জাতীয়

রাতে স্বপ্ন দেখি আবারও দেখতে পারছি

>> আমি তো এমন ছিলাম না >> পৃথিবীর আলোটাকে আবারও দেখতে ইচ্ছা করে >> খুব ইচ্ছা করে জীবনসঙ্গীকে দেখতে >> ইচ্ছা আছে ভবিষ্যতে শিক্ষকতা করার

Advertisement

‘প্রতি রাতে স্বপ্ন দেখি, আমি আবারও চোখে দেখতে পারছি। দুরন্তপনা সেই আমি আবারও ছোটাছুটিতে ব্যস্ত। আমাকে রোধে পরিবারের সদস্যরা শাসন করছেন। কলেজের শিক্ষক, ক্লাসের বন্ধুদের মাঝে আবারও সেই আমি আগের বেশে বারবার ফিরে আসি।’ 

বলছিলেন পুলিশের টিয়ারশেলে চোখ হারানো তিতুমীর কলেজের ছাত্র সিদ্দিকুর রহমান।

গত রোববার তার সঙ্গে কথা হয় জাগো নিউজের। 

Advertisement

সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘অনেক ভালো আছি। পৃথিবীর আলো দেখতে না পারলেও মনের আলো দিয়ে পৃথিবীটাকে দেখার চেষ্টা করি। জীবনসঙ্গী আর পরিবার-পরিজনদের সহাযোগিতায় দিন পার হয়ে যাচ্ছে। তবে মনের মধ্যে লালন করা স্বপ্নকে এখনো ধারণ করে রেখেছি।’

গত ৭ মার্চ অনার্স শেষ বর্ষের পরীক্ষা শেষ হয় সিদ্দিকুর রহমানের। শ্রুতিলেখকের মাধ্যমে পরীক্ষা দেন তিনি। পরীক্ষা সম্পর্কে তিনি বলেন, আশা করি, আগের মতোই ভালো ফল পাব।

সরকারি প্রতিষ্ঠান এসেনশিয়াল ড্রাগস কোম্পানিতে টেলিফোন অপারেটর পদে চাকরি করছেন সিদ্দিকুর। চাকরি জীবনের এক বছর পার করেছেন। এর মাঝে পরিবারের ইচ্ছায় খালাতো বোনের সঙ্গে বিয়ে হয়। বর্তমানে রাজধানীর মগবাজারে একটি ফ্লাট বাসা ভাড়া করে বসবাস করছেন তারা। স্ত্রীর চোখের আলোতে সিদ্দিুকরের জীবন চলছে।

সিদ্দিকুর বলেন, চাকরির শুরুতে অনেক সমস্যার মধ্যে পড়তে হয়। সহর্মীদের সহযোগিতায় কোনোভাবে কাজ চালিয়ে নিয়েছি। বর্তমানে কারও সহযোগিতা ছাড়াই আমি অফিসের প্রায় সব কাজ করতে পারি। টেলিফোন অপারেটর হিসেবে অনেকের নম্বর মনে রাখতে হয়। প্রথমে সবার কণ্ঠ শুনে স্বরণ করে চেনার চেষ্টা করি। বর্তমানে কেউ ফোন করলে তাকে চিনতে সমস্যা হয় না।

Advertisement

জানালেন, নিজেকে কাজের মধ্যে ব্যস্ত রাখতে ভালো লাগে তার। অলস সময় পার করতে তার ভালো লাগে না। অলস সময় তার কাছে পীড়াদায়ক মনে হয়। তখন তিনি ফেলে আসা দিনগুলো সৃতিচারণ করার চেষ্টা করেন।

তিনি বলেন, আমার চোখ হারিয়ে গেলেও মনের আলো হারিয়ে যায়নি। আগের মতো এখনো আত্মবিশ্বাস রয়েছে। ইচ্ছা আছে ভবিষ্যতে শিক্ষকতা করার। অর্নাস পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর মার্স্টাসে ভর্তি হব। ইতোমধ্যে কম্পিউটার ও ব্রেইল প্রশিক্ষণ কোর্স শেষ করেছি।

ফেলা আসা কোন বিষয়গুলো বেশি মনে পড়ে- জানতে চাইলে সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়ে পরিবারে মা আর ভাই-বোনরাই ছিল আমার আলোর দিশারি। পরিবারে একমাত্র আমি পড়ালেখা করার সুযোগ পেয়েছি। তাই সবার ইচ্ছা ছিল পড়ালেখা করে আমি বড় মানুষ হয়ে সবাইকে দরিদ্রতা থেকে মুক্তি দেব। তাদের সেই স্বপ্ন আমি মনে হয় আর পূরণ করতে পারব না। সবার প্রতি দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করতে এখন আমি সক্ষম নই। এসব বিষয় মনে হলে অন্তরে কষ্ট পাই। 

সিদ্দিকুর বলেন, অনেক সময় আমাকে একাই অফিসে যেতে হয়। বাইরে বের হলেই রাস্তায় আঘাত খেতে হয়। রিকশা বা বাসের ধাক্কা লাগে, তারপরও একা চলার চেষ্টা করি। আঘাত পেলে মনে হয়, আমি তো এমন ছিলাম না। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে আমার চোখের আলো হারিয়ে গেছে। অনেক ইচ্ছা করে এ পৃথিবীর আলোটাকে আবারও দেখতে। সব মানুষের মাঝে হারিয়ে যেতে, কিন্তু আমার পক্ষে তা অসম্ভব। অন্যের ওপরেই আমাকে নির্ভর করে চলতে হয়।

কাকে বেশি দেখতে ইচ্ছা হয়- জানতে চাইলে তিনি বলেন, সবাই থাকার পরও মনে হয় আমি নিঃস্ব। নিজের স্ত্রীকেও একটিবার দেখতে পারিনি। অনেক ইচ্ছা করে তাকে দেখতে। আমার জন্য তাকে (স্ত্রী) অনেক বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। স্বামীকে নিয়ে স্ত্রীর অনেক স্বপ্ন থাকে, কিন্তু সেই স্বপ্ন পূরণ করতে আমি সক্ষম নই। এ জন্য অনেক কষ্ট পাই। 

‘পরিবারের সবাইকে দেখতে ইচ্ছা করে। দুনিয়াটা আমার কাছে অন্ধকার। আর কোনোদিন আমি দেখতে পাব না। কাউকে আর দেখতে পারব না’,- বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।

উল্লেখ্য, ২০১৭ সালের ২০ জুলাই রাজধানীর শাহবাগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত রাজধানীর সাতটি সরকারি কলেজের পরীক্ষার তারিখ ঘোষণার দাবিতে শাহবাগে আন্দোলনের সময় পুলিশের টিয়ারশেলের আঘাতে চোখে গুরুতর আঘাত পান সিদ্দিকুর রহমান। পরে তাকে সরকারি খরচে উন্নত চিকিৎসার জন্য ভারতের চেন্নাইয়ে পাঠানো হয়।

চেন্নাইয়ের শঙ্কর নেত্রালয়ের চিকিৎসকরা চোখ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ভালো না হওয়ার কথা জানালে সিদ্দিকুর রহমানকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। একই বছরের ১৩ সেপ্টেম্বর সরকারি ওষুধ কোম্পানিতে যোগদান করতে সিদ্দিকুরের হাতে নিয়োগপত্র তুলে দেন সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম।

এমএইচএম/জেডএ/পিআর