হতে হলে সবসময় নিজের মধ্যে আত্মবিশ্বাস রাখতে হবে। আমাদের সমাজে পুরুষদের তুলনায় নারীদের চলার পথ স্বভাবতই কঠিন। এরপরও যত বাধাই আসুক মানসিকভাবে দুর্বল হওয়া যাবে না। ব্যবসার পাশাপাশি নিজের দক্ষতার ওপরও গুরুত্ব দিতে হবে। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পণ্যের মধ্যে ভেরিয়েশন আনতে হবে। পণ্যের মানের দিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। এসব কাজ করতে হবে সততার সঙ্গে।
এমএএস/এমএআর/জেআইএম