বিশেষ প্রতিবেদন

২৫% কাজ বাকি রেখেই বন্ধ হচ্ছে হাওরের বন্যা প্রতিরোধ প্রকল্প

>> ‘আগাম বন্যা প্রতিরোধ ও নিষ্কাশন’ প্রকল্পের অনুমোদন ২০১১ সালে>> দুবার মেয়াদ বাড়ানো হলেও শেষ হয়নি মূল প্রকল্পের কাজ>> আইএমইডি বলছে, প্রকল্পের বাস্তবায়ন অগ্রগতি ৬২.৪০ শতাংশ>> হাওর অঞ্চল এখনও ব্যানপ্রবণ : ড. খান মো. হাসানুজ্জামান

Advertisement

সুনামগঞ্জে ২০০৪ ও ২০১০ সালের বন্যায় হাওর অঞ্চলে বোরো ফসলের ক্ষতি হয় ব্যাপক। ২০১০ সালের নভেম্বরে সুনামগঞ্জের তাহিরপুর সফরে আসেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেখানে সুরমা-বৌলাই নদী সিস্টেম খননকাজ বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতির পরিপ্রেক্ষিতে ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং (আইডব্লিউএম) এবং সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (সিইজিআইএস) যৌথ সমীক্ষার আলোকে ‘হাওর এলাকায় আগাম বন্যা প্রতিরোধ ও নিষ্কাশন উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পটি গৃহীত হয়। ২০১১ সালের ১২ এপ্রিল জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় প্রকল্পটি অনুমোদন পায়।

আরও পড়ুন >> সুনামগঞ্জে নির্ধারিত সময়ে শেষ হয়নি ফসলরক্ষা বাঁধের কাজ

Advertisement

২০১৮ সালেও সিলেট বিভাগে ব্যাপক বন্যা হয়। অথচ আগাম বন্যা প্রতিরোধ ও নিষ্কাশনের ওই প্রকল্পের কাজ ২৫ শতাংশ বাকি রেখেই বন্ধ করে দেয়া হবে বলে জাগো নিউজকে জানান প্রকল্প পরিচালক সিলেটের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. নিজামুল হক ভূঁইয়া।

অথচ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সিলেট বিভাগ এখনও বন্যাপ্রবণ। এখনও বন্যায় এ অঞ্চলে অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এমন কোনো কাজ হয়নি যার জন্য বলা যায়, হাওর অঞ্চল বন্যা থেকে নিরাপদ।

এছাড়া দুবার প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হলেও শেষ হয়নি এ প্রকল্পের কাজ। মূল প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় ছিল ২০১১ সালের জুলাই থেকে ২০১৫ সালের জুনের মধ্যে। এরপর প্রকল্পের সময় এক বছর বাড়িয়ে করা হয় ২০১৬ সালের জুন পর্যন্ত। তারপরও কাজ বাস্তবায়ন সম্ভব না হলে ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়। অথচ এখন প্রকল্প পরিচালক বলছেন, ৭৫ শতাংশ কাজ করে প্রকল্পের কাজই বন্ধ করে দেবেন।

আরও পড়ুন >> হাওর বাঁধ যেন লুটপাটের নতুন ক্ষেত্র

Advertisement

এ বিষয়ে প্রকৌশলী মো. নিজামুল হক জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের ৬৭-৬৮ শতাংশ কাজের অগ্রগতি হয়ে গেছে, ৭৫ শতাংশের কাজের অগ্রগতি হলে কমপ্লিট করে দেব (শেষ করে দেয়া হবে)। আর কাজ লাগবে না।’

প্রকল্প কাজের অগ্রগতি ৬৭-৬৮ শতাংশ- প্রকল্প পরিচালক এমন দাবি করলেও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরীবিক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) ফেব্রুয়ারির প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত প্রকল্পের বাস্তবায়ন অগ্রগতি ৬২ দশমিক ৪০ শতাংশ।

আইএমইডি বলছে, প্রকল্পটি নির্ধারিত সময় শেষ করতে আগামী পাঁচ মাসে ৩৭ দশমিক ৬০ শতাংশ কাজ শেষ করতে হবে। যেখানে ৯১ মাসে শেষ হয়েছে মাত্র ৬২ শতাংশ কাজ।

তবে সিলেটের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. নিজামুল হক ভূঁইয়ার দাবি, ‘৭৫ শতাংশ কাজ হলেই এ প্রকল্পের উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন হবে।’

তার বক্তব্য, ‘প্রকল্পের অর্থও পুরোটা খরচ হয়নি। যতটুকু কাজ হয়েছে, ততটুকু অর্থ খরচ হয়েছে। ৭৫ শতাংশ কাজ হলে তাতে আমাদের ফিজিক্যাল ওয়ার্ক হয়ে যাবে, আর অর্থের দরকার হবে না।’

আরও পড়ুন >> ধানে সর্বনাশ, অপেক্ষা নেত্রীর

প্রকল্পটি হাওর অঞ্চলের বন্যার সঙ্গে সম্পর্কিত না বলেও দাবি করেন প্রকল্প পরিচালক। এ বিষয়ে নিজামুল হক ভূঁইয়ার বক্তব্য, ‘এটা বন্যার সঙ্গে রিলেটেড (সম্পর্কিত) নয়। এটা আলাদা একটা প্রকল্প, ইনফ্রাস্ট্রাকচার (অবকাঠামো) নির্মাণ আর কী… নদী খনন, অন্যান্য জিনিস আর কী…। এর আওতায় যে বাঁধ নির্মাণের কথা ছিল, সেটা দুই বছর আগেই হয়ে গেছে। এবারের বন্যায় কোনো অসুবিধা হবে না।’

প্রকল্পের মূল প্রতিবন্ধকতা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘অনেক দিন ধরে চলছে তো, সেই ২০১২ সাল থেকে। হাওরে কাজ করতে হয়, ছয় জেলায়। প্রথমদিকে প্রকল্পের কাজ শুরু করতে দেরি হয়েছে। হাওরে কাজ করার জন্য কম সময় পাওয়া যায়, দুই থেকে তিন মাস। এজন্য একটু সমস্যা হয়েছে।’

পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, সিলেট বিভাগের ছয় জেলার ২৯ উপজেলা এ প্রকল্পের আওতাভুক্ত। এর মধ্যে মোট হাওরের সংখ্যা ৫২টি। প্রকল্পের উদ্দেশ্য হলো, হাওর এলাকায় আগাম বন্যা থেকে বোরো ফসল রক্ষা করা, এ এলাকার প্রধান নদীগুলোর নিষ্কাশন ও পরিবহন ক্ষমতা বাড়ানো, অভ্যন্তরীণ খালগুলোর নিষ্কাশন ক্ষমতা বাড়ানো এবং দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নদীগুলোর নাব্যতা বাড়ানো।

আরও পড়ুন >> সোনার ধানে সোনা রঙ নেই

৭৫ শতাংশ কাজ শেষ করে প্রকল্প বন্ধ করে দেয়ার বিষয়ে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক ড. খান মো. হাসানুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, ‘কোনো প্রকল্পের ৭৫ বা ৮০ শতাংশ কাজ হলে মূল উদ্দেশ্যের অনেকগুলোই সফল হতে পারে, এটা সেখানকার বাস্তবতার ওপর নির্ভর করে। ২০ শতাংশ কাজ হয়তো এমন থাকে, যে কাজগুলো বন্যা প্রতিরোধে সরাসরি যুক্ত নয়, কিন্তু সেখানকার পরিবেশ উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন। তবে যারা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে এবং যারা তদারকি করছে, তারা যদি একমত হন, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ।’

হাওর অঞ্চল এখনও ব্যানপ্রবণ বলেও মনে করেন তিনি। হাসানুজ্জামান বলেন, ‘সিলেট বিভাগে বন্যা তো হয়-ই। কোনো সংবাদ বা নানাভাবে আমরা যে খবর পাই, তাতে হাওর অঞ্চলে বন্যা প্রতিরোধ হয়েছে- এমন কোনো নিশ্চয়তা বা সেই লক্ষ্যে কোনো জোরালো কাজ যে হয়েছে- এমন কোনো তথ্য আমাদের কাছে নেই। আমরা এখনও মনে করি, হাওর এলাকা বন্যাপ্রবণ। সেখানে এখনও অনেক কিছু করার আছে।’

আরও পড়ুন >> ‘ভিক্ষা নয়, হাওরবাসীকে ঋণ দিন’

তিনি বলেন, ‘ওটা নিরাপদ- এমন তথ্যও আমাদের কাছে নেই। আমরা এখনও দেখি, ক্ষয়ক্ষতি হয়। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় বা যেই হোক, তারা যে এমন কোনো মেজর কাজ করেছে… এবং তারা বলছে যে, এতদিন যে বন্যা হতো, এখন হবে না- এমন কোনো তথ্য ওইভাবে কিন্তু আমাদের কাছে নেই।’

পিডি/এমএআর/পিআর