জাতীয়

আদিবাসীরাই বেশি বৈষম্যের শিকার : টিআইবি

আদিবাসী ও দলিত জনগোষ্ঠী সমাজে ব্যাপকভাবে লাঞ্ছিত-বঞ্চিতের শিকার হচ্ছেন। তাদের সাংবিধানিক অধিকার হরণ করা হচ্ছে। সার্বজনীন একই চিত্র পরিলক্ষিত হলেও আদিবাসীরাই বেশি বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন বলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে।

Advertisement

টিআইবি বৈষম্য নিরসনে ১৩ দফা সুপারিশ তুলে ধরে। গত এক বছর ধরে চালানো গবেষণা প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন সংস্থাটির গবেষণা কর্মকর্তা মো. মোস্তফা কামাল।

আরও পড়ুন >> মাতৃভাষায় বই আছে, নেই প্রশিক্ষিত শিক্ষক

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আদিবাসী ও দলিত জনগোষ্ঠীরা সমাজে নানা ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতির শিকার হচ্ছেন। তাদের ভোটাধিকার ও নির্বাচনে অংশগ্রহণের অধিকার হরণ করা হচ্ছে। বসবাস ও চাষাবাদের অধিকার খর্ব ও প্রথাগত ভূমি মালিকানার ভিত্তিতে ভোগ করা জমি প্রভাবশালীরা ভুয়া দলিল করে বসবাস ও চাষাবাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। ভূমি দখলের বিচার পাচ্ছেন না আদিবাসীরা।

Advertisement

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, আদিবাসী ও দলিতরা আলাদা জনগোষ্ঠী হলেও তাদের পৃথক কোনো সুযোগ-সুবিধা দেয়া হচ্ছে না। তাদের বিদ্যালয়ে ভর্তিতে বাধা, নিজ ধর্ম শিক্ষার বিষয়ে পড়ার সুযোগ না দেয়া, নিজ মাতৃভাষায় শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা এবং তাদের সন্তানদের শিক্ষাবৃত্তি প্রদানে অনিয়ম করা হচ্ছে।

বৃত্তি প্রদানে বাড়তি অর্থ আদায়েরও ঘটনা ঘটছে। প্রাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত করা এবং বিরূপ আচরণও করা হচ্ছে। এ কারণে অনেকে সরকারি হাসপাতালে গিয়ে অপমানিত হয়ে চিকিৎসা না নিয়ে ফিরে যাচ্ছেন।

প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে, দরিদ্র ও অসহায় ব্যক্তিদের অগ্রাধিকার প্রদান করা হচ্ছে না। উপকারভোগী নির্বাচনে আদিবাসী ও দলিত প্রতিবন্ধী, বয়স্ক পুরুষ, বয়স্ক ও বিধবা নারী, দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত ব্যক্তিদের অগ্রাধিকার না দিয়ে তুলনামূলক সচ্ছলদের অন্তর্ভুক্তি করা হচ্ছে। দলিত ও আদিবাসীদের নিজস্ব ধর্মীয় উৎসবের সময় সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রম থেকে সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে না। তারা সালিশে জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা অন্যায়ের শিকার হচ্ছেন। তাদের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে অন্তর্ভুক্তি করা হচ্ছে না।

পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না করেই নানাভাবে তাদের উচ্ছেদ করা হচ্ছে। সামাজিক নিরাপত্তা, মৌলিক আধিকার থেকে বঞ্চিত করা হলেও তা মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা না থাকায় প্রতিনিয়ত এসব ঘটনা বিদ্যমান থাকছে বলে টিআইবি’র প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে।

Advertisement

আরও পড়ুন >> শুধু ভোটের সময় খোঁজ হয়

গবেষণার যৌক্তিকতা হিসেবে বলা হয়েছে, ভিন্ন জাতিসত্তা ও বর্ণভিত্তিক পরিচয়ের কারণে নানা ধরনের বঞ্চনার মধ্য দিয়ে পিছিয়ে রাখার ধারাবাহিকতা ও অধিকার নিশ্চিতে এবং তাদের সেবায় অন্তর্ভুক্তিতে নানাবিধ প্রতিবন্ধকতার কারণে আদিবাসী ও দলিতদের আরও পিছিয়ে রাখার সম্ভাব্য ঝুঁকি চিহ্নিত করার প্রয়োজনীয়তাকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।

প্রচলিত আইনের বিভিন্ন নেতিবাচক দিকও তুলে ধরা হয়েছে প্রতিবেদনে। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশ সরকারি চাকরিবিধি- ২০১৪ এর ২০১৮ সালের প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে সকল কোটা রহিতকরণের ফলে উপজাতিদের জন্য ৫ শতাংশ কোটাও বিলুপ্ত হয়েছে। এছাড়া পরিচ্ছন্নতাকর্মী পদে হরিজনদের ৮০ শতাংশ কোটা থাকলেও যথেষ্ট সংখ্যক হরিজন না পাওয়ার শর্তে সাধারণ কর্মীদের নিয়োগ দেয়ার বিধান করা হয়েছে।

টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান এসব প্রসঙ্গে বলেন, আদিবাসী ও দলিত জনগোষ্ঠীরা নানাভাবে আইনি ও সাংবিধানিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এমন অভিযোগ দীর্ঘদিনের। তাদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণের ফলে নানাভাবে এ জাতি পিছিয়ে পড়ছে।

তিনি বলেন, দলিতদের ‘ঐতিহাসিক কাঠামো ও আধিকার’ নীতিমালায় উল্লেখ করা হয়নি। এ কারণে তাদের সংস্কৃতি হারিয়ে যাচ্ছে। সমাজে তারা অবহেলিত-লাঞ্ছিতের শিকার হচ্ছেন। আদিবাসী ও দলিতদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদানের আহ্বান জানিয়ে তিনি তাদের অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের দাবি জানান।

আরও পড়ুন >> দিবস আসে দিবস যায়, শেষ হয় না তাদের লড়াই

এসব সমস্যা সমাধানে আদিবাসীদের পৃথক পৃথক জাতিসত্তা ও দলিতদের পরিচয়ের সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান এবং আদিবাসী বিষয়ক আন্তর্জাতিক সনদসমূহ স্বাক্ষর নিশ্চিত করা, যথাযথ গবেষণার মাধ্যমে আদিবাসী ও দলিত জনগোষ্ঠীগুলোকে চিহ্নিত করে তাদের স্বতন্ত্র পরিচয়ের স্বীকৃতি প্রদান এবং অদিকার ও অন্যান্য স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়াদি বিশেষায়িত মন্ত্রণালয়ে আন্তর্ভুক্তি, খসড়া বৈষম্য বিলোপ আইন চূড়ান্ত করে তার কার্যকর বাস্তবায়ন নিশ্চিতকরণ, সকল আদিবাসী ও অবাঙালি দলিত শিশুদের নিজ মাতৃভাষায় শিক্ষালাভের অধিকার নিশ্চিত করতে তাদের মাতৃভাষায় পাঠ্যবই প্রণয়ন ও পাঠদানে শিক্ষক নিয়োগ, চাকরিতে নির্ধারিত কোটা বহাল, ভূমি সমস্যার কার্যকর সমাধান ও ভূমি কমিশন গঠনসহ ১৩ দফা সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে।

অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন টিআইবি’র উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের, রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান প্রমুখ।

উপজাতিদের সম্মাননায় ‘আদিবাসী’ শব্দের পরিবর্তে ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী’ ব্যবহারে বাধ্যবাধকতা থাকলেও টিআইবির গবেষণা প্রতিবেদনে আদিবাসী শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। বিষয়টি আইনের লঙ্ঘন কিনা- জানতে চাইলে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘গবেষণার কাজ সহজীকরণের ক্ষেত্রে আমরা আদিবাসী শব্দটি ব্যবহার করেছি। তবে এটি সংবিধান লঙ্ঘন করে বলেও মেনে নিচ্ছি। এ কারণে যদি আমাদের শাস্তির সম্মুখীন হতে হয়, আমরা তা মাথা পেতে নেব।’

এমএইচএম/এমএআর/জেআইএম