সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার রঙ্গাচর ইউনিয়ন। হাওর, সীমান্ত, পাহাড়ি অঞ্চলের জন্য বিখ্যাত এ এলাকায় জনবসতি ৩৭ হাজার ১৮৬ জন। পরিবার পরিকল্পনার হিসাব অনুযায়ী এ ইউনিয়নে রয়েছেন সাত হাজার দম্পতি। কাগজে কলমে এখানে তিনটি ইউনিয়ন হলেও পরিবার পরিকল্পনার হিসাবে তিনটি ইউনিয়নকে একত্রিত করে একটি করা হয়েছে।
Advertisement
তাই বৃহত্তর রঙ্গাচর ইউনিয়নের পরিবার পরিকল্পনা স্বাস্থ্য খাতে রয়েছে বিড়ম্বনা। আর এই সাত হাজার দম্পতির জন্য রয়েছেন মাত্র একজন পরিবার কল্যাণ সহকারী। এছাড়া যেখানে পরিবার পরিকল্পনা পরিদর্শক তিন জন থাকার কথা, সেখানেও রয়েছে মাত্র একজন। একজন পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকা থাকার কথা থাকলেও তিনিও কিছুদিন আগে বদলি হয়ে চলে গেছেন অন্যত্র।
সরেজমিনে রঙ্গাচর ইউনিয়নের বৃন্দাবন নগর, চিনাউড়া, বনগাঁও এলাকা ঘুরে দেখা যায়, এলাকার সবাই পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ে খুব সচেতন। এর সম্পূর্ণ অবদান তারা দিয়েছেন পরিবার কল্যাণ সহকারীকে। জন্মনিরোধ বড়ি, কনডম ইনজেকশন সবকিছুই ঠিকমতো পেলেও গর্ভাবস্তায় ও পরে প্রয়োজনীয় ওষুধ পাচ্ছে না অনেকে।
এছাড়া লোকবল সংকট থাকার কারণে কয়েকটি গ্রামের চার হাজার দম্পতি নিতে পারেন না পরিবার পরিকল্পনার সেবা। কাগজে কলমে তাদেরও নাম থাকলেও এ চার হাজার দম্পতি রয়েছেন সেবা পাওয়ার দিক থেকে অনেক পেছনে। মাঝে মধ্যে পরিবার পরিকল্পনা পরিদর্শক যদি যান তাহলে পাওয়া যায় ঔষুধ।
Advertisement
অন্যদিকে মরার ওপর খারার ঘাঁ হয়ে দাঁড়িয়েছে বনগাঁও কমিউনিটি ক্লিনিক বন্ধ। কারণ হিসেবে কর্তৃপক্ষ বলছে হেলথ প্রোভাইডার যিনি ছিলেন তিনি চাকরি ছেড়ে চলে গেছেন। যার ফলস্বরুপ এ গ্রামে কোনো রকম ওষুধ সেবা নেই। যা ওষুধ প্রয়োজন তা নিয়ে আসতে হয় বাজার থেকে। তাছাড়া কারও গর্ভাবস্থায় ব্যথা উঠলে থাকে সুরমা নদী পার করে সদর হাসপাতালে নিতে নিতে মা ও শিশু দুইজনই মারা যায়। গেল বছর একই কারণে এ এলাকার তিনজন প্রসূতি নারী মৃত্যু হয়েছে।
বৃন্দাবন গ্রামের সাব্বির আহমেদ। তিনি বলেন, আমার স্ত্রীর ব্যথা উঠলে আশেপাশে ভালো কোনো চিকিৎসা ব্যবস্থা ছিল না। যাও একটা ছিল কমিউনিটি ক্লিনিক, সেটাও বন্ধ। তাই বাধ্য হয়েই সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া অবস্থায় স্ত্রী ও সন্তান দুজনকেই হারিয়েছি। অন্যদিকে, ৭ হাজার দম্পতির শরীর স্বাস্থ্য জন্মনিরোধ জিনিসপত্র ও প্রয়োজনীয় খোঁজখবর রাখেন পরিকল্পনা পরিদর্শক সাইদুল ইসলাম ও পরিবার কল্যাণ সহকারী রোকেয়া বেগম। প্রত্যেকের বাড়ি বাড়ি গিয়ে খবর নেন তারা সবার। কিন্তু প্রয়োজনীয় লোকবল না থাকায় সব জায়গায় যেতে পারেন না তারা। প্রতিদিন একটি করে গ্রামের একজনের বাসা নির্দিষ্ট করে বসেন তারা। সেখানেই মা, শিশু ও পুষ্টি বিষয়ে ধারণা দেন। কিন্তু এখানে প্রয়োজনী সবকিছু দেয়া হলেও গর্ভাবস্থায় ও পরবর্তী সময়ে প্রয়োজনীয় ওষুধ দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের।
বৃন্দাবন এলাকার বাসিন্দা রেশমা বেগম বলেন, আমাদের পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ে আপা সবকিছু বুঝিয়েছেন। কিন্তু আমরা প্রয়োজনীয় ওষুধ পাই না। আয়রন ট্যাবলেট, ভিটামিনসহ কোনো রকমের ওষুধ পাই না। সেটা আমাদের বাইরে থেকে কিনে আনতে হয়। তার মতোই রীনা বেগম বলেন, এখানে একটা মাতৃমঙ্গল নাই। বাচ্চা হইলে যে লইয়া যাইতাম তার কোনো ঠিকানা নাই। একজন ধাত্রী আছে তাকে সব সময় সময় পাওয়া যায় না। এ ব্যাপারে পরিবার কল্যাণ সহকারী রোকেয়া বেগম বলেন, আমি একাই তিনটি ইউনিয়নের কাজ করি। আমাকে ৭ হাজার দম্পতির কাজ করতে হয়। আমি তাদের জন্মনিরোধ বড়ি, কনডম, ইনজেকশন দিলেও প্রয়োজনীয়ও ওষুধ দিতে পারি না। কারণ আমাকে সামান্য ওষুধ দেয়া হয়। এখানকার এক হাজার পরিবারের মধ্যেই তা শেষ হয়ে যায়।
তিনি আরও বলেন, আমি একা কাজ করি। আমার সঙ্গে পরিদর্শক রয়েছেন। কিন্তু আমাদের এখানে একজন পরিদর্শিকা নেই। যিনি ছিলেন তিনি বদলি হয়ে চলে গেছেন। একজন অতিরিক্ত দেয়া হলেও তিনি হঠাৎ আসেন। তাই এখানে প্রয়োজনীয় ওষুধ সেবা থেকে বঞ্চিত সেবাগ্রহীতারা। তাছাড়া আমার একার পক্ষে ৭ হাজার মানুষ খুব বেশি হয়ে যায়। যা দেখা আমার জন্য খুব কষ্টকর। এছাড়াও এ এলাকায় অনেক খাড়া পাহাড় রয়েছে যা বেয়ে উঠে কাজ করা খুব কষ্টকর।
Advertisement
পরিবার পরিকল্পনা পরিদর্শক সাইদুল ইসলাম বলেন, আমরা বিশাল সমস্যায় রয়েছি। কাগজে কলমে সরকারি হিসেবে রঙ্গাচরের সঙ্গে আরও ২টি ইউনিয়ন হলেও পরিবার পরিকল্পনা খাতা তিনটি ইউনিয়নকে একটি করে বৃহত্তর রঙ্গাচর বলা হয়েছে। তাই আমাদের এসব জায়গায় গিয়ে পরিবার কল্যাণ সহকারীকে সাহায্য করতে হয়। আমাদের পক্ষে একা একাজ করা সম্ভব না। তাই আমরা সরকারের কাছে আবেদন করি এখানে লোকবল বৃদ্ধি করতে।
তিনি আরও বলেন, এখানে অনেক দম্পতি আছে সঠিক সেবা পাচ্ছেন না। কারণ আমাদের লোকবল নেই। সপ্তাহে একদিন করে এ বৃহত্তর ইউনিয়ন দেখলেও শেষ করা যাবে না। তাছাড়া আমি মাঝে মধ্যে ওইসব এলাকায় গেলে জন্মনিরোধ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দিয়ে আসি। কিন্তু কোনো রকম ওষুধ দিতে পারি না। আর এটা দেয়ার দায়িত্ব আমার না। কারণ এখানে একজন পরিদর্শিকা থাকবেন তিনি ওষুধ দিবেন। কিন্তু বর্তমানে এ পোস্ট শূন্য। আমাদের কষ্টের শেষ নেই, বেতন-ভাতাও কম। আমাদের একটি দাবি, যেন হাওর ভাতা দেয়া হয়।
রঙ্গাচর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল হাই বলেন, আমি অনেকবার উপজেলা সমন্বয় মিটিংয়ে ওষুধ ও কমিউনিটি ক্লিনিক বন্ধ বিষয়ে কথা বলেছি। কিন্তু কর্তৃপক্ষ কথাগুলো আমলে নিচ্ছে না। আমি আমার ইউনিয়ন পরিষদের একটি রুম দিয়েছি পরিবার পরিকল্পনা পরিদর্শিকাকে। কিন্তু সেটাও এখন বন্ধ থাকে। মিটিংয়ে অনেকবার এ নিয়ে তর্ক-বির্তকও হয়েছে।
সদর উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা বিশ্বজিৎ কৃষ্ণ চক্রবর্র্তী বলেন, সুনামগঞ্জ সদর উপজেলায় ৩৩ হাজার ৩০৮ জন দম্পতি সেবা গ্রহণ করছেন। আমাদের বর্তমানে ৩৮ জন পরিবার কল্যাণ সহকারী প্রয়োজন হলেও রয়েছেন ২৮ জন। এতে করে সেবা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। যদি ডেস্ক লেভেলের কাজ হতো তাহলে অন্য কাউকে দিয়ে কাজ করানো যেত। কিন্তু মাঠ পর্যায়ের কাজ কেউ অতিরিক্ত করতে চায় না। বিষয়টি জেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ে জানানো হয়েছে।
মোসাইদ রাহাত/এমএএস/এমএস