স্বাস্থ্য

উৎসাহিত করতে হবে মৃত ব্যক্তির অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দানে

>> দেশে কিডনি রোগীর সংখ্যা দুই কোটি>> উন্নত দেশে ৭০-৮০ ভাগ কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট হয়>> তিনটি রোগের কারণে কিডনি বিকল হয়

Advertisement

রাজধানীর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরো সায়েন্স হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (আইসিইউ) লাইফ সাপোর্টে থাকা এক রোগীকে সম্প্রতি চিকিৎসকরা ব্রেনডেথ বা চিরতরে মস্তিষ্ক অচল হয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন।

রোগীর শারীরিক অবস্থা ক্রমানবতি দেখে চিকিৎসকরা তার স্বজনদের সঙ্গে মৃত ব্যক্তির অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দানের ব্যাপারে প্রাথমিক কথাবার্তা বললে তারা রাজি হন। কিন্তু স্বজনরা শেষ মুহূর্তে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কিছুতেই দান করবেন না বলে জানিয়ে দেন। ফলে সব আয়োজন থাকলেও মৃত ব্যক্তির কিডনি সংযোজনের নতুন ইতিহাস রচনা থেকে বঞ্চিত হন চিকিৎসকরা।

বাংলাদেশে ওই সময় অবস্থান করছিল মৃতব্যক্তির কিডনি সংযোজনে অভিজ্ঞ কোরিয়ান ট্রান্সপ্লান্ট টিম। বাংলাদেশ কিডনি ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি প্রখ্যাত কিডনি রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. হারুন আর রশীদ বিশ্ব কিডনি দিবসের প্রাক্কালে জাগো নিউজের সঙ্গে আলাপকালে এ অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন।

Advertisement

তিনি বলেন, দেশের কিডনি রোগ ক্রমেই ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে। বর্তমানে দেশে আনুমানিক দুই কোটি কিডনি রোগী রয়েছে। আক্রান্ত এসব রোগীর মধ্যে প্রতি বছর গড়ে ৩৫-৪০ হাজার রোগীর দুটো কিডনি বিকল হয়।

সম্পূর্ণরূপে কিডনি বিকল রোগীদের নিয়মিত ডায়ালাইসিস অথবা কিডনি প্রতিস্থাপন করে বেঁচে থাকতে হয়। এ দুই ধরনের চিকিৎসাই ব্যয়বহুল হওয়ায় শতকরা ৮০-৯০ ভাগ রোগী চিকিৎসা শুরু করলেও অর্থাভাবে মাঝপথে চিকিৎসা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন- যোগ করেন ডা. হারুন।

‘দেশের বিপুল সংখ্যক কিডনি রোগীর সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অপ্রতুলতা ও পর্যাপ্ত ডায়ালাইসিস সেন্টার না থাকা এবং কিডনি প্রতিস্থাপনে ডোনারের অভাবে অধিকাংশ কিডনি বিকল রোগী বিনা চিকিৎসায় ধুঁকে ধুঁকে মারা যান।’

ব্রেনডেথ বা মৃতঘোষিত ব্যক্তির কাছ থেকে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পাওয়া গেলে শুধু দুই কিডনি নয়, একাধিক রোগীকে হার্ট, লিভার ও ফুসফুস প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে বাঁচিয়ে তোলা সম্ভব বলে জানান তিনি।

Advertisement

তিনি আরও জানান, উন্নত অনেক দেশে ক্যাডাভারিক বা মরণোত্তর কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট প্রক্রিয়ায় বা মৃত ব্যক্তির দেহ থেকে কিডনি নিয়ে ৭০-৮০ ভাগ কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট হয়। অথচ বাংলাদেশের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আইনে এতে কোনো বাধা না থাকলেও এত বছরেও তা সম্ভব হয়নি। দেশের লাখ লাখ কিডনি বিকল রোগীর প্রাণরক্ষার্থে প্রকারান্তরে নতুন জীবন ফিরিয়ে দিতে মৃত ব্যক্তির কিডনি দানে দেশব্যাপী ব্যাপক গণসচেতনতা তৈরি করতে হবে। কিডনি রোগীর সঠিক পরিসংখ্যানে হালনাগাদ কোনো পরিসংখ্যান আছে কিনা- জানতে চাইলে ডা. হারুন বলেন, কিডনি রোগীর সঠিক সংখ্যা নির্ণয়ে ২০১০ সালে পাঁচ হাজার লোকের ওপর গবেষণা হয়েছিল। এরপর আর কোনো গবেষণা হয়নি। ওই পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশে দুই কোটি কিডনি রোগী রয়েছে। এ সংখ্যা আরও বেড়েছে বলে তার ধারণা। তিনি জানান, সম্প্রতি পাঁচ হাজার মানুষের ওপর সিলেট, কুমিল্লা ও পাবনায় নতুন করে গবেষণা চলছে। ছয় মাস থেকে এক বছরের মধ্যে তা প্রকাশ করা হবে।

ডা. হারুন জানান, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও নেফ্রাইটিস (শরীর ফুলে যাওয়া ও কিডনির প্রদাহ) এ তিনটি রোগে মানুষের কিডনি বিকল হয়। এর মধ্যে ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপের সঙ্গে কিডনি রোগের সরাসরি সম্পর্ক। তিনি জানান, বাংলাদেশে ডায়াবেটিস রোগীদের ৪০ ভাগ আক্রান্ত হচ্ছে কিডনি রোগে। নীরব ঘাতক এ ডায়াবেটিস কোনো উপসর্গ ছাড়াই কিডনির ক্ষতি করছে। অনেকের কিডনি সম্পূর্ণ বিকল হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশে ব্যাপক হারে বাড়ছে কিডনি রোগী। উন্নত বিশ্ব ও পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে কিডনি রোগের উন্নতমানের চিকিৎসা ব্যবস্থা চালু থাকলেও আমরা অনেক পিছিয়ে আছি।

অধ্যাপক ডা. হারুন বলেন, বাংলাদেশে এক লাখ ২৫ হাজার কিডনি রোগীর জন্য একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রয়েছেন। সারাদেশে কিডনি ডায়ালাইসিস মেশিন রয়েছে এমন হাসপাতালের সংখ্যা মাত্র দেড়শর মতো। কিডনি বিকল রোগীভেদে প্রতি সপ্তাহে দুই থেকে তিনবার ডায়ালাইসিস করতে হয়। প্রতিবার ডায়ালাইসিস করতে সর্বনিম্ন দুই থেকে সাত হাজার টাকা খরচ হয়। ‘স্বাস্থ্যকর অভ্যাস গড়া, পুষ্টিকর ও সুষম খাবার পরিমিত গ্রহণ, নিয়মিত কায়িক পরিশ্রম করলে সুস্থ থাকা যায়। এজন্য সরকার ও সংশ্লিষ্ট সব মহলকে একযোগে কাজ করতে হবে। এতে রোগব্যাধি হ্রাস পাবে, মানুষ সুস্থ থাকবে।’

এছাড়া দেশে কিডনি রোগীর সংখ্যা কমিয়ে আনতে আগাম প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা দরকার। এক্ষেত্রে সারাদেশের ১৫ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক ভূমিকা রাখতে পারে। তৃণমূলে প্রতি ছয়হাজার জনগোষ্ঠীর জন্য একটি কমিউনিটি ক্লিনিকে প্রতিদিন শত শত মানুষ চিকিৎসা নিতে আসেন। সরকার চাইলে কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে কোনো রোগীর ডায়াবেটিস আছে কিনা- তা জানতে রক্ত পরীক্ষা করে দেখতে পারে।

কিডনি বিকল হওয়ার চেয়ে আগাম প্রতিরোধ উত্তম বলে মন্তব্য করেন তিনি।

এমইউ/জেএইচ/এমএআর/পিআর