খেলাধুলা

শট খেলে দ্রুত রান করা নয়, চাই রয়ে সয়ে সময় নিয়ে ব্যাটিং

বলা হয় টেস্ট ক্রিকেটে ব্যাটিং মানেই ধৈর্য্য, সংযম। তাই অনেকের মতে টেস্ট হচ্ছে ধৈর্য্যের খেলা, মনোযোগ আর মনোসংযোগের খেলা। কিন্তু ধৈর্য্য, মনোযোগ আর মনোসংযোগই কি শেষ কথা? এর বাইরে কি আর কিছুই নেই? আছে।

Advertisement

আরো কিছু অত্যাবশ্যকীয় ও আনুসাঙ্গিক উপকরণ-উপাদান আছে, যা ছাড়া টেস্ট জেতা যায় না। টেস্ট জিততে ধৈর্যশীল, মনোযোগী-মনোসংযোগী ব্যাটিংয়ের চেয়ে বেশী প্রয়োজন কার্যকর ও ধারালো বোলিং। টেস্ট জিততে ব্যাটিং কার্যকরিতার চেয়ে তাই বোলিংটাই বেশী দরকার। প্রতিপক্ষকে দু'বার অলআউট করা মানে এক ম্যাচে বিপক্ষ দলের ২০ উইকেটের পতন ঘটানো খুব জরুরী।

তবে টেস্ট ড্র করতে সবার আগে চাই ধৈর্য্য, মনোযোগ আর মনোসংযোগ। আর তুলনামূলক শ্রেয়তর দল তথা শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিপক্ষে ম্যাচ বাঁচানো বা ড্র করতে হলে ঐ অত্যাবশ্যকীয় উপাদান লাগবেই। কিন্তু এর পাশাপাশি হিসেবি ব্যাটিং মানে সময়ের হিসেব কষে খেলাও যে খুব জরুরী।

সে কারণেই বিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন, টেস্ট ক্রিকেটের ব্যাটিংটা যত বেশি ধৈর্য্য, মনোযোগ ও মনোসংযোগের, ঠিক ততটাই সময়ের। খেলাটা পাঁচদিনের। সেই হিসেব থাকা এবং ব্যাটিংয়ের সময় ঐ হিসেব কষে খেলা তাই খুব প্রয়োজন।

Advertisement

শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিপক্ষে তাদের মাটিতে টেস্ট জয়ের চাইতে যেখানে ড্র করাই কৃতিত্বের, সেখানে সময়ের হিসেবটা যত বেশী মাথায় থাকবে এবং যত বেশী সময় উইকেটে কাটানো যাবে, ততই মঙ্গল। কন্ডিশন ভেবে এবং সেশন অনুযায়ী ব্যাটিং করতে না পারলে টেস্ট ড্র করার চিন্তা যে অলীক কল্পনা। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই ভুলটা হয় সবচেয়ে বেশি।

আজকাল তামিম প্রায় জ্বলে উঠছেন। ফর্মে থাকলে মুশফিক-সাকিবও নিয়মিতই রান করেন। কিন্তু তারপরও দেখা যায় প্রায় টেস্টেই পাঁচদিনের ম্যাচে একদিন বা তার কম সময়ে অলআউট টাইগাররা। বেশীর ভাগ সময় দেখা যায়, আগে ব্যাট করতে নামলে ম্যাচের প্রথম দিনই শেষ টাইগারদের প্রথম ইনিংস। হ্যামিল্টনে সিরিজের প্রথম ম্যাচে তাই হয়েছে। ৫৩.২ ওভারে ২৩৪ রানে অলআউট। আর এবার ওয়েলিংটনেও ঠিক তাই। ৬১ ওভারে ২১১ রানে শেষ প্রথম ইনিংস।

ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টে হিসেব কষলে আজ ওয়েলিংটন টেস্টের তৃতীয় দিন। তবে যেহেতু প্রথম দু'দিন বৃষ্টির কারণে বল পিচে গড়ায়নি, তাই এক অর্থে আজই টেস্ট শুরুর দিন। সেই দিনের তিন ভাগের এক ভাগ বাকি থাকতেই শেষ বাংলাদেশের প্রথম ইনিংস।

আসলে স্কোরলাইন যাই থাকুক না কেন, প্রথম দিন প্রথম ইনিংস শেষ হয়ে গেলে ম্যাচ বাঁচানো অনেক কঠিন। তখন প্রতিপক্ষের সামনে থাকে ম্যাচ জেতার অবারিত সুযোগ। আজ মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের দল যে রান করেছে, সেই রানটাই সারাদিন ধরে করলে ম্যাচ বাচানোর চিন্তা কম থাকতো। কিন্তু বাংলাদেশ অলআউট হলো দিনের প্রায় ৪০ ওভার আগে।

Advertisement

প্রতিদিন তো ৯০ ওভার করে খেলা। বাংলাদেশ ৬১ ওভার খেলার পরও ৪০ ওভার বাকি থাকে কি করে? নিশ্চয়ই প্রশ্ন জাগছে। তাহলে শুনুন, বৃষ্টিতে দুদিন ধুয়েমুছে যাওয়ায় প্রতিদিন এক ঘন্টা বেশী সময় খেলার সিদ্ধান্ত হয়েছিল, তাই ৯০ ওভারের বদলে ৪০+ ওভার ধরা হয়েছে। যদিও বৃষ্টিতে নিউজিল্যান্ড ইনিংসের ১১.৪ ওভার যেতেই শেষ হয়ে গেছে দিনের খেলা।

সেটা এক অর্থে টাইগারদের জন্য আশীর্বাদই বলা চলে। তারপরও রিয়াদের দল এত কম সময়ে অলআউট হয়ে যাওয়ায়, কিউদের ম্যাচ জেতার ছক কষে এগুনোর পথ সুগম হলো।

শর্ট বলে অস্বস্তি, তা কাটাতে মরিয়া হয়ে বলের ওপর চোখ রেখে ব্যাকরণ মেনে পুল খেলার বদলে মরিয়া হয়ে শর্ট বলের বিপক্ষে চালাতে গিয়ে অকাতরে উইকেট দিয়ে আসা, পাশাপাশি সময়ের হিসেব মাথায় না রাখা- এসব ভুলেই ওয়েলিংটন টেস্টে ভাল করার প্রাথমিক সুযোগ হয়েছে হাতছাড়া। তিন দিনে নয় সেশনের চার-পাঁচ সেশন নিজেরা ইনিংসে ব্যাট করতে পারলে আর চিন্তা থাকতো না।

তখন ড্র করার সুযোগ ও সম্ভাবনা থাকত অনেক বেশি। কিন্তু তা আর হলো কই। দুই সেশনই খেলা সম্ভব হলো না। এই ভেবে চিন্তে ব্যাটিং না করা, ধৈর্য্য ধরে উইকেটে পড়ে থেকে রান করার বদলে রানের মরিয়া হয়ে ছটফট করা এবং ঝুঁকিপূর্ণ শট খেলে রান চাকা সচল রাখার চেষ্টা চোখে পড়লো অনেকের মাঝেই। তামিম, সৌম্য, লিটন- যে তিনজন রান করেছেন তাদের তিনজনেরই স্ট্রাইকরেট গড়ে সত্তরের কাছাকাছি (তামিম ৬৪.৯১, সৌম্য ৮৩.৩৩, আর লিটন ৬৭.৩৪)। যেটা ৪৫-৫০ এর মাঝে থাকলে অনায়াসে আজকের দিনটি কাটানো যেত। আর যারা রান করেননি তাদের কথা বলে আর কী হবে।

তবুও শেষ বিকেলে হঠাৎ আবু জায়েদ রাহী বল হাতে খানিক আশা জাগালেন। ঘাসের উইকেটে ভাল জায়গায় বল ফেললে এমনিতেই একটু আধটু ম্যুভ করবে বল, সে চিন্তায় যতটা সম্ভব ওপরে বল ফেলে ব্ল্যাকক্যাপসদের সামনের পায়ে ড্রাইভ খেলানোর চেষ্টা করে সফল রাহী। দুই কিউই ওপেনার তার বলে ড্রাইভ খেলতে গিয়ে আউট।

অফস্টাম্পের সামান্য বাইরে পিচ পড়া ডেলিভারিতে অফড্রাইভ করতে গিয়ে ঐ ছোট্ট ম্যুভমেন্টে ধরা খেলেন লাথাম। বল তার ব্যাটের বাইরে অংশ চুমো খেয়ে চলে গিল কিপার লিটনের গ্লাভসে। আরেক ওপেনার সামনের পায়ে এসে ড্রাইভ করতে গিয়ে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলেন না। বল চলে গেল কভারে দাড়িয়ে থাকা সৌম্য সরকারের হাতে।

আজ সারা দিন খেলে কাল সকালের সেশনে কিউইদের এভাবে শুরুতে ঝাঁকুনি দিতে পারলে অবস্থান অনেক বেশী সুসংহত থাকতো। তখন রীতিমত ম্যাচ জমে যেত। কিন্তু হিসেব কষে আর সময়ের কথা না ভেবে ব্যাট করায় তা হয়নি। এই যে উইকেটে বেশী সময় কাটাতে পারলে হারের সম্ভাবনা কমে যাবে, এই বোধটা খুব জরুরী। বৃষ্টিতে পাঁচ দিনের ম্যাচ ছোট হয়ে তিন দিনের হয়ে গেছে। কিন্তু তাই বলে আমরা প্রথম ইনিংসে এক দিনের দুই ঘন্টা সময় আগে অলআউট হলে যে হেরে যেতে পারি- সে চিন্তাটাই হয়ত কম।

যে রান আমি ৬০ থেকে ৭০ ওভারে করতে পারি, তা এক দিন পুরো উইকেটে কাটিয়ে করবো- এই ইচ্ছেটাই খুব কম। আর তাই তো শর্ট বল পেলেই সবার চোখ বড় হয়ে হয়ে যায়। মনে হয় মারবো। আর সে শর্ট বলে মারতে গিয়ে তামিম, মুমিনুল আর মিঠুনরা আবারো পুল খেলতে গিয়ে আর অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ অপ্রয়োজনীয় ফ্লিক খেলতে গিয়ে ক্যাচ তুলে দিয়েছেন । এ শট খেলার মানসিকতা বদলানো আর এমন প্রবণতা বন্ধ খুব জরুরী। না হয় প্রতিকূল কন্ডিশনে কঠিন প্রতিপক্ষের সঙ্গে ড্র করা খুব কঠিন হবে।

এআরবি/এসএএস/আরআইপি