দেশজুড়ে

শিশু হৃদরোগ চিকিৎসার পথিকৃৎ বিগ্রেডিয়ার ফাতেমা

এ বছর দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা ‘স্বাধীনতা পদক’ পাচ্ছেন সিলেটের কৃতী সন্তান শিশু হৃদরোগ চিকিৎসার পথিকৃৎ বিগ্রেডিয়ার জেনারেল নুরুন্নাহার ফাতেমা বেগম। তিনি দীর্ঘদিন ধরে অসহায়-দরিদ্র রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা দিয়ে অনন্য নজির স্থাপন করেছেন।

Advertisement

বিগ্রেডিয়ার ফাতেমা ১৯৬২ সালে সিলেটের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা মরহুম এমএ ওয়াদুদ ছিলেন শুল্ক বিভাগের কর্মকর্তা এবং মা মরহুমা ময়মুন্নেছা খাতুন ছিলেন একজন গৃহিণী। সিলেট নগরীর কিশোরী মোহন বালিকা বিদ্যালয় থেকে শিক্ষাজীবন শুরু করেন বিগ্রেডিয়ার ফাতেমা। ১৯৭৭ সালে এসএসসি, ১৯৭৯ সালে সিলেট এমসি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়ে ১৯৮৫ সালে মেধা তালিকায় ২য় স্থান অর্জন করে এমবিবিএস পাস করেন। এরপর ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন।

এরপর বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়ানস্ অ্যান্ড সার্জনস থেকে শিশুরোগের ওপর এফসিপিএস ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৯৭ ও ৯৮ সালে সৌদি আরবের কিং সুলতান হাসপাতালে বিভিন্ন বিদেশি চিকিৎসকগণের সংস্পর্শে তিনি শিশু হৃদরোগ চিকিৎসায় বিশেষ পারদর্শিতা অর্জন করে দেশে ফিরে আসেন। ১৯৯৮ সালে ঢাকা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচএ) প্রতিষ্ঠা করেন শিশু হৃদরোগ বিভাগ। যা বাংলাদেশের প্রথম শিশু হৃদরোগ চিকিৎসা কেন্দ্র।

শিশু হৃদরোগ চিকিৎসার দিগন্ত উম্মোচনের জন্য তাকে বাংলাদেশে ‘মাদার অব পেডিয়ার্ট্রিক কার্ডিওলজি’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। তিনি বাংলাদেশে শিশু চিকিৎসার আরেক দিকপাল মরহুম অধ্যাপক এম.আর খানের সঙ্গে প্রতিষ্ঠা করেন চাইল্ড হার্ট ট্রাস্ট বাংলাদেশ। জটিল হৃদরোগে আক্রান্ত গরিব ও প্রান্তিক শিশুদের বিনামূল্যে চিকিৎসা প্রদানের মাধ্যমে অসংখ্য শিশুর রোগ নিরাময় করে তাদের জীবনকে অর্থবহ করে তুলতে নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছে এই ট্রাস্ট।

Advertisement

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গ নিয়ে ২০০৭ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ‘ওয়াদুদ ময়মুন্নেছা ফাউন্ডেশন’। মরহুম মা-বাবার নামে প্রতিষ্ঠিত এই ফাউন্ডেশন নিজ উপজেলার বড়লেখার বর্ণী ইউনিয়নের পাকশাইল গ্রামে ফ্রি ফাইডে ক্লিনিক, ফ্রি খৎনা প্রদান ও ফ্রি হৃদরোগ শনাক্তকরণের মত সেবা প্রদান করে আসছে। প্রতি মাসে এই ফাউন্ডেশন থেকে ৩শ থেকে ৪শ জন দুস্থ রোগীকে বিনামূল্যে চিকিৎসা পরামর্শ ও সেবা প্রদান করা হয়। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন শ্রেণিপেশার রোগীর চিকিৎসায় নিয়মিত অনুদান প্রদান করে আসছে এই সংগঠন।

ব্যক্তি জীবনে নিজেকে রত্নাগর্ভা মা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন এই খ্যাতিমান চিকিৎসক। তার দুই মেয়ের মধ্যে মার্জিয়া তাবাসসুম এএনজি ব্যাংকে কর্মরত রয়েছেন। আর ছোট মেয়ে মার্শিয়াত মাইশা আহমদ ফার্মাকোলজিতে স্নাতক সম্পন্ন করে বর্তমানে যুক্তরাজ্যে চিকিৎসা শাস্ত্রে অধ্যায়নরত। তার স্বামী সেনা চিকিৎসা মহাপরিদফরের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কর্নেল আজহার উদ্দিনও পেশায় চিকিৎসক।

বিগ্রেডিয়ার নুরুন্নাহার ফাতেমা বেগম সাত ভাইবোনের মধ্যে ষষ্ট। তার বড়বোন কুলাউড়া ডিগ্রি কলেজের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন প্রধান অধ্যাপিকা ফরিদা বেগম, দ্বিতীয় ভাই সিলেটের সুনামধন্য ব্যবসায়ী এ.কে.এম ফারুক, তৃতীয় ভাই অধ্যাপক ডা. একেএম রাজ্জাক আবাসিক সার্জারির প্রথিতযশা সার্জন। আরেক ভাই সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সিনিয়র আইনজীবী ও কোম্পানি আইন বিশেষজ্ঞ অ্যাডভোকেট এ.কে.এম বদরুদ্দোজা। তার বড় আরেক বোন ফৌজিয়া মাহমুদ সিলেট খাজাঞ্চীবাড়ী ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিকা। ছোট বোন শামসুন্নাহার ফাহমিদা ঢাকার নবাবপুর স্কুলের সিনিয়র শিক্ষিকা।

বিগ্রেডিয়ার ফাতেমা মধ্যপ্রাচ্যে ও যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশের দাতা সংস্থার সঙ্গে যৌথ কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে প্রতি বছর প্রায় দুই শতাধিক গরীব হৃদরোগ আক্রান্ত শিশুদের বিনামূল্যে চিকিৎসা প্রদান করে আসছেন। ২০১২ সালের ২৫ ডিসেম্বর তিনি দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথমবারের মতো পালমোনারি বাল্ব প্রতিস্থাপন করেন। যা এদেশের এবং দক্ষিণ এশিয়ায় শিশু হৃদরোগের চিকিৎসার অনন্য নজির স্থাপন করেছে।

Advertisement

স্বাধীনতা পদকে ভূষিত হওয়ায় এক প্রতিক্রিয়ায় বিগ্রেডিয়ার জেনারেল নুরুন্নাহার ফাতেমা বেগম বলেন, এ সম্মাননার মাধ্যমে আমার দায়িত্ব আরও বেড়ে গেল। বাকি জীবন যেন মানুষের সেবায় কাটিয়ে দিতে পারি।

ছামির মাহমুদ/আরএআর/এমকেএইচ