জাগো জবস

স্কীল ডেভেলপমেন্ট বাণিজ্য কি প্রতারণা নয়?

‘স্কীল ডেভেলপমেন্ট’ অর্থাৎ দক্ষতা উন্নয়ন বিষয়ক কর্মশালাগুলো যেন বাণিজ্যে রূপ নিয়েছে। ফলে এ ধরনের কার্যক্রমও পেশাদারিত্বের পর্যায়ে চলে গেছে। তবে কেউ কেউ একে বলছেন একধরনের প্রতারণা। বিস্তারিত লিখেছেন স ম মনজুরুল ইসলাম- ইদানিং চাকরিপ্রার্থীদের স্কীল ডেভেলপমেন্ট, সিভি রাইটিং, নেটওয়ার্কিংয়ের নামে কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে কাজ করছে। শুনেছি তারা না-কি চাকরি দেওয়ার আভাস দিয়ে পরোক্ষ প্রচারণাও চালায়। তারা শিক্ষিত বেকারের পেটের ক্ষুধা মেটানোর শেষ সম্বলটুকু হাতিয়ে নেওয়ার বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে কি-না তা আমি নিশ্চিত নই। সপ্তাহে দু’একটি লেকচার শুনিয়ে কিভাবে স্কীল ডেভেলপমেন্ট হবে জানি না। কাজ না করিয়ে স্কীল ডেভেলপমেন্ট বা অন্যের লেখা সিভি কিভাবে নিজের যোগ্যতার প্রমাণ বহন করে, তা আমার কাছে বড্ড হাস্যকর।

Advertisement

কোচিং সেন্টারের মত করে কর্পোরেট অফিসিয়ালের লেকচার শুনে চাকরিপ্রার্থীর স্কীল ডেভেলপমেন্ট কিভাবে সম্ভব? কর্পোরেট জায়ান্টের লেকচার শুনলে না-কি চাকরি হবে! অবিশ্বাস্য, অসম্ভব। বিশ্ববিদ্যালয় লেভেল পর্যন্ত হাজার হাজার লেকচার শুনেও যার নাকি স্কীল ডেভেলপমেন্ট হয়নি, তিনি এসব ব্যক্তিখাতের প্রতিষ্ঠানে কোর্স করলে বা তার সিভিটা অন্যের হাতে লিখিয়ে নিলে কিভাবে তার যোগ্যতা বেড়ে যাবে, তা আমার মাথায় আসে না।

> আরও পড়ুন- বিনামূল্যে তথ্যপ্রযুক্তিতে প্রশিক্ষণ নিতে চাইলে 

কয়েক বছর আগে থেকে এদেশে ব্যক্তিগত উদ্যোগে হেডহান্টিংয়ের নামে কিছু প্রতিষ্ঠান চাকুরেদের কেনাবেচা করে আসছে। তারা বিভিন্ন কোম্পানির চাহিদামত দক্ষ জনবলকে রিক্রুট করে দিত। সেগুলো ছিল দক্ষ জনশক্তি বেচাকেনার হাট। আজ দেখছি শিক্ষিত বেকারদের চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে দক্ষতা বাড়ানোর ব্যানার; যা ডিজিটাল বাণিজ্যের ধান্দাবাজি ছাড়া কিছুই নয়।

Advertisement

কোচিং করিয়ে দক্ষতা বাড়ানোর নামে চাটুকদার কথামালা শুনে অবাক হয়েছি। যেখানে দশটি শূন্যপদের বিজ্ঞাপন দেখে দশ হাজারেরও বেশি আবেদন জমা হয়, সেখানে চাকরির বাজার কতটা ভয়াবহ তা কি চিন্তা করা যায়? লাখ লাখ বেকারের দেশে বাণিজ্যটা জমবে ভালো, কিন্তু কাহাতক?

বেকারদের চাকরি পাওয়ার উপযোগী করে গড়ে তোলা শুনতে তো ভালোই লাগে; কিন্তু বাস্তবে? কে কোন সেক্টরে চাকরি পাবে তা তো অজানা। চাকরি পাওয়ার পর কর্মক্ষেত্রে কাজের ধরন অনুযায়ী নতুন চাকুরেদের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান অন জব ট্রেনিং করিয়ে নেয়; কাজের উপযোগী করে হাতেকলমে। সেটা কর্পোরেট হাউসগুলোর যুগোপযোগী মানবসম্পদ উন্নয়ন কৌশল। সে কাজটি চাকরি পাওয়ার আগে কিভাবে করবে বলুন? বেকার তরুণদের চাকরি পাওয়ার কৌশল নিয়ে যতরকম নতুন এসব বাণিজ্যচিন্তা অযৌক্তিক নয় কি?

> আরও পড়ুন- ২৮ বছর বয়সেই সফল উদ্যোক্তা মুন্না  যেখানে কর্মসংস্থানের নতুন সুযোগ সৃষ্টিতে নানাপ্রকার জটিলতা, সেখানে বিকল্প আত্ম কর্মসংস্থানের উপায় বাতলে দেওয়া যৌক্তিক হতে পারে। ট্রাডিশনাল মার্কেটিং প্রাক্টিসের স্থানে ডিজিটাল মার্কেটিং হাতেকলমে শেখানোর কোর্স চালু করাও একটি কার্যকরী উদ্যোগ হতে পারে। বিদেশি পণ্যের পরিবর্তে সমজাতীয় দেশীয় পণ্য উৎপাদন ও বিপণনে উদ্বুদ্ধকরণ কি কম জরুরি কাজ? সেবাধর্মী কতশত সেক্টর তৈরি করার সুযোগ এখনো এদেশে অফুরন্ত। সম্ভবনাময়ী শিক্ষিত বেকারদের নতুন নতুন পথ বাতলে না দিয়ে তাদের অসহায়ত্বকে পুঁজি করে বাণিজ্য আমার বিবেককে কষ্ট দেয়।

১৯৮৮-৮৯ সালে ঢাকায় দু’একটি প্রতিষ্ঠান ছিল যাদের কাছে ১ হাজার টাকা দিয়ে আসলে ২ হাজার টাকার টিউশনি দিত। অর্থাৎ টিউশনি পাওয়ার আগে মাসের অর্ধেক বেতন অগ্রিম দালালের হাতে গুঁজে দেওয়া।

Advertisement

এসব কাজে দামিদামি নির্বাহীবৃন্দ নিজেদের পরিচিতি আরও বাড়াতে ডায়াসে দাঁড়িয়ে বক্তব্য দিচ্ছেন। তাদের দেখে বেকার ছেলেমেয়েরা ক্ষেত্রবিশেষে ২-৩ হাজার টাকা দিয়ে একবেলা বিরিয়ানি ভোজ করে আশ্বস্ত হচ্ছে। কখনো বা দু’চারটি কোম্পানি সেখানে বসে কিছু বেকারের বায়োডাটা নিচ্ছে। এতে হয়তো প্রতিষ্ঠানগুলো দেখাতে সক্ষম হচ্ছে, দেখো বেকারসকল, আমরা কত বড় ‘ক’।

কেউ কেউ সিভি লিখে দিয়ে টাকার ধান্দা করছেন। বলছেন, আমার থেকে সিভি লিখিয়ে নিয়ে ‘ওমুক ওমুক সাহেব’ চাকরি পেয়েছেন।

> আরও পড়ুন- কোথায় আইইএলটিএস করবেন 

আজও মনে পড়ে, শিক্ষাজীবন শেষে চাকরির ব্যাংক ড্রাফটের দুশ’ টাকা কতটা কষ্টের ছিল। গরিব বাবা-মায়ের বেকার সন্তানদের টাকায় দামি কোট-প্যান্ট পরে কর্পোরেট হাউসগুলো আকৃষ্ট করার ধান্দা বিবেকহীন কাজ বলে মনে হয়।

নামিদামি কর্পোরেট ব্যক্তিত্বের বডি দেখিয়ে, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের উপস্থিতিতে শিক্ষিত বেকারদের চটকদার চাকরির প্রলোভনে টাকা উপার্জনের হীন মানসিকতা নিন্দনীয়।

এ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ফাইনাল পরীক্ষা শেষে ইন্টার্নশীপ জমা দেওয়ার বিশেষ প্রথা চালু আছে। এর দ্বারা একাডেমিক ও প্রায়োগিক শিক্ষার সমন্বয় করার কথা। সেক্ষেত্রে নানাবিধ জটিলতা আর প্রায়োগিক ক্ষেত্রে দৃশ্যমান ত্রুটির কারণে ছাত্রছাত্রীদের কনফিডেন্স সৃষ্টিতে বাধাগ্রস্ত করছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে কর্পোরেট হাউসগুলোর আইনগত দায়বদ্ধতার অভাব এরজন্য দায়ি।

শিক্ষিত বেকার চাকরিপ্রার্থীগণ বিশ্বাস করছে, একাডেমিক শিক্ষার শেষে আর চাকরির আগে হয়ত বিশেষ কোন দক্ষতার কথা এখানে আলোচিত প্লাটফর্ম কভার করছে। সে ধারণা ভুল। মনে রাখা দরকার, নিয়োগ কমিটি ছাড়া কোন একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এককভাবে চাকরি দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন না। বড় বড় কর্মকর্তাগণ কোন বিশেষ নেটওয়ার্ক বা সুবিধাভোগী হয়ে কোথাও উপস্থিত হন কি-না তা আমরা কেউ-ই জানি না।

> আরও পড়ুন- বায়োডাটায় যে তথ্যগুলো উল্লেখ করবেন না 

বহুজাতিক বা নামিদামি দেশীয় বড় বড় কোম্পানি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত জব ফেয়ারে অংশ নেয়। কখনো কখনো তারা রিক্রুটমেন্ট এক্সপার্ট প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় জনবল নিয়োগও করে থাকে। তারা কখনো নিয়োগ নিয়ে বাণিজ্য করে না।

কর্পোরেট হাউসগুলোর ইনহাউস বা থার্ড পার্টি ট্রেনিং একটি চমৎকার উদ্যোগ, সমর্থন করি। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষিত ছেলেমেয়েদের সাক্ষাৎকার কৌশল শেখানো বা তাদের হতাশা কাটাতে মোটিভেশনাল সেমিনার জরুরি। কিন্তু তাদের সরলতার সুযোগে পয়সা কামানোর বাণিজ্য কোন অবস্থাতেই সমর্থনযোগ্য নয়। আসুন, সবাই এমন নিন্দনীয় কাজ থেকে বিরত থাকি।

এসইউ/এমকেএইচ