যুগে যুগে বিভিন্ন কারণে দেশে দেশে হামলার ঘটনা ঘটে আসছে। যে বা যারাই এ হামলা করুক, পরাজিত হয় মানবতা। ধর্মীয় বা ব্যক্তিগত কারণে হলেও এসব হামলায় নিহত হন নিরাপরাধ কিছু মানুষ। বিশ্বজুড়ে নিন্দা ও সমালোচনার ঝড় ওঠে। আসুন তেমন কিছু হামলা সম্পর্কে জেনে নেই আজ-
Advertisement
হিরোশিমা ও নাগাসাকি হামলা: ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট সকালে যুক্তরাষ্ট্রের বিমান বাহিনী জাপানের হিরোশিমা শহরের ওপর ‘লিটল বয়’ নামের নিউক্লিয়ার বোমা ফেলে। এর তিন দিন পর নাগাসাকি শহরের ওপর ‘ফ্যাট ম্যান’ নামের আরেকটি নিউক্লিয়ার বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। এ বোমা বিস্ফোরণের ফলে হিরোশিমাতে প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার লোক মারা যান। আর নাগাসাকিতে প্রায় ৭৪ হাজার লোক মারা যান।
সিনেমা রেক্স ফায়ার: ১৯৭৮ সালের আগস্ট মাসে ইরানের আবাদানে সিনেমা রেক্সে আগুন লাগিয়ে ৪শ ৭০ জনকে হত্যা করা হয়। সিনেমা চলাকালীন দরজা বন্ধ করে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। ইরানের ক্ষমতাসীন সরকার ঘটনার শুরুতেই ইসলামপন্থি জঙ্গিদের দায়ি করলেও দেশটির বিপক্ষ দল দেশের ইন্টেলিজেন্স গ্রুপ সাভাককে আগুন লাগানোর জন্য দায়ি করে।
এয়ার ইন্ডিয়া ফ্লাইটে বিস্ফোরণ: বিমানটি আইরিশের আকাশ সীমানায় ১৯৮৫ সালের ২৩ জুন বিস্ফোরিত হয়। বিমানে বোমাটি বিস্ফোরিত হলে কোন যাত্রী এবং কর্মী বেঁচে ছিলেন না। বিমানটির ধংসস্তুপ আটলান্টিক সাগরে পতিত হয়। বিমানে ৩২৯ জন যাত্রী ছিলেন। এয়ার ইন্ডিয়ার এ হামলার সময় নারশিয়া বিমানবন্দরেও বোমা হামলা হয়। কানাডার নিরাপত্তা বাহিনী ভারতের শিখ জঙ্গিগোষ্ঠী বাব্বার খালসাকে এ হামলার জন্য দায়ি করে।
Advertisement
টুইন টাওয়ার হামলা: ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ারের ওপর এ হামলা চালানো হয়। এতে ২ হাজার ৯৯৩ জন নিহত এবং ৮ হাজার ৯শ জন আহত হন। ১৯ জন আল কায়দার জঙ্গি চারটি বিমান ছিনতাই করে। আমেরিকান এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট ১১ এবং ইউনাইটেড এয়ারলাইন্সের ১৭৫ বিমান দুটি নিউ ইয়র্ক সিটির টুইন টাওয়ারের উত্তর এবং দক্ষিণ টাওয়ারের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে আঘাত আনে। ছিনতাই হওয়া তৃতীয় বিমান আমেরিকান ফ্লাইট ৭৭ ভার্জিনিয়া রাজ্যে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা সদর দফতর পেন্টাগনে আঘাত করে। চতুর্থ বিমান ইউনাইটেড এয়ারলাইন ফ্লাইট ৯৩ এর লক্ষ্য ছিল ওয়াশিংটন ডিসি। কিন্তু যাত্রীদের সাথে ছিনতাইকারীদের ধস্তাধস্তিতে বিমানটি পেনিস্যালভিনিয়ার এক মাঠে বিধ্বস্ত হয়। এর পেছনে ওসামা বিন লাদেন ছিলেন বলে যুক্তরাষ্ট্র দাবি করে।
> আরও পড়ুন- বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশ মোনাকো
বেসলান গণহত্যা: বেসলান স্কুলে জঙ্গি হামলা হয় ২০০৪ সালের ১ সেপ্টেম্বর। তিন দিনের জিম্মি অবস্থায় ১ হাজার ১শ মানুষকে বন্দি করে জঙ্গিরা। যাদের মধ্যে ৭৭৭ জনই স্কুলছাত্র। এ হামলায় কমপক্ষে ৩৮৫ জন মারা যান। ইঙ্গুস এবং চেচেন নামের ইসলামপন্থি জঙ্গিরা রাশিয়ার উত্তর ককেশাসের নর্থ অসেটিয়া এলাকার বেসলান শহরের স্কুল নাম্বার ওয়ানে এ হামলা করে। জিম্মি দশার তৃতীয় দিনে রাশিয়ার বিশেষ বাহিনী ট্যাঙ্ক, ভারী অস্ত্র নিয়ে স্কুলে প্রবেশ করে।
লন্ডনে সিরিজ বোমা হামলা: ২০০৫ সালের ৭ জুলাই মধ্য লন্ডনের তিনটি আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশন ও একটি বাসে আত্মঘাতী সিরিজ বোমা হামলায় নিহত হন ৫২ জন। আহত হন সাত শতাধিক মানুষ। স্থানীয় সময় সকাল ৮টা ৫০ মিনিটে লন্ডনের রাসেল স্কয়ারের আন্ডারগ্রাউন্ড ট্রেন স্টেশনে প্রথম হামলা চালানো হয়। প্রায় কাছাকাছি সময়ে এজওয়ার ও অ্যাল্ডগেটে পৃথক দুটি হামলায় যথাক্রমে ছয় ও সাত জন নিহত হন। এর প্রায় একঘণ্টা পর তাভিস্টক স্কয়ারে একটি দ্বিতল বাসে বোমা হামলা চালানো হয়। জানা যায়, বোমা হামলাকারী চার জঙ্গির সঙ্গে চরমপন্থি সংগঠন আল কায়েদার সংযোগ ছিল।
Advertisement
ইরাকে বোমা হামলা: ইরাকের ইয়াজিদী এবং জাজিরা শহরে যুক্তরাজ্যের আধিপত্য থাকা অবস্থায় ২০০৭ সালের আগস্টের ১৪ তারিখ পর পর চারটি আত্মঘাতী গাড়ি বোমা হামলা করা হয়। তিনটি গাড়ি এবং একটি তেলের ট্যাংকার প্রায় দুই টনের মত বিস্ফোরক বহন করছিল। এ হামলায় ৭৯৬ জন নিহত এবং ১ হাজার ৫৬২ জন আহত হন। এ বোমা বিস্ফোরণে ভবনসহ চারপাশ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। ধারণা করা হয়, ইরাকের আল কায়দা এ হামলা করে।
পাকিস্তানের স্কুলে গুলিবর্ষণ: ২০১৪ সালের শেষ দিকে পাকিস্তানের পেশোয়ারে সেনাবাহিনী পরিচালিত একটি স্কুলে বর্বর হত্যাযজ্ঞ চালায় তালেবান জঙ্গিরা। এতে নিহত হয় ১৩০ জনেরও বেশি শিক্ষার্থী। এতে অন্তত ১২০ জনের বেশি স্কুলশিক্ষার্থী আহত হয়। সেদিন দুপুরের আগে ৮-১০ জন জঙ্গি সামরিক পোশাকে খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশের রাজধানী পেশোয়ারের আর্মি পাবলিক স্কুলে ঢুকে পড়ে। খবর পেয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা স্কুলের দিকে অগ্রসর হলে শুরু হয় তুমুল গোলাগুলি। প্রায় ৮ ঘণ্টার অভিযানের পর স্কুলটির নিয়ন্ত্রণ নেন সেনা সদস্যরা।
প্যারিসে আত্মঘাতী হামলা: ২০১৫ সালের ১৩ নভেম্বর সন্ধ্যায় ফ্রান্সের প্যারিস ও সেন্ট-ডেনিসে ধারাবাহিক ও সমন্বিত সন্ত্রাসী আক্রমণ হয়। ফ্রান্সের বাইরে তিনটি আলাদা আত্মঘাতী বোমা হামলা এবং প্যারিসের কাছাকাছি চারটি ভিন্ন স্থানে গণহত্যা ও আত্মঘাতী বোমা হামলা চালায় সন্ত্রাসীরা। এ হামলায় অন্তত ১২৮ জন নিহত হন। আহত ৪১৫ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এতে সাত আক্রমণকারীও মারা যায়।
> আরও পড়ুন- কী ঘটেছিল সেই ভয়াল ২৯ এপ্রিলে
আতাতুর্ক বিমানবন্দরে হামলা: ২০১৬ সালের ২৮ জুন গুলি আর বোমা বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে ইস্তাম্বুলের আতাতুর্ক বিমানবন্দর। এ হামলায় নিহত হন ৪৭ জন এবং আহত হন ২৩৯ জন। প্রথম বিস্ফোরণ ঘটে আন্তর্জাতিক টার্মিনালের এক তলায়, দ্বিতীয়টি দোতলায় এবং তৃতীয়টি গাড়ি পার্কিংয়ে। পুলিশ পাল্টা আক্রমণ করার কিছু সময়ের মধ্যেই প্রথম আত্মঘাতী বিস্ফোরণ ঘটায় জঙ্গিরা।
অরল্যান্ডোয় বন্দুকধারীর হামলা: যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের অরল্যান্ডো শহরের বিনোদন কেন্দ্র পালস ক্লাবে ২০১৬ সালে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটে। ১২ জুন অরল্যান্ডো শহরে সমকামীদের একটি নাইট ক্লাবে এ গোলাগুলি হয়। এতে ৫০ জন নিহত ও ৫৩ জন আহত হন। স্থানীয় সময় দিবাগত রাতে এ হামলা হয়। হামলার তিন ঘণ্টা পর পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে হামলাকারীকে হত্যা করে। হামলাকারীর নাম ওমর মতিন।
ঢাকার হলি আর্টিজান হামলা: বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার অভিজাত গুলশান এলাকায় হলি আর্টিজান বেকারিতে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটে ২০১৬ সালের ১ জুলাই। বিশ্বব্যাপী আলোড়ন তৈরি করা ঘটনায় জঙ্গিরা সেই রাতে ২০ জনকে হত্যা করে। যাদের ৯ জন ইতালি, ৭ জন জাপান, ৩ জন বাংলাদেশি এবং ১ জন ভারতীয় নাগরিক। এছাড়া সন্ত্রাসীদের হামলায় দুজন পুলিশও প্রাণ হারান। পরে সেনাবাহিনীর কমান্ডো অভিযানে হামলাকারী ৫ জনও প্রাণ হারায়।
ফ্রান্সের নিসে সন্ত্রাসী হামলা: ২০১৬ সালের ১৪ জুলাই ফ্রান্সের দক্ষিণাঞ্চলীয় নিস শহরে সন্ত্রাসী হামলায় ৮০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হন। জনতার ওপর দ্রুতগতিতে ট্রাক ও গুলি চালিয়ে এই হতাহতের ঘটনা ঘটানো হয়। বাস্তিল দিবস উদযাপন করতে দেশি-বিদেশি পর্যটকসহ বহু লোক ওই সময় সেখানে জড়ো হয়েছিলেন। স্থানীয় সময় রাত ১১টার দিকে ভিড়ের মধ্যদিয়ে ২৫ টনের ওই ট্রাক প্রায় দুই কিলোমিটার রাস্তা এগিয়ে যায়। পরে পুলিশ চালককে গুলি করে হত্যা করে ট্রাকটি থামায়।
জার্মানিতে ট্রেনে হামলা: ২০১৬ সালের ১৯ জুলাই দক্ষিণ জার্মানির একটি ট্রেনে হামলার ঘটনা ঘটে। আফগান এক কিশোর এ হামলা চালিয়েছে বলে জানা যায়। কুড়াল ও ছুরি দিয়ে আক্রমণ চালিয়ে ৪ জনকে আহত করে সে। পরে পালিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশের গুলিতে যুবক নিহত হয়। আক্রমণকারী ১৭ বছরের এক আফগান শরণার্থী। অক্সিফোর্ট শহরের কাছে সে বসবাস করত।
> আরও পড়ুন- কোন সংস্থার সদর দফতর কোথায়?
রোহিঙ্গাদের ওপর হামলা: ২০১৬ সালের শেষ দিকে মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলীয় রাখাইন রাজ্যে সে দেশের সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর হামলা চালায়। সে বছর ৯ অক্টোবর মিয়ানমারের মংডুর একাধিক সীমান্তচৌকিতে হামলার জের ধরে সেনাবাহিনী এ হামলা চালায়। সামরিক বাহিনী রাখাইন রাজ্য ঘিরে ফেলে অভিযানের নামে ব্যাপক হারে হত্যা, লুট, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটায়।
ম্যানচেস্টার শহরে হামলা: ২০১৭ সালের ১৭ মে যুক্তরাষ্ট্রের পপতারকা আরিয়ানা গ্রান্দের কনসার্ট হয় যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার শহরে। কনসার্ট শেষে দর্শকরা বের হওয়ার পথে হঠাৎ বিকট শব্দে মুহূর্তেই ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় সবকিছু। আত্মঘাতী বোমার বিস্ফোরণে কমপক্ষে ২২ জন নিহত ও ৫৯ জন আহত হন।
ব্রাজিলের স্কুলে হামলা: ব্রাজিলের দক্ষিণাঞ্চলের একটি স্কুলে ২০১৯ সালের ১৩ মার্চ গোলাগুলির ঘটনায় শিক্ষার্থীসহ ৮ জন নিহত হয়েছে। মাস্ক পরিহিত দুই হামলাকারী বন্দুক নিয়ে এলোপাতাড়ি গুলি চালায়। তবে বন্দুকধারীরা হামলা চালানোর পর নিজেরাও আত্মহত্যা করেছে।
নিউজিল্যান্ডে মসজিদে হামলা: ২০১৯ সালের ১৫ মার্চ নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে দুটি কেন্দ্রীয় মসজিদে বন্দুকধারীদের হামলায় নিহত হয়েছেন প্রায় অর্ধশতাধিক। এ ঘটনায় একজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তবে পুলিশ বলছে, এ হামলার পেছনে আরও অপরাধীরা জড়িত থাকতে পারে।
এসইউ/এমএস