জাতীয়

ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন পূরণ হলো না আবরারের

আবরারের স্বপ্ন ছিল ডাক্তার হওয়ার। মেডিকেল কলেজে সুযোগ না পেয়ে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফোশনালসে (বিইউপি) ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনশিপ (আইআর) বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি। আগামী বছর আবারও মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের ইচ্ছা ছিল তার। কিন্তু সব স্বপ্ন শেষ হয়ে গেল।

Advertisement

ছেলের দাফনের সময় কান্নাজড়িত কণ্ঠে এসব বলে মূর্ছা যাচ্ছিলেন সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত আবরার আহাম্মেদ চৌধুরীর মা ফরিদা ফাতেমী। মঙ্গলবার দুপুরে বিইউপির এডিবি গ্রেড গ্রাউন্ড মাঠে জানাজা শেষে বনানী সামরিক করবস্থানে আবরারকে দাফন করা হয়। এ সময় পরিবারের সদস্য, আত্মীয়-স্বজন, সহপাঠী, বন্ধু-বান্ধব, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

আবরারসহ দুই ছেলে ছিল ফরিদা ফাতেমীর। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল থেকে ‘এ’ এবং ‘ও’ লেভেল পাস করে বিইউপিতে পড়ছিলেন আবরার। ছোট ছেলে আবীদ আহাম্মেদ চৌধুরী ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের ৮ম শ্রেণির ছাত্র। বসুন্ধরা ডি ব্লকে ভাড়া বাসায় থাকতেন তারা।

ছেলেকে শেষ বিদায় দিতে এসে মা ফরিদা ফতেমী বলছিলেন, ‘আমার বাবাকে কখনো একা ছাড়তে চাইতাম না। ও বলতো, আম্মু তুমি যদি আমাকে একা চলাফেরা করতে না দাও, তবে আমি ইন্ডিপেন্ডেন্ট হবো কীভাবে? সবাই আমার বাবাটাকে অনেক পছন্দ করতো। পরিবারের মাথার মুকুট ছিলি তুই। আমাদের একা ফেলে চলে গেলি কীভাবে? আমি কীভাবে তোকে ছাড়া থাকব? তুই একবার ফিরে এসে আমায় জড়িয়ে ধরে মা বলে ডাক বাবা।’

Advertisement

ছেলেকে কবরে শুইয়ে দেয়ার দৃশ্য দেখে আবরারের বাবা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আরিফ আহাম্মেদ চৌধুরী মুষড়ে পড়েন। তিনি বলেন, ‘জীবনে অনেক কষ্টের সময় পার করেছি। ছেলেকে কবরে শুইয়ে দেয়ার মতো কষ্ট আর কিছুর সঙ্গে মিলবে না। জীবনের সব সফলতা যেন একটি ঘটনায় ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। আমার বাবাটা আর আমার কাছে আসবে না, কোনো দিন আর আমি তার মুখে বাবা ডাক শুনতে পারব না।’

আবরারের ছোট চাচা মাসুদ আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘আবরার কমিশনার র‌্যাংকে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমান বাহিনীতে নিয়োগ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিল। তার ইচ্ছা ছিল সেনাবাহিনীর ডাক্তার হওয়া। এ বছর মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষায় সফল না হওয়ায় আগামী বছর আবারও মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের ইচ্ছা ছিল তার। সে ছিল সবার আদরের পাত্র। বই পড়ার প্রতি তার আগ্রহ ছিল অনেক বেশি। নিয়মিত নামাজ পড়তো আবরার। সবাই তাকে অনেক পছন্দ করতো।’

রাকিব হাসানসহ আবরারের বেশ কয়েকজন সহপাঠী বলেন, ‘মাত্র তিন মাসে বিশ্ববিদ্যালয়ে সবার মন জয় করে ফেলেছিল আবরার। সে অনেক ভালো ছাত্র হওয়ায় আমরা তাকে সিজিপি-৪ বলে ডাকতাম। কারণ আমরা জানতাম, সে বেস্ট রেজাল্ট করবে। এ কারণে আমরা সবাই তাকে এই নামে ডাকতাম।’

তারা আরও বলেন, ‘ক্লাসে স্যারদের কোনো প্রশ্ন শেষ হওয়ার আগেই তার মুখে উত্তর চলে আসতো। মনে হতো পাঠ্যবইয়ের সব কিছু তার পড়া হয়ে গেছে। সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তার ছেলে হয়েও তার কোনো অহঙ্কার ছিল না। বইয়ের কোনো পড়া নিয়ে সমস্যা হলে যে কোনো সময় তাকে নক করলে সহজভাবে সমাধান করে দিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের সবার সঙ্গে তার সুসম্পর্ক ছিল। সহপাঠী, সিনিয়র ও স্যাররা তাকে অনেক ভালোবাসতেন।’

Advertisement

কবরস্থানে আবরারকে চিরশায়িত করতে উপস্থিত হয়েছিল তার স্কুলজীবনের বন্ধুরাও। তারা বলেন, ‘বসুন্ধরার প্রে-পেন ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল থেকে আবরার ‘এ’ এবং ‘ও’ লেভেল পাস করে। দুটি পরীক্ষায় সে সর্বোচ্চ ফল অর্জন করে। তারা বর্তমানে একসঙ্গে পড়ালেখা না করলেও স্কুল ও কলেজ জীবনের বন্ধুদের মধ্যে আগের মতোই সুসম্পর্ক ছিল।’

তারা বলেন, ‘ইতিহাস ও রাজনীতি নিয়ে আবরারের অনেক কৌতূহল ছিল। এ-সংক্রান্ত বই অনেক পড়তো সে। দেশ-বিদেশের খবর রাখতো। বিভিন্ন বই পড়ে আমাদের সঙ্গে তা শেয়ারও করতো। সে ছিল চুপচাপ ও শান্ত স্বভাবের। কখনও কারো সঙ্গে ঝগড়া করতে দেখিনি। সবাই তাকে ভালোবাসতো।’

আবরারের বন্ধুরা আরও বলেন, ‘তার কাছে সবসময় একটি কলমের মাথা থাকতো। কথা বলার সময় সে হাতের কব্জি ঘুরিয়ে কলমের মাথাটা নেড়ে নেড়ে কথা বলতো। বিষয়টি নিয়ে আমরা অনেক হাসাহাসিও করতাম। তার মৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছি না আমরা।’

এমএইচএম/এমএসএইচ/জেআইএম/এমএস