অর্থনীতি

যোগ্যরা বঞ্চিত, ডিএসইর কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভ

দীর্ঘদিন ধরে দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে অনিয়মের অভিযোগ ওঠায় সম্প্রতি পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) প্রতিষ্ঠানটির চাকরির বিধিমালা করে দেয়ার পদক্ষেপ নিয়েছে। এমন পরিস্থিতেই চলতি সপ্তাহে আবারও যোগ্য কর্মকর্তাদের বঞ্চিত করে প্রায় অর্ধশত কর্মকর্তা-কর্মচারীকে পদোন্নতি দিয়েছে ডিএসই। এতে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তাদের মধ্যে এক ধরনের চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে।

Advertisement

ডিএসইর একাধিক কর্মকর্তা অভিযোগ করেন, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ধরে অনিয়ম করা হচ্ছে। চাকরির বিধিমালায় ২-৪ বছরের মধ্যে অফিসার এবং নন-অফিসার পদে পদোন্নতির কথা উল্লেখ থাকলেও অনেক কর্মকর্তাকে ১০ বছরের অধিক সময় ধরে কোনো পদোন্নতি দেয়া হয়নি। পদোন্নতির ক্ষেত্রে বরাবরই যোগ্য কর্মকর্তাদের বঞ্চিত করে তোষামোদকারীদের বেছে নেয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে ডিএসইর সাবেক এক কর্মকর্তা (বর্তমানে একটি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংককে কর্মরত) বলেন, ‘ডিএসইতে পদোন্নতির ক্ষেত্রে অনেক অনিয়ম হয়। যোগ্যতাকে মূল্যায়ন না করে যারা লেজুড়বৃত্তি করতে পারেন তাদেরকে পদোন্নতি দেয়া হয়।’ তিনি বলেন, ‘২০১০ সালে আমরা ৩০-৩৫ জন ডিএসইতে এক্সকিটিভ হিসেবে যোগ দিয়েছিলাম। কিন্তু পদোন্নতির অনিয়মের কারণে আমার ব্যাচের প্রায় সবাই ডিএসইর চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। এখন মাত্র ৫-৭ জনের মতো আছেন।’

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জনা গেছে, ডিএসইর বর্তমান প্রধান অর্থ কর্মকর্তা (সিএফও) আব্দুল মতিন পাটোয়ারী প্রতিষ্ঠানটিতে যোগদানের পর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে কেপিআইভিত্তিক (কি পারফরম্যান্স ইন্ডিকেটর) মূল্যায়ন পদ্ধতি চালু করেন। এতে দীর্ঘদিন ধরে ডিএসইতে কাজ করা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পদোন্নতি এবং বেতন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে এক ধরনের জটিলতা তৈরি হয় এবং কর্মকার্তাদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়।

Advertisement

এরপরও বর্তমানে ডিএসইতে পদোন্নতির ক্ষেত্রে কেপিআইভিত্তিক মূল্যায়ন পদ্ধতিই বহাল রয়েছে। এই মূল্যায়ন পদ্ধতির ওপর ভিত্তি করে ২০১৭-১৮ বছরের জন্য চলতি সপ্তাহে ডিএসইর প্রায় অর্ধশত কর্মকর্তা-কর্মচারীকে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। তবে এক্ষেত্রেও যোগ্যদের বঞ্চিত হওয়ার রীতি অব্যাহত রয়েছে। কেপিআইভিত্তিক মূল্যায়ন পদ্ধতিতে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েও পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত হয়েছেন অনেকে।

সর্বোচ্চ নম্বরপ্রাপ্তদের বঞ্চিত করার পাশাপাশি কোটাভিত্তিক পদোন্নতিতেও অনিয়ম করা হয়েছে। ডিএসইর কোটাভিত্তিক পদোন্নতির ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, একটি ডিপার্টমেন্ট থেকে সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ উদোন্নতি পাবেন। তবে সম্প্রতি দেয়া পদোন্নতির ক্ষেত্রে কোনো ডিপার্টমেন্টে ৫ জনের মধ্যে ২ জন, কোথাও ৭ জনে ৩ জন, আবার কোনো ডিপার্টমেন্টে ১২ জনের মধ্যে ১ জনকে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে।

যাদেরকে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে তাদের কারও কারও বিরুদ্ধে অবৈধ শেয়ার ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকা এবং ডিএসই এফডিআর ফান্ডের টাকা আত্মসাত করার অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু বিএসইসির এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বিশেষ সুপারিশে তাদের পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া কেপিআই মূল্যায়নে কম নম্বর পেলেও ব্রোকার হাউসের মেম্বারদের সুপারিশে কারও কারও পদোন্নতি দেয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে ডিএসইর এক জুনিয়ার এক্সিকিউটিভ বলেন, ‘আমার ডিপার্টমেন্ট থেকে এমন একজনকে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে, যিনি আমিসহ আরও একাধিক জনের থেকে কম নম্বর পেয়েছেন। অথচ যারা বেশি নম্বর পেয়েছে তাদের কাউকে পদোন্নতি দেয়া হলো না। এভাবে যদি পদোন্নতি দেয়া হয় তাহলে কাজের মূল্যায়ন হলো কীভাবে?’

Advertisement

যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘যোগ্য কর্মকর্তাকে বঞ্চিত করা অথবা সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়া কর্মকর্তাকে পদোন্নতি না দিয়ে অন্যকে পদোন্নতি দেয়া হলে সে বিষয়ে বিএসইসির পদক্ষেপ নেয়া উচিত।’

এদিকে ডিএসই কর্তৃপক্ষ কিছুদিন আগে নতুন করে এমটিও (ম্যানেজমেন্ট ট্রেইনি অফিসার) নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে। এই নতুন নিয়োগের ফলে পুরনো কর্মকর্তাদের প্রতি আবারও অবিচার করা হবে-এমন অভিযোগ করে ডিএসইর এক কর্মকর্তা বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে অনেকে এক্সিকিউটিভ পদে চাকরি করছেন। তাদের পদোন্নতি না দিয়ে এমটিও পদে নতুন করে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। এই এমটিও পদে নতুন করে নিয়োগ দিলে এক্সকিউটিভরা আরও পিছিয়ে পড়বেন।’

ভালো নম্বর পাওয়ার পরও পদোন্নতি বঞ্চিত আরও এক কর্মকর্তা বলেন, ‘ডিএসইর ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হিসেবে কে এম মাজেদুর রহমান ডিএসইতে যোগদানের পর নানাভাবে কর্মচারীদের সুযোগ–সুবিধা, বেতন কমানোর জন্য নতুন পলিসি তৈরি করছেন। কর্মচারীরা তাদের দাবি নিয়ে একাধিকবার এমডির কাছে গেলে উনি প্রতিবার মৌখিকভাবে জানিয়ে দেন-যারা এই বেতনে থাকতে পারবে তারা থাকবে, যারা পারবে না তাদের জন্য দরজা খোলা আছে, তারা চলে যেতে পারেন।’

কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এভাবে বঞ্চিত করা হলেও ডিএসইর শীর্ষ কর্মকর্তারা তাদের সুবিধা বাড়িয়ে নিচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। সম্প্রতি ডিএসইর পর্ষদ সদস্যদের সম্মানী ৫ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ১০ হাজার টাকা করা হয়েছে। এর আগে সিএফও এবং প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তার (সিটিও) চাকরি চুক্তিভিত্তিক হলেও তারা তা স্থায়ী করে নেন। আবার চাকরিবিধিতে ডিএসইর সকল কর্মকর্তার সন্তানদের জন্য বীমা সুবিধার কথা বলা হলেও শুধু এমডির সন্তানরা বীমার সুবিধা পাচ্ছেন।

এমন অনিয়ম চলার মধ্যেই চলতি বছরের শুরুর দিকে ডিএসইর চাকরি বিধিমালা ঠিক করার উদ্যোগ নেয় বিএসইসি। ডেপুটি ডিরেক্টর আবুল কালাম আজাদের নেতৃত্বে একটি কমিটিও গঠন করা হয়। এরপর জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময়ে বিএসইসির দু’জন প্রতিনিধি (আবুল কালাম আজাদ ও নজরুল) ডিএসইর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেন। বৈঠকে ডিএসইর কর্মকর্তারা বিএসইর উদ্যোগকে স্বাগত জানান এবং প্রধান অর্থ কর্মকর্তা ও প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তার পদ দুটি চুক্তিভিক্তিক করার দাবি জানান।

অপরদিকে, বিএসইসির প্রতিনিধিদের পক্ষ থেকে ডিএসইর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বলা হয়, যদি কোনো অভিযোগ অথবা মতামত আপনারা এখানে (বৈঠকে) উল্লেখ করতে ভয় পান তাহলে আমাদের ই-মেইল করেও জানাতে পারেন। এ সময় বিএসইসির দুই কর্মকর্তা তাদের ই-মেইল ঠিকানা ডিএসইর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দিয়ে আসেন। এরপর ডিএসইর একাধিক কর্মকর্তা তাদের কাছে ই-মেইলে লিখিত অভিযোগ জানিয়েছেন।

সার্বিক বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সাইফুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘ডিএসইর চাকরি বিধিমালার বিষয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। ওই কমিটির সুপারিশ না আসা পর্যন্ত আমি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে পারব না।’

অনিয়মের বিষয়ে ডিএসইর ব্যবস্থাপনা পরিচালক কে এম মাজেদুর রহমানের মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তার কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

তবে ডিএসইর চেয়ারম্যান আবুল হাশেম জাগো নিউজকে বলেন, ‘পদোন্নতির বিষয়টি ম্যানেজমেন্টের দায়িত্ব। তবে পদোন্নতির ক্ষেত্রে কোনো অনিয়ম হলে আমাদের কাছে লিখিত অভিযোগ করলে আমরা অবশ্যই পদক্ষেপ নেব।’

এমএএস/এসআর/পিআর