বিশেষ প্রতিবেদন

কেউ জানে না, তাই ‘পুলিশও জানে না’

>> আসামিদের অবস্থান নিয়ে এখনও অন্ধকারে পুলিশ>> মালিকরা বিদেশ পালিয়েছে কিনা, জানার চেষ্টা করছে পুলিশ

Advertisement

বসতবাড়িতে নিষিদ্ধ কেমিক্যাল রেখে ৭১ জনের ‘মৃত্যুর জন্য দায়ী’ হাজী ওয়াহেদ ম্যানশনের দুই মালিক মো. হাসান ও সোহেল ওরফে শহীদকে কোনোভাবেই গ্রেফতার করতে পারছে না পুলিশ। ইতোমধ্যে ঘটনার দুই সপ্তাহেরও বেশি সময় পার হলেও তাদের অবস্থান জানতে পারেনি তারা। পুলিশের দাবি, ‘তাদের বিষয়ে অনেককে জিজ্ঞাসাবাদ করেও কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তারা দেশের বাইরে চলে গেছে কি না তা জানার চেষ্টা চলছে।’

এদিকে মামলা তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, এই মামলায় পুলিশের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত কোনো উল্লেখযোগ্য তদন্ত হয়নি।

ঘটনার পর এলাকাবাসীর প্রথম চাওয়া ছিল যারা এই ৭১ জনের মৃত্যুর জন্য দায়ী তাদের গ্রেফতার করে বিচারের মুখোমুখি করা। এরপর তাদের কেমিক্যালের লাইসেন্স দিয়ে যারা সহযোগিতা করেছে তাদের গ্রেফতার করা। তবে অন্যদের তো দূরের কথা এজাহারে নামধারী প্রধান দুই আসামিকেই ধরতে পারছে না পুলিশ।

Advertisement

গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা চকবাজার থানার পুলিশ পরিদর্শক (ইন্সপেক্টর) মু. মুরাদুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘আসামিদের অবস্থান জানার জন্য অনেককেই জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। কেউই তাদের সন্ধান দিতে পারেনি। তাই আমরা তাদের গ্রেফতার করতে পারছি না।’

তিনি বলেন, ঘটনার দিনই তারা বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। আমরা আশপাশের অনেককেই জিজ্ঞেস করেছি, কিন্তু তারা কোথায় আছে কেউ বলতে পারে না। আত্মীয়স্বজনের সঙ্গেও যোগাযোগ করা হয়েছে। কেউই কিছু বলতে পারে না। আমাদের তদন্ত চলছে, তাদের গ্রেফতার করা হবে।

এ ঘটনায় দায়ের করা মামলার এজাহার পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এতে দণ্ডবিধি ৩০৪ (ক), ৪৩৬, ৪২৭ এবং ৩৪ ধারা উল্লেখ করা হয়েছে। দণ্ডবিধি ৩০৪ (ক) ধারায় ‘অবহেলাজনিত মৃত্যু’ শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ ধারায় আসামির সর্বোচ্চ সাজা ৫ বছর। দণ্ডবিধি ৪৩৬ ধারা ‘বিস্ফোরক দ্রব্য ও আগুনের মাধ্যমে সম্পদ বিনষ্ট’ করার কারণে দেয়া হয়েছে। এ ধারায় সর্বোচ্চ শাস্তি ১০ বছরের কারাদণ্ড। সম্পদ বিনষ্টের মাধ্যমে আর্থিক ক্ষতি হওয়ায় দণ্ডবিধি ৪২৭ যোগ করা হয়েছে। এই ধারায় আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি ২ বছরের কারাদণ্ড। একই উদ্দেশ্য পূরণের জন্য কয়েকজন একত্রিত হয়ে অপরাধমূলক কাজ করার জন্য মামলায় দণ্ডবিধির ৩৪ ধারাটি যুক্ত করা হয়েছে। এ ধারায় ভবনের মালিক, কেমিক্যাল ব্যবসায়ীসহ অগ্নিকাণ্ডের জন্য দায়ী সংশ্লিষ্ট সবাই দোষী।

এসব ধারায় সরকারি কয়েকটি সেবা সংস্থার কর্মকর্তাদের দায়বদ্ধতা থাকলেও এ বিষয়ে এখনও কোনো কাজই শুরু করেনি পুলিশ। তদন্তের অগ্রগতি জানতে চাইলে মামলার তদারকি কর্মকর্তা পুলিশের চকবাজার জোনের সহকারী কমিশনার (এসি) সিরাজুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘গ্রেফতারের বিষয়টি আমার নলেজে নেই। এছাড়া তদন্ত সংশ্লিষ্ট কোনো কাগজপত্র আমার কাছে আসেনি। ভালো হবে আপনি ওসির (চকবাজার থানা) সঙ্গে কথা বলেন। এটি একটি স্পর্শকাতর মামলা, এ বিষয়ে ডিসি (লালবাগ বিভাগ) স্যারের সঙ্গে কথা বলতে পারেন।’

Advertisement

তদন্তের অগ্রগতি জানতে পুলিশের লালবাগ বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) ইব্রাহীম খানকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি তা রিসিভ করেননি। চকবাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শামীম-অর-রশিদ তালুকদার জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা তাদের অবস্থান শনাক্তের চেষ্টা করছি। কিন্তু পাচ্ছি না। তারা দেশের বাইরে চলে গেল কি না তাও জানার চেষ্টা করা হচ্ছে, তদন্ত চলছে।’

মর্মান্তিক এ ঘটনার বাদী মো. আসিফ। তার বাবা জুম্মন এই অগ্নিকাণ্ডে প্রাণ হারিয়েছেন। আসিফ জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা শুধু নামেই মামলার বাদী, মামলার কোনো বিষয় নিয়ে পুলিশ আমাদের সঙ্গে আলোচনা করেনি। কিছু জানতেও চায়নি। আমরাও স্বেচ্ছায় গিয়ে কিছু বলিনি।’

তিনি আরও বলেন, বাবাসহ এতো এতো প্রাণ চলে গেল, আমরা চাই এ অগ্নিকাণ্ডে যারা সরাসরি দোষী এবং যাদের অবহেলায় এ ঘটনা ঘটেছে তাদের যেন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়।

শনিবার সরেজমিনে চুড়িহাট্টায় গিয়ে দেখা যায়, আগুনের ১৪ দিন পরও ওয়াহেদ ম্যানশন ও আশপাশে পোড়া গন্ধ। ভবনের দোতলায় যেখানে পারফিউমের কারখানা ছিল সেখান থেকে আসছে সুগন্ধ। নিচতলা ও দ্বিতীয় তলার বিম ও কলাম কিছুটা বেঁকে গেছে। পুলিশ সদস্যরা ২৪ ঘণ্টা ভবনটির সামনে অবস্থান করছেন।

সেই সঙ্গে ওয়াহেদ ম্যানশনের নিচে পুড়ে যাওয়া পরিত্যক্ত দোকানগুলো থেকে ব্যবসায়ীরা নিজ নিজ মালামাল সরিয়ে ফেলছেন। স্থানীয়রা বলেন, তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে মালিকদের।

নাজিম নামে একজনের কাছে দুই মালিকের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এগুলো এখন পুলিশের বিষয়। আপনারা পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।’

তবে চুড়িহাট্টায় যাদের সঙ্গে জাগো নিউজের কথা হয়েছে তাদের সবাই এ ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিচার চেয়েছেন। উর্দু রোডের বাসিন্দা তোফাজ্জল হোসেন বলেন, শুধু ওয়াহেদ ম্যানশনের মালিক নয়, যাদের পৃষ্ঠপোষকতায় তারা এসব কাজ করেছেন তাদেরও আইনের আওতায় আনা হোক।

দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, পুরান ঢাকার বংশাল, চকবাজার ও লালবাগ এলাকায় সিটি কর্পোরেশনের লাইসেন্স নিয়ে ১ হাজার ৮৯৬ ব্যক্তি কেমিক্যালের ব্যবসা করেন। সর্বশেষ ১৯ ফেব্রুয়ারি পুরান ঢাকার পাঁচ রাসায়নিক ব্যবসায়ীর ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন করা হয়। যাদের অনেকেই নিষিদ্ধ কেমিক্যাল বিক্রি করছেন। তারাই আবার খরচ বাঁচানোর জন্য আবাসিক ভবনে গুদাম ভাড়া নিচ্ছেন।

গত ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে চকবাজারের চুড়িহাট্টার ৬৪ নম্বর হাজি ওয়াহেদ ম্যানশনে ভয়াবহ এই অগ্নিকাণ্ডটি ঘটে। এ ঘটনায় মোট ৭১ জন মারা গেছেন। প্রাথমিক তদন্তে আগুনের কারণ হিসেবে কেমিক্যালকেই দায়ী করা হয়েছে।

এ ঘটনার দুদিন পর দুই মালিকসহ অজ্ঞাত ১০-১২ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়।

পাশাপাশি পুরান ঢাকার আবাসিক ভবনগুলো থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে কেমিক্যাল ও দাহ্য পদার্থ সরানোর নির্দেশ দেয় ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন।

এআর/এমএমজেড/জেআইএম