দেশজুড়ে

প্রশিক্ষণ ছাড়াই কাজ করছেন পরিবার কল্যাণ সহকারীরা

ফেনীতে টেকনিক্যাল প্রশিক্ষণ ছাড়াই কাজ করছেন পরিবার কল্যাণ সহকারীরা (এফডব্লিউএ)। নিয়োগের সময় দুই মাসব্যাপী মৌলিক প্রশিক্ষণ নিয়েই জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের নিজ নিজ ইউনিটে শত শত গর্ভবতী নারী ও নবজাতক শিশুদের সেবা ও পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন তারা।

Advertisement

একাধিক স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ পরিদর্শক ও সহকারীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নানাবিধ সমস্যা নিয়ে চলছে সরকারের এ সেবা খাতটি। নিয়োগ বিধি, জনবল সংকট, প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের অভাব ও অতিরিক্ত কাজের চাপে সেবা কার্যক্রমের স্বাভাবিকতা নষ্ট হচ্ছে।

তারা জানান, একজন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ সহকারীকে সাপ্তাহে দুইদিন ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে বসতে হয়। বাকি তিনদিন তাকে নিজ ইউনিটে সময় দিতে হয়। প্রত্যেক ইউনিটে ৬০০ দম্পতি থাকার কথা থাকলেও কোনো কোনো ইউনিটে দুই হাজারের অধিক দম্পতি রয়েছে। কিন্তু একজন পরিবার কল্যাণ সহকারীকে পরিবার-পরিকল্পনা পদ্ধতি ছাড়াও গর্ভবতী নারী, শিশু-কিশোরীদের টিকা ও সাধারণ মানুষকে নানা ধরণের সেবা দিতে হয়। এছাড়াও সচেতনতামূলক বিভিন্ন ধরনের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে হয়। নিয়োগের সময় শুধুমাত্র মৌলিক প্রশিক্ষণ নিয়ে কাজ তারা শুরু করেন। কিন্তু মাঠপর্যায়ে প্রসূতি ও শিশুদের সেবা দিতে দিয়ে নানা ধরনের টেকনিক্যাল সেবা দিতে হয়। কোনো পরিবার কল্যাণ সহকারীর টেকনিক্যাল প্রশিক্ষণ নেই।

ফেনী সদর উপজেলার পাঁছগাছিয়া ইউনিয়নে দীর্ঘ প্রায় ১০ বছর ধরে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ সহকারীর কাজ করছেন বৈশাখী রানী দাস। তিনি বলেন, মাঠে কাজ করতে গিয়ে অনেক সময় আমাদের হিমশিম খেতে হয়। এখনকার মানুষ অনেক বেশি শিক্ষিত তাদের বুঝাতে অনেক কষ্ট হয়। মোটিভেশনাল ও টেকনিক্যাল প্রশিক্ষণ দিলে এমন সমস্যা কিছুটা হলেও কমবে।

Advertisement

তিনি আরও বলেন, মানুষের সেবার উদ্দেশ্যে কাজটি আন্তরিকতার সঙ্গে করি। প্রতিদিন ৫০ থেকে ৬০টি পরিবারে ছুটে যাই কোনো না কোনো সেবা দিতে। মানুষের কাছ থেকে অনেক ভালোবাসা পাই কিন্তু আমাদের প্রতি উদাসীন সরকার। আমাদের কোনো পদোন্নতি নাই। অথচ সরকারের দুটো মন্ত্রণালয়ের কাজ আমাদের করতে হয়।

কথা হয় ফেনী পৌরসভার স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ সহকারী রাহেলা আক্তার ও ছনুয়া ইউনিয়নের কুলসুম বিবির সঙ্গে। তাদেরও একই দাবি। প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও জনবল সংকটে সেবা প্রদানে তাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। এ সব সমস্য সমাধান হলে মানুষ কার্যকরীভাবে এ সেবা নিতে পারবে।

ফেনী সদর উপজেলার মোটবী ইউনিয়নে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ পরিদর্শক দিদারুল আলম জাগো নিউজকে বলেন, মাঠপর্যায়ে আমরা মা ও শিশু এবং কিশোরীদের সেবা দিয়ে থাকি। মাঠপর্যায়ে যে সব সেবা দেয়া হয় বেশিরভাগই টেকনিক্যাল সেবা। কিন্তু মাঠকর্মীদের টেকনিক্যাল প্রশিক্ষণ নেই। তাই মাঠকর্মীরা পরামর্শ সেবাতেই অনেকটা সীমাবদ্ধ।

তিনি আরও বলেন, প্রত্যেকটা ইউনিয়নে একজন করে পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকা (এফডব্লিউভি) থাকেন যিনি সন্তান প্রসবে সহযোগিতা করেন। কিন্তু একজন পরিদর্শিকার পক্ষে গোটা ইউনিয়নে কাজটি করা সম্ভব নয় বলে সাধারণ মানুষ দাইদের মাধ্যমে কাজটি করে নানা সমস্যায় পড়েন। সিএসবি প্রশিক্ষণটি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ সহকারীদের দেয়া হলে নিরাপদ সন্তান প্রসব নিশ্চিত হবে।

Advertisement

জেলা পরিবার পরিকল্প বিভাগ জানায়, জেলায় ৪২টি পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র রয়েছে। এসব কেন্দ্রে দুটি পদ্ধতিতে সেবা প্রদান করা হয়। ক্লিনিক্যাল ও মাঠপর্যায়ে ভাগ হয়ে গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের কর্মীরা তাদের সেবা কার্যক্রম ছড়িয়ে দেন। এখান থেকে মানুষ পরিবার পরিকল্পনা সেবা, জরুরি প্রসূতি সেবা, প্রসব পরবর্তী পরিবার পরিকল্পনা, গর্ভবতী সেবা, নবজাতক ও শিশু সেবা, কৈশোরকালীন প্রজনন স্বাস্থ্য ও পুষ্টি সেবা পেয়ে থাকেন।

জেলার ৬টি উপজেলায় একজন করে পরিবার-পরিকল্পনা কর্মকর্তা, সহকারী পরিবার-পরিকল্পনা অফিসার, মেডিকেল অফিসার ও সহকারী পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তা রয়েছেন। এছাড়াও জেলায় ২৪ জন উপসহকারী মেডিকেল অফিসার, তিনজন ফার্মাসিস্ট, ৫৫ জন পরিদর্শিকা, ৪০ জন পরিদর্শক ও ১৮০ জন পরিবার কল্যাণ সহকারী জেলার ছয়টি উপজেলার সবকটি ইউনিয়নের প্রতিটি গ্রামে এ সেবা দিয়ে থাকেন। পরিবার-পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহণে উদ্বুদ্ধ ও সন্তান উৎপাদনে সক্ষম দম্পতিদের এ সেবা প্রদান করে থাকেন এ বিভাগের কর্মীরা।

সূত্র জানায়, জেলায় ২ লাখ ৭৮ হাজার ৫৬০ জন সক্ষম দম্পতি রয়েছে। এদের মধ্যে ৮৮ হাজার ১৬৫ জন খাবার বড়ি, ২০ হাজার ৫২৪ জন কনডম, ৪২ হাজার ২১ জন ৩ মাস মেয়াদি ইনজেকশন, ১০ হাজার ৩৫৮ জন ১০ বছর মেয়াদি ইউবি, ১১ হাজার ৭১৩ জন ৩ বছর মেয়াদি ইমপ্ল্যান্ট ও ১ হাজার ৭৮৩ জন পুরুষ ও ২৪ হাজার ৫৩৮ জন নারী স্থায়ী পদ্ধতি গ্রহণ করেছেন।

জেলার ৭২.২০ শতাংশ সক্ষম দম্পতি কোনো না কোনো পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহণ করেন। এদের মধ্যে ফেনী সদরে ৭৩.৯১ শতাংশ, সোনাগাজীতে ৭৪.৭৯ শতাংশ, দাগনভূঞায় ৭১.০২ শতাংশ, ছাগলনাইয়ায় ৬২.৫৮ শতাংশ, ফুলগাজীতে ৭৩.৪৯ শতাংশ ও পরশুরামে ৭৫.০৬ শতাংশ সক্ষম দম্পতি পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহণ করে থাকেন।

প্রসূতি সেবা এ বিভাগের অন্যতম আরেকটি প্রধান সেবা। গর্ভধারণের পর থেকে পরিবার কল্যাণ সহকারীরা তালিকা সংগ্রহ করে কমপক্ষে চার বার স্বাস্থ্য পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে গিয়ে পরামর্শ নিতে উদ্বুদ্ধ করেন। এছাড়া প্রসূতিকে নানাভাবে সচেতন করার চেষ্টা করেন। শুধু মাত্র জানুয়ারি মাসে স্বাস্থ্য পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের কর্মীদের তত্ত্বাবধানে ৪১৯টি স্বাভাবিক প্রসব ও ২৮৩টি সিজার অপারেশন করা হয়েছে।

ফেনীস্থ পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের উপ-পরিচালক মো. আমিনুল ইসলাম জাগো নিউজকে জানান, এ বিভাগের কার্যক্রমকে আরও বেশি সহজতর করতে প্রত্যেকটি ঘরে পরিবার কল্যাণ সহকারী, পরিদর্শক, মেডিকেল অফিসার ও পরিদর্শিকার নম্বর সম্বলিত স্টিকার লাগানো হচ্ছে। যাতে করে একজন সেবা গ্রহীতা যে কোনো সময় তার প্রয়োজনে আমাদের কর্মীদের কাছে পায়।

তিনি আরও বলেন, প্রত্যেক কর্মীকে মোবাইল ট্র্যাকিংয়ের আওতায় আনা হচ্ছে। মনিটরিং আরও বেশি জোরদার করা হচ্ছে, যাতে করে মানুষ সেবা বঞ্চিত না হয়।

মাঠকর্মীদের প্রশিক্ষণের বিষয়ে আমিনুল ইসলাম বলেন, পর্যাপ্ত পরিমাণ প্রশিক্ষণ রয়েছে। পর্যায়ক্রমে তাদের এসব প্রশিক্ষণ দেয়া হবে।

রাশেদুল হাসান/আরএআর/পিআর