মালয়েশিয়ায় অবৈধ শ্রমিকদের বিরুদ্ধে চলমান অভিযানে শত শত অভিবাসীকে আটক করছে দেশটির ইমিগ্রেশন পুলিশ। জানা গেছে, বহুদিন মালয়েশিয়ায় থাকার পরও যাদের বৈধ কাগজপত্র নেই, এই ধরপাকড় অভিযান নিয়ে তাদের মধ্যে ব্যাপক আতঙ্ক ছড়িয়েছে। দেশটির পুলিশ ও ইমিগ্রেশন বিভাগ যৌথভাবে এ অভিযান চালাচ্ছে।
Advertisement
পুলিশ কোথায় ধরপাকড়ে নামবে কিংবা যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে এমন খবর জানামাত্রই কমিউনিটির লোকজন ফেসবুক বা হোয়াটসঅ্যাপে সবাইকে সতর্ক করে বার্তা পাঠাচ্ছেন। কিন্তু তাতেও ধরপাকড় এড়ানো যাচ্ছে না। গত ২ মাসে বাংলাদেশিসহ সাড়ে ৮ হাজার অবৈধ অভিবাসীকে গ্রেফতার করেছে দেশটির অভিবাসন বিভাগ।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, শহরে ইমিগ্রেশন, পুলিশ, রেলা, সিটি কর্পোরেশনের যৌথ অভিযানের কারণে অবৈধ অভিবাসীরা মালয়েশিয়ার বিভিন্ন ছোট ছোট শহর ও গ্রাম অঞ্চলের লোকালয়ে কাজ করছে এমন সংবাদ আগেই চলে যায় সংশ্লিষ্টদের কাছে। আর এই সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে জঙ্গল পর্যন্ত অভিযান পরিচালনা করছে অভিবাসন বিভাগ।
অভিবাসন সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ৯ মার্চ পর্যন্ত, মালয়েশিয়ার বিভিন্ন জায়গায় ২ হাজার ১০০টি অভিযানে আটক করা হয় ৩২ হাজার ৮৯৫ জনকে। আটকদের মধ্যে যাচাই-বাছাই শেষে গ্রেফতার করা হয় বাংলাদেশিসহ বিভিন্ন দেশের ৮ হাজার ৫৫২ জন অবৈধ অভিবাসীকে। এ ছাড়া অবৈধ অভিবাসী রাখার অপরাধে গ্রেফতার করা হয়েছে ১৪৫ জন মালিককে। তবে অভিযানে বাংলাদেশিসহ অন্যান্য দেশের কতজন করে গ্রেফতার করা হয়েছে তা অভিবাসন বিভাগ প্রকাশ করেনি। মালয়েশিয়া ইমিগ্রেশন বিভাগের প্রধান দাতুক ইন্দিরা খায়রুল দাজামী বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানিয়েছেন।
Advertisement
আটকদের মধ্যে বাংলাদেশ ছাড়াও ইন্দোনেশিয়া, ভারত, পাকিস্তান, ফিলিপাইন, নেপাল, মিয়ানমার ও ভিয়েতনামের নাগরিকরাও রয়েছেন। মানবাধিকার কর্মী হারুন আল- রশিদ রোববার এ প্রতিবেদককে জানিয়েছেন, ভয়ে ভয়ে দিন-কাটানো এই অবৈধ বাংলাদেশিরা অনেকেই অভিযোগ করছেন কথিত এজেন্টদের হাতে প্রতারিত হওয়াতেই তারা আজ অবধি সে দেশে বৈধ শ্রমিকের স্বীকৃতি পাননি।
‘২০১৬ ’র ফেব্রুয়ারিতে মালয়েশিয়ার সরকার রি-হায়ারিং প্রোগ্রামের মাধ্যমে এই অবৈধ শ্রমিকদের বৈধ হওয়ার একটা সুযোগ দিয়েছিল। কিন্তু যে তিনটি ভেন্ডর কোম্পানিকে এর দায়িত্ব দেওয়া হয়, তাদের নাম ভাঙ্গিয়ে বেশ কিছু নকল এজেন্ট বা দালাল বাংলাদেশিদের সঙ্গে বিরাট প্রতারণা করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।’
হারুন আল-রশিদ নামে এক প্রবাসী বলেন, ‘আমরা এমন ঘটনা অনেক দেখেছি, যেখানে বাংলাদেশি শ্রমিকরা না-বুঝে ওই ভুয়া এজেন্টদের হাতে চার থেকে পাঁচ হাজার রিঙ্গিত তুলে দিয়েছেন, তাদের আঙ্গুলের ছাপও নেয়া হয়েছে - কিন্তু এজেন্টরা ওই টাকাটা মেরে দেয়ায় তাদের আর কখনই বৈধ হয়ে ওঠা হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘যেসব ভুয়া কোম্পানি শ্রমিকদের সঙ্গে প্রতারণা করে তাদের ফিঙ্গারপ্রিন্ট নিয়েছিল সেগুলোর বেশির ভাগেরই মালয়েশিয়ান ও মালয়েশিয়ান নাগরিকদের ছত্রছায়ায় মালিকানাও ছিল বাংলাদেশিদের।
Advertisement
মালয়েশিয়ায় শিল্পাঞ্চল অধ্যুষিত এলাকা পেনাংয়ে কর্মরত জুয়েল নামে এক বাংলাদেশি যেমন জানাচ্ছেন, ২০১৭ সালে বাংলাদেশের এজেন্ট তার কাছ থেকে চার হাজার রিঙ্গিত (বাংলাদেশি ৮০ হাজার টাকা) নিয়ে বিনিময়ে শুধু একটি মাই ইজির কাগজ (ভেন্ডর সংস্থা) ধরিয়ে দেয়।
‘তারপর দীর্ঘদিন ঘুরেও আমার ভিসা না হওয়ার কারণে আমাকে এখন দেশে ফিরে যেতে হচ্ছে। টাকা ফেরত চাইতে গেলে ওই এজেন্ট বিভিন্ন হুমকি-ধামকি দিচ্ছে।’
পাহাং জেলার কুয়ান্তান এলাকাতেও বাংলাদেশি এজেন্টদের হাতে প্রতারিত হয়ে প্রায় দুই থেকে তিনশো বাংলাদেশি এরই মধ্যে দেশে ফেরত যেতে বাধ্য হয়েছেন। এখন মালয়েশিয়ার ১৩টি প্রদেশজুড়ে অভিযান শুরু হওয়াতে সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছেন এই অবৈধ শ্রমিকরাই।
মালয়েশিয়ার স্থানীয় ব্যবসায়ী শাহীন মিয়া বলছিলেন, ‘যখনই একটা এলাকায় অভিযান চালানো হচ্ছে, প্রথমেই বৈধ ও অবৈধ - সব বিদেশি শ্রমিককে ধরে এনে খোলা জায়গায় সারিবদ্ধভাবে বেঁধে দাড় করিয়ে দেয়া হচ্ছে। রোদ হোক বৃষ্টি-তাদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হচ্ছে।’
‘তারপর কাগজপত্র পরীক্ষা করে যারা বৈধ তাদের ছেড়ে দেয়া হলেও বাকিদের লরিতে চাপিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ক্যাম্পে। কিন্তু কাগজপত্র ঠিক থাকুক বা না-থাকুক, হেনস্থা হতে হচ্ছে সবাইকেই।’
মানবাধিকার কর্মী হারুন বলেন, ‘ক্যাম্পে নেয়ার পরও অবৈধ শ্রমিকদের দুর্দশার শেষ হচ্ছে তা মোটেই নয়। ১৪ দিনের মধ্যে আদালতে পেশ করা হলে তাদের যে সাজা হয়, প্রথমে সেই মেয়াদটা জেলে কাটাতে হয়।’
তারপর যদি তারা দেশে ফেরার টাকা জোগাড় করতে পারেন, তাহলে নিজেকে বিমানের টিকিট কেটে ফেরার ব্যবস্থা করতে হয়।
এদিকে সম্প্রতি দেশটির ইমিগ্রেশন বিভাগের স্পেশাল পাস ইস্যুতে করারোপের কারণে অবৈধরা না-পারছেন মালয়েশিয়া ছেড়ে যেতে, আবার অবৈধ শ্রমিক হিসেবে সে দেশে থেকে গেলেও হেনস্থা হতে হচ্ছে পুলিশ ও ইমিগ্রেশন বিভাগের হাতে। সব মিলিয়ে এক দুর্বিষহ অবস্থার মধ্যে পড়েছেন এই হাজার হাজার বাংলাদেশি।
বাংলাদেশিদের অপরাধের কারণে শ্রমবাজারে কোনো প্রভাব ফেলবে কিনা এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বাংলাদেশি ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আলী এই প্রতিবেদককে জানান, মালয়েশিয়া সরকার সব সময় স্বচ্ছতার মধ্য দিয়ে শ্রমিক নিয়োগ দিলেও বাংলাদেশ থেকে শ্রমিকরা প্রতারিত হয়ে আসার কারণেই দীর্ঘদিন বাংলাদেশের শ্রমবাজার বন্ধ রয়েছে। সেই প্রতারণার ঘটনা মুছতে না মুছতেই কিছু কিছু বাংলাদেশিদের ইমিগ্রেশন সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অপরাধের কারণে বাংলাদেশের শ্রমবাজার হুমকির মুখে পড়তে পারে এমন ধারণা অনেকের।
এমআরএম/পিআর