বিনোদন

যে কারণে সিনেমা করেন না ‘দিলদারের নায়িকা’ নাসরিন

চলচ্চিত্রের সোনালী দিন দেখেছেন। বহু সুপারহিট ও কালজয়ী সিনেমার অংশ তিনি। নব্বই দশকে নায়ক-নায়িকারা যতোটা জনপ্রিয় ছিলেন তার চেয়ে কম পরিচিত ছিলেন না চলচ্চিত্র অভিনেত্রী নাসরিন।

Advertisement

রুপালি পর্দায় এই অভিনেত্রীর অভিষেক হয় ১৯৯২ সালে ‘অগ্নিশপথ’ ছবির মাধ্যমে। তারপর কৌতুক অভিনেতা টেলি সামাদের সঙ্গে জুটি হয়ে আলোচনায় আসেন তিনি। তবে দিলদারের জুটি হিসেবে নাসরিনের জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ে দেশজুড়ে। সিনেমার প্রচারে ক্যানভাসাররা মাইকে মাইকে বলে বেড়াতেন দিলদারের নায়িকা নাসরিন। দর্শকও এই পরিচয়ে গ্রহণ করেছিল নাসরিনকে।

তাকে দেখা গেছে আফজাল শরীফ ও কাবিলার সঙ্গেও। নব্বই দশকের প্রায় সব ছবিতেই দেখা মিলতো তার। নানা রকম চরিত্রে হাস্য রসাত্মক দৃশ্য নিয়ে হাজির হতেন তিনি। কমেডির পাশাপাশি কিছু নেগেটিভ চরিত্রে অভিনয় করেও প্রংশসিত  হয়েছেন। ঢাকাই সিনেমার দর্শকদের কাছে প্রিয় এক নাম। 

শাবনূর-মৌসুমীদেরও আগে সিনেমায় যাত্রা শুরু তার। এসেছিল নায়িকা হওয়ারও প্রস্তাব। তবে সে ভাগ্য আর হয়নি তার। ‘দিলদারের নায়িকা’ হিসেবেই জনপ্রিয় থেকে গেলেন নাসরিন। তার ভাষায়, ‘আমি কাছের মানুষদের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছি বারবার। তাই নায়িকা হতে পারিনি।’

Advertisement

অনেক বড় নায়িকারাও আমার সঙ্গে গুটিবাজি করেছে। আজকের মেয়েদের মতো অতো বুদ্ধিমান ছিলাম না, নিজের প্রতি যত্নশীল ছিলাম না। তাই অনেক সুযোগ হেলায় হারিয়েছি।

একসময় আফসোস হতো। এখন আর হয় না। যেভাবে আল্লাহ রেখেছেন সেভাবেই খুশি আমি, যা হওয়ার ছিল তাই হয়েছে। তবে কষ্ট হয় সিনেমার অবস্থা দেখে। সিনেমা নেই। কাজ নেই। করুণ দিনযাপন করতে হচ্ছে আমার মতো শিল্পীদের।’

গত ৮ মার্চ শুক্রবার বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির বনভোজনে এসেছিলেন নাসরিন। সেখানে জাগো নিউজের সঙ্গে আলাপচারিতায় এসব কথা বলেন নাসরিন। অনেক দিন সিনেমায় দেখা মিলে না নাসরিনের। কেন? সেই প্রশ্নের জবাবেই এসব মন্তব্য করে নাসরিন আঙুল দিয়ে দেখাতে চাইলেন চলচ্চিত্রের করুণ চিত্রটা।

কাজ না থাকলেও নায়ক-নায়িকাদের দিন চলে যাচ্ছে স্টেজে নেচে, ফিতা কেটে, নানা রকম ব্যবসা-বাণিজ্যে। কিন্তু দরিদ্র শিল্পীরা যারা অতিরিক্ত শিল্পী হয়ে রোজ মজুরিতে কাজ করতেন তাদের অবস্থা নাজুক।

Advertisement

নাসরিন জানান, আজকাল স্টেজ শো করেই জীবন যাপন করছেন তিনি। সংসার নিয়ে টিকে আছেন কোনোমতে। তবে তার চেয়েও অনেক দরিদ্র শিল্পী চলচ্চিত্রপাড়ায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন বলে জানান। তাদের কাজ দরকার, সাহায্য দরকার। এদের কেউ চেনে না। সারা জীবন সিনেমা সিনেমা করে কাটিয়েছে। অন্য কিছু করার আগ্রহও নেই, সুযোগও নেই অনেকের।

নাসরিন বলেন, ‘এত পেশা থাকতে সিনেমায় মানুষ কেন আসে? সম্মানের জন্য। লোকে শিল্পী বলবে। সম্মান করবে। সেই সম্মান নিয়ে রাস্তায় রিকাশা চালাবে, অন্যের বাড়িতে বুয়ার কাজ করবে এটা হয়তো অনেকে মানতে পারে না। তাই বুক বেঁধে থাকে কেউ সিনেমা করলে তাকে ডাকবে। কিন্তু সিনেমা কই!

আমিও অনেক দিন অপেক্ষায় থেকেছি। সিনেমায় ডাক আসে না। পরিচিতিটা কাজে লাগিয়ে স্টেজ শো করে জীবন চালাচ্ছি।’

সিনেমার এই করুণ দশার জন্য নাসরিন দায়ী করেন শাকিব খান ও অপু বিশ্বাসের জুটি ভেঙে যাওয়াকে। তার মতে, এই জুটিকে দেখতে মানুষ হলে আসতো। এখন আর এই জুটি নেই, দর্শকও হলে আসে না। সেই সঙ্গে তিনি দাবি করেন, শাকিব-অপুর পাশাপাশি দর্শক কাবিলার সঙ্গে তার জুটিকেও মিস করেন।

নাসরিন বলেন, ‘সিনেমায় কেমন করে দেখবেন আমাকে? এখন কি আর সেই দিন আছে! যখন আমরা কাজ করতাম তখন আমাদের অভিনয় দেখে পরিচালক এবং প্রযোজকরা ডাকতো। আর এখন অভিনয় জানে না সে নায়িকা। বলেন এরকম যদি হয় তাহলে আমাদের জায়গা হবে কোথায়?

এত এত গুণী মানুষ সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে। কাউকে দেখেন অভিনয় করতে? নেই। তারা কেন নেই। কারণ, অনেক সমস্যা। কি বলবো ভাই বলেন, সারা বছর স্টেজ শো করি। যেখানে যাচ্ছি সবাই বলছে আপু তোমাদের ছবি নাই কেন? আমাদের তখন খুব কষ্ট লাগে। উত্তর দিতে পারি না। সারাটা জীবন কেটে গেল যেখানে তার কী করুণ অবস্থা হয়েছে। তাকে ছেড়ে অন্য কোথাও অন্য কিছু করে খেতে হয় আমাকে। এই কষ্ট সহ্য হয় বলেন!’

আবেগপ্রবণ নাসরিন বলে যান, ‘মনে আছে, একটা শো করতে গিয়ে ঢাকার বাইরে এক হল মালিকের সঙ্গে দেখা হয়েছিলো। তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করেছিলেন। তিনি বলছিলেন, আপা আজ তোমাদের ছবি নাই বলে হল বন্ধ করে দিতে হচ্ছে।

সিনেমা তো নাই-ই। যা কিছু মুক্তি পায় গল্পের ঠিক নাই, অভিনয়ের ঠিক নাই, জনপ্রিয় শিল্পী নাই। দর্শকও নাই। দর্শক শাকিব-অপুকে চায়। নাসরিন-কাবিলাকে চায়। ইন্ডাস্ট্রি কী এইসব বুঝে? সিনেমার জনপ্রিয় তারকাদের সবাই আবার ফিরে আসুক অভিনয়ে দেখবেন সব বদলে গেছে।’

নাসরিন জানান, ‘ছুটির ঘণ্টা’র কিংবদন্তি পরিচালক আজিজুর রহমান তাকে বলতেন ‘বোম্বের মমতাজ’। প্রয়াত চিত্রপরিচালক শহীদুল ইসলাম খোকন তাকে বলেছিলেন নায়ক রুবেলের বিপরীতে নায়িকা করে দেবেন। আরেক কিংবদন্তি পরিচালক ‘সুজন সখী’র নির্মাতা জহিরুল হক ‘হেলেন’ নামে ডাকতেন নাসরিনকে। তিনিও প্রস্তাব দিয়েছিলেন ‘সুজন সখী’র নায়িকা হওয়ার। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি নাসরিনের।

অনেক কিছুই হতে পারতেন এমন ভাবনা অনেকটা সময় তাকে তাড়া করে বেড়ালেও নিজেকে এখন মানিয়ে নিয়েছেন যেটুকু হতে পেরেছেন তার বাস্তবতায়। একটা সময় চলচ্চিত্রে আলমগীর-শাবানা কিংবা সালমান-শাবনূরের উপস্থিতি যেমন দর্শকের বাড়তি আগ্রহের বিষয় ছিলো তেমনি দিলদার-টেলি সামাদের সঙ্গে নাসরিনের উপস্থিতিও প্রত্যাশা ছিলো দর্শকের। সোনালী দিনের সেই দিনগুলোই নাসরিনের জীবেনর খাতায় সঞ্চয় হয়ে রইলো।

এখন কেবল সন্তানদের মানুষ করতে চান তিনি। নিজের পূরণ না হওয়া স্বপ্নগুলো তাদের মধ্য দিয়ে পূরণের ব্রত নিয়েছেন। এক মেয়ে এবং এক ছেলের মা নাসরিন দোয়া চান ভক্তদের কাছে, সবার কাছে। স্বামী রিয়েলকে নিয়ে সুখে জীবনটা কাটাতে চান।

সন্তানদেরও কী অভিনয়ে দেখতে চান কী না এমন প্রশ্নের জবাবে চলচ্চিত্রে অবহেলিত নাসরিনের উত্তর- আল্লাহর কাছে একটাই চাওয়া আমার সন্তানরা যেন ভালো মনের মানুষ হিসেবে গড়ে উঠে। তারা যেন কোনদিন কাউকে অবহেলা না করে!

এরপর আর কোনো কথা থাকে না। বিব্রত হয়ে ধন্যবাদসূচক মুচকি হাসি দিয়ে নাসরিনের কাছ থেকে বিদায় নিতে হয়...!

এলএ/পিআর