বিশেষ প্রতিবেদন

প্রথমদিন থেকে এখনও চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছি

বাবা সাবেক সেনাপ্রধান। তাই সেনাবাহিনীর প্রতি ভালোলাগাটা ছিলই। সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে বাবার আগ্রহকেও সানন্দে মেনে নেন। কিন্তু সেনাবাহিনীর মতো দুঃসাহসিক সংস্থার প্রতিটি কঠিন ধাপ পেরিয়ে নিজেকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়াটা ভাবনার মতো অত সহজ ছিল না।

Advertisement

কিন্তু সেই কঠিন কাজটি সফলতার সঙ্গে করেছেন সোফিয়া জেরিন। যার বর্তমান পরিচয় লেফটেন্যান্ট কর্নেল সোফিয়া জেরিন। নারী হিসেবে যে পাঁচজন সেনাবাহিনীর এ উচ্চপদে আসীন হয়েছেন জেরিন তাদের একজন। নিয়মিত বাহিনীতে এটাই এখন নারীদের সর্বোচ্চ অবস্থান।

লেফটেন্যান্ট কর্নেল জেরিন এখন ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের ১০ সিগন্যাল ব্যাটালিয়নের কমান্ডিং অফিসার। বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমির (বিএমএ) ৪৭তম দীর্ঘমেয়াদি কোর্সে আরও ৩০ জন নারীর সঙ্গে প্রশিক্ষণ নেন তিনি। এরপর যোগদেন সেনাবাহিনীতে। পরিশ্রম, দক্ষতা আর যোগ্যতায় তিনি এখন নারী অগ্রযাত্রার একজন সফল সৈনিক।

বাবা জেনারেল মুস্তাফিজুর রহমান সেনাবাহিনীর প্রধান ছিলেন একসময়। রংপুরে বাবার আদি নিবাস হলেও তার চাকরিসূত্রে জেরিনের বেড়ে ওঠা দেশের বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টে। তিন বোনের মধ্যে ছোট, শান্ত এবং সবার আদুরে জেরিনের প্রশিক্ষণের দিনগুলো ছিল একেবারেই আলাদা।

Advertisement

সেনা সদর দফতরে বসে জাগো নিউজের সঙ্গে আলাপকালে সেসব দিনের কথাই স্মরণ করছিলেন তিনি। বলেন, ‘শুরু থেকেই অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছি। আমরাই সেনাবাহিনীতে প্রথম ব্যাচ, পুরুষদের সঙ্গে আমরা প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করেছি। কমিশন পাওয়ার পর যখন ইউনিটে জয়েন করলাম তখনও অনেক চ্যালেঞ্জ ছিল। সব সেনা সদস্যদের মধ্যে আমরাই নারী ছিলাম।’

জেরিন বলেন, ‘বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমিতে পুরুষ সদস্যদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে প্রশিক্ষণ নিতে হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘সেনাবাহিনীতে কঠোর পরিশ্রম। আমাদের সময়ে স্কুল কলেজে মেয়েদের জন্য এত খেলাধুলা ছিল না। হয়তো ছোটখাট সহজ খেলা খেলেছি। এত পরিশ্রমীও ছিলাম না। কিন্তু সেনাবাহিনীতে প্রশিক্ষণ চলাকালে যে মাইল টেস্ট দিতে হয়েছে তখন অসীম সময় দেয়া হতো না। সাত মিনিটে এক মাইল দৌড়াতে হতো। ১৬ কিলোমিটারও দৌড়াতে হয়েছে আমাদের।’

জেরিনদের ব্যাচে ৩০ জন নারী প্রশিক্ষণ নেন। তারাই সেনাবাহিনীর ইতিহাসে যোগ দেয়া প্রথম নারী। অনেক নারী থাকায় প্রশিক্ষণের কঠিন সময় কিছুটা সহজ হয়ে যায়।

Advertisement

তিনি বলেন, ‘কিন্তু চাকরিতে যোগদানের পর একটা ইউনিটে একজন বা সর্বোচ্চ দু’জন নারী অফিসার থাকে। বাকি সবাই পুরুষ। তাদের সঙ্গে কাজ করতে হয়েছে। সেখানেও নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয়েছে। তখন অনেক সমস্যা নিজেকেই সমাধান করতে হয়েছে। অনেক কিছুই থাকে যা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে উপস্থাপনই করতে পারিনি। এগুলো এখন অনেক কিছুই সহজ হয়ে গেছে। কারণ, আমরা আস্তে আস্তে উপরে উঠছি।’

তবে উচ্চপদে আসীন হওয়ার পরও এ চ্যালেঞ্জ শেষ হয়নি বলে মনে করেন তিনি।

জেরিন বলেন, ‘এটা বলব না যে, আমাদের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা শেষ হয়ে গেছে। আসলে প্রথমদিন থেকে এখন পর্যন্ত প্রতিদিন চ্যালেঞ্জই আমরা মোকাবেলা করছি। তবে আমরা যে পথ তৈরি করছি, নতুন প্রজন্ম এখন সে পথেই এগিয়ে আসছে।’

তার মতে, ‘চ্যালেঞ্জ থাকবে, সেগুলো মোকাবেলা করেই আমরা এগিয়ে যাব।’

জেরিন বলছিলেন, ‘এখন আমাদের নারী অফিসাররা অনেক সুবিধাই পাচ্ছেন যেটা আমাদের ছিল না। নারীরা কেউ এখন পিছিয়ে নেই। সেটা যে প্রতিষ্ঠানের কথাই বলেন না কেন, সবখানেই নারীরা এগিয়ে যাচ্ছে।’

প্রথম নারী হিসেবে সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়ার অনুভূতির কথা বলতে গিয়ে তিনি জানান, ‘একসঙ্গে ভালোলাগা এবং ভয় দুটো অনুভূতিই ছিল।’

‘প্রথম সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে যাচ্ছি। জায়গাটা কেমন হবে- এ বিষয়ে কারো কাছ থেকে কোনো ব্রিফিং পাইনি। আমাদের জন্য সহজ হবে, না কঠিন হবে সেসব বিষয়ে কোনো ধারণা আমাদের কেউ দিতে পারেনি। সহজ করার জন্য কি প্রস্তুতি নিয়ে যাব, সেসব কিছুই আমরা জানতে পারিনি,’ বলছিলেন তিনি।

আর ভাললাগা? এ প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে কিছুটা স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন জেরিন। মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে তার।

বলেছিলেন, ‘সেনাবাহিনীর নিয়ম অনুযায়ী কমিশন প্রাপ্তির দিন বাবা-মা এসে আমাদের র‌্যাংক পরান। তার আগে আমাদেরকে র‌্যাংকটি দেয়া হয়। সেটা আমাদের পকেটে থাকে। সেদিন জরুরি কাজ থাকায় বাবা আসতে পারেননি। মা এসে বললেন, তোমার র‌্যাংকটি লাগবে না। আমি তোমার বাবারটি নিয়ে এসেছি। যেটা তোমার বাবা নিজে হাতে পরিস্কারও করে দিয়েছেন।’

‘সেদিনের ভালো লাগাটা কাউকে বলে বোঝানো যাবে না। এটা একটা অন্যরকম ভালো লাগা যে, বাবার র‌্যাংকটাই পরে তার স্বপ্ন পূরণ করতে পেরেছি,’ উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলতে থাকেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল জেরিন।

নতুন প্রজন্মের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘নিজের যোগ্যতাকে ছোট করে দেখা ঠিক নয়।’ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মতো দুঃসাহসিক সংস্থায় যোগদান করতে এবং সব বিপদ আপদকে অতিক্রম করতে স্বপ্ন দেখার আহ্বান জানান লেফটেন্যান্ট কর্নেল জেরিন।

জেপি/এনডিএস/পিআর