মতামত

জীবনের মর্মান্তিক অপচয়

আবারো উপকূলে নৌকাডুবিতে বাংলাদেশির মৃত্যু সংবাদ শিরোনাম হয়েছে। এবারের ঘটনা লিবিয়ার উপকূলে। আশঙ্কা করা হচ্ছে ২৪ বাংলাদেশি প্রাণ হারিয়েছে, জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে ৫৪ জনকে। এদের অধিকাংশই শ্রমিক।  শ্রমিক হওয়া অসম্মানের কোনো বিষয় নয়। কাজের খোঁজে বিশ্বের একপ্রান্ত থেকে অপর প্রাপ্তে যাওয়ার উদ্যোগ এবং আগ্রহ কোনোটাই অসম্মানের নয়। বরং শ্রমিকদের ঘামে ভেজা টাকা দেশে সমৃদ্ধি আনে। বিশেষ করে যে কয়েকটি নিয়ামকের ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশের অর্থনীতি সবল আছে, তার অন্যতম শ্রমিকদের পাঠানো টাকা। রেমিটেন্স। কিন্তু শ্রমিকদের বেঘোরে প্রাণ যাওয়া দুঃখজনক। বিশেষ করে অবৈধভাবে এক দেশ থেকে অন্য দেশে পাড়ি দেওয়ার সময় প্রাণ হারানো জীবনের এক মর্মান্তিক অপচয়। কক্সবাজার উপকূল দিয়ে নৌকায় সাগর পাড়ি দেওয়া বিষয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। মায়ানমারের রোহিঙ্গাদের তৎপরতা, এই এলাকায় মানব পাচারের ব্যবসা নিয়ে অনেক কথাই জানা গেছে নানাজনের মুখ থেকে। ফলে, প্রশ্ন একটাই ঘুরপাক খাচ্ছে জনমনে। কেন বাংলাদেশিরা? কেন বাংলাদেশের মানুষ বেঘোরে মারা যাচ্ছে অবৈধভাবে সীমান্ত বদল করতে গিয়ে। দেশে গৃহযুদ্ধ নেই। না খেয়ে মানুষ মরছে না। জবাবও সবার জানা। স্বপ্ন। আরেকটু ভালোভাবে বাঁচার আশা। একেবারেই যাদের দিনে আনি দিনে খাই অবস্থা তাদের কতো মানুষ দেশ ছেড়ে  অন্য দেশে যেতে চায় ? কিংবা পারে? বরং যাদের কিছুটা সামর্থ্য আছে, তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে সুযোগটা কাজে লাগাতে। তাদের চোখের সামনে ঝুলে থাকে বড় বাড়ি, নিজের গাড়ি উত্তরাধিকারের নিরাপদ জীবনের হাতছানি। যারা বৈধভাবে বিদেশে গিয়ে সম্পদ অর্জন করেছেন অঢেল, সেসব সম্পদ আরো মানুষের সামনে উদাহরণ হিসাবে কাজ করে। তারাও ভাবে একবার বিদেশ যেতে পারলে আর ঠেকায় কে। ফলে যেনতেনভাবে যাওয়ার ঝুঁকি পাত্তা পায় না সম্ভাবনার স্বপ্নের কাছে। অবৈধ পথে যারা যায়, তারা কী জানে না পথের ঝুঁকি? জানে, কিন্তু ঠিক অনুধাবন করতে পারে বলে মনে হয় না। কিংবা একসঙ্গে অনেক মানুষ জড়ো হলে হয়তো তাদের সাহস বেড়ে যায়। একসঙ্গে অনেক মানুষ জড়ো হলে অনেক কিছুই করা সম্ভব। কিন্তু দুর্গম পথের মৃত্যু ঝুঁকি কমানো যে সম্ভব নয় তা বারবার প্রামাণ হচ্ছে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশ জনবহুল দেশ । বিভিন্ন সময়ে বলা হয়েছে দেশের ১৬ কোটি মানুষের হাতকে কর্মীর হাতে পরিণত করতে হবে। মানে, সবার সম্মিলিত শ্রম দেশকে এগিয়ে নিতে পারে সমৃদ্ধির পথে। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তবে কাঙ্ক্ষিত ফল পেতে দরকার হবে সুচিন্তিত পরিকল্পনার। বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি পাঠানো হয় অদক্ষ শ্রমিক। তারা আয়ের প্রায় পুরোটাই দেশে পাঠায়। তাদেরকে আধা দক্ষ করে পাঠানো গেলে, আয়ের পরিমাণ বাড়তো। দক্ষ জনশক্তি রপ্তানি করে ব্যাপক আয় করা যায় সেকথা না -ই বা বললাম। দক্ষ হয়ে যারা দেশের বাইরে কাজ করতে যায় তাদের অধিকাংশই নিজ উদ্যোগে। অথচ, আমাদের দেশে মেধাবী মানুষের অভাব নেই। উল্টো বিভিন্ন খাতে নির্বাহী পদে কাজ করার জন্য দেশের বাইরে থেকে অফিসার আনতে হয়। বিভিন্ন দেশের মানুষ এদেশ থেকে আয় করে নিয়ে যায়। দক্ষতা গড়ার উদ্যোগ সরকারি কিংবা বেসরকারি যেকোনো খাত থেকে নেওয়া যেতে পারে। তার আগে বিশ্বে কোন কোন খাতে দক্ষ ও বিশেষায়িত কাজের চাহিদা আছে আর তালিকা হাতে থাকা চাই। এখন অবশ্য ওযেব ডিজাইন, গ্রাফিক্সসহ নানা কাজে ঘরে বসে ব্যস্ত থাকছে এদেশের অনেক তরুণ, আয় করছে ভালো। এই ধারা আরেকটু সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ দরকার। বিশ্বজুড়ে শ্রমের বাজার শুধু অদক্ষ শ্রমিকদের নয়, দক্ষ বিশেষায়িত মানুষদের জন্যও।  বলছি, আয়ের জন্য আন্তর্জাতিক বাজারে নিজেদের অবস্থান আরেকটু বাড়ানোর কথা। আমাদের সেনাবাহিনী এর ভালো একটা উদাহরণ হতে পারে। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী হিসাবে সুনাম ও আয় দুটোই রয়েছে এই সংস্থাটির। তারা আমাদের জাতীয় গৌরব। তেমনি, ভারতের সেনাবাহিনী শান্তিরক্ষী মিশনে, তাদের বিজ্ঞানীরা নাসায় কাজ করে দেশেরই মর্যাদা বাড়াচ্ছে। নিজেদের আয়ও। এক দেশের দক্ষ পেশাজীবীরা অন্যদেশে গিয়ে আয় বাড়াবে নিজের, এই উদাহরণ গৌরবের। মনে করি, আমাদের তরুণদের সে মানসিকতায় গড়ে তোলার সময় এসেছে। গ্লোবাল ভিলেজ ধারণার এই সময়ে পৃথিবী মানুষের হাতের মুঠোয়। ফলে, দিগন্ত হওয়া উচিত অনেক বড়, স্বপ্ন আকাশ সমান। সেই স্বপ্ন জয়ে প্রথম সিঁড়িই হলো দক্ষতা অর্জন। অদক্ষ শ্রম বিষয়ে আরেকটু বলতে চাই। অদক্ষ শ্রমিকের দরকার হয় যত্ন। তাকে শেখাতে হয় কাজ। তাকে শেখাতে হয় নতুন পরিবেশে কাজ করানো। শেখাতে হয় সেদেশের আইন। শেখানো উচিত বৈধভাবে বিদেশ পাড়ি দেওয়ার সুযোগগুলো। রাষ্ট্র এই পরিচর্যার কাজটি করতে পারে। সরকার মহোদয় ভেবে দেখবেন কি?লেখক : সিনিয়র বার্তা সম্পাদক, দীপ্ত টিভি।এইচআর/এমএস

Advertisement