নাসরিন সুলতানা (৩৮) ভোলার প্রথম সফল ও স্বাবলম্বী কৃষাণী। তিনি ভোলা সদর উপজেলার চর সেমাইয়া ইউনিয়নের ৮নং ওয়ার্ডের মহিউদ্দিন হাজি বাড়ির মো. জামাল হোসেন হারুনের স্ত্রী। দীর্ঘদিন ধরে তিনি অনেক দুঃখ কষ্টের সঙ্গে সংগ্রাম করে সফল হয়েছেন। তার সফলতা দেখে স্থানীয়সহ জেলার অনেক নারী নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য জীবন যুদ্ধ করে যাচ্ছেন। সফলও হয়েছেন অনেকে।
Advertisement
নাসরিন সুলতানা তার জীবনের দুঃখ, কষ্ট ও সফলতার কাহিনী জানান জাগোনিউজ২৪.কমকে। তিনি বলেন, তার বাবার বাড়ি চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলার ঠাকুর চর খান বাড়ি। তার বাবা গোলাম মোস্তফা খান ১৯৮৬ সালে মারা যান। তখন তিনি ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়াশুনা করেন। ছয় বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। বাবার মৃত্যুর পর অভাবের কারণে বড় বোনের বাড়ি ভোলার শহরের ওয়েস্টার্ন পাড়া এলাকায় থেকে পড়াশুনা করতেন।
১৯৯৫ সালে ভোলা সরকারি ফজিলাতুননেছা মহিলা কলেজ কলেজ থেকে ডিগ্রি পাস করেন। এরপর ১৯৯৬ সালে তার বিয়ে হয় জামাল হোসেনের সঙ্গে। জামাল হোসেন ঢাকায় একটি বেসরকারি চাকরি করতেন। বিয়ের মাত্র তিন বছর পর ১৯৯৯ সালে তার চাকরি চলে যায়। এরপর শুরু হয় স্বামীর সংসারে অনেক অভাব। অনেক কষ্টে কাটতে থাকে তাদের জীবন। অভাব দূর করতে চাকরির জন্য বিভিন্ন অফিসে আবেদন করলেও চাকরি জুটেনি তার। পরে ২০০০ সালে স্বামীর কিছু জমি ও স্থানীয়দের কাছ থেকে বর্গা নেয়া কিছু শুরু করেন কৃষি কাজ। ওই সময় তার স্বামী অসুস্থ থাকায় কাজে সহযোগিতা করতে পারেননি তিনি।
তিনি বলেন, প্রথম প্রথম স্থানীয় লোকজন আমার ব্যাপারে অনেক সমালোচনা করতো। বলতো ঘরের বউ হয়ে শিক্ষিত গৃহবধূ এখন জমিতে কামলা দিচ্ছে। কিন্তু আমি তাদের কোনো কথায় কানে দেইনি। সব সময় নিজে কীভাবে সফল হবো এটাই চিন্তা করতাম। তবে আমার স্বামী কারও কথায় কোনো কান না দিয়ে আমাকে এ কাজে উৎসাহ দিতেন।
Advertisement
প্রথমে তিনি প্রায় এক একর জমিতে ধান চাষ শুরু করেন। নিজে জমিতে গিয়ে ধানের বীজ রোপন করেন। কীটনাশকও দেন তিনি। ধান পাকার পর একাই কাটেন তিনি। এতে ভালো লাভ হয় তার। পরে ওই জমিতে তিনি রবি মৌসুমে মুখ ডাল, ভুট্টা ও কচু চাষ শুরু করেন। ধান চাষে টাকার অভাবে শ্রমিক না নিতে পারলেও রবি মৌসুমে একজন শ্রমিক নিয়ে নিজেই আবারও মাঠে নেমে পরেন। এছাড়া জমির পাশাপাশি নিজের বাড়ির আঙিনায়ও বিভিন্ন ধরনের সবজি চাষ করেন তিনি। রবি মৌসুমেও ভালো লাভ হয় তার। এরপর থেকে তাকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি।
কিছুদিন পর তার স্বামী জামাল হোসেন সুস্থ হয়ে উঠেন এবং তিনি ঢাকায় কাজ করার জন্য যেতে চাইলে নাসরিন তার সঙ্গে কৃষি কাজে সহযোগিতা করার জন্য বলেন। এতে তিনি রাজি হয়ে যান। এরপর তারা দুইজন মিলে বড় পরিসরে শুরু করেন কৃষি কাজ। এতে অল্পদিনেই তারা সফলতা অর্জন করেন। সংসার পরিচালনা করার পর লাভের টাকা দিয়ে স্বামী-স্ত্রী মিলে ওই এলাকায় ১ একর জমি ক্রয় করেন। তারপর নিজেদের জমি ও অন্যের কাছ থেকে আরও ২ একক জমি নিয়ে আরও বড় পরিসরে চাষাবাদ করতে থাকেন তিনি।
নাসরিন সুলতানা আরও বলেন, অনেক পরিশ্রমের মাঝে তিনি ২০০৯ সালে মাস্টার্স করেন। বর্তমানে তিনি ভেদুরিয়া ইউনিয়নের ব্যাংকের হাট এলাকায় ভেদুরিয়া সমবায় বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষিকা হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। এখন তিনি নিজে তার স্বামীকে নিয়ে কৃষি কাজ করছেন। কৃষি কাজে প্রতি বছর তার কয়েক লাখ টাকা লাভ হচ্ছে। এছাড়াও তিনি স্থানীয় কৃষক ও কৃষাণীদের বিভিন্ন ফসলের বিষয়ে পরামর্শ দিয়ে তাদের সফল করার জন্য সহযোগিতা করেন।
তিনি বলেন, প্রথম দিন থেকেই তিনি ভোলা জেলা ও সদর উপজেলার কৃষি কর্মকর্তাদের সহযোগিতা পেছেন বলেই তিনি আজ সফল। নাসরিন সুলতানা চর সেমাইয়া ইউনিয়নের কৃষি তথ্য সেবা কেন্দ্র ও এআইসিএম কৃষি ক্লাবের মাধ্যমে কৃষক ও কৃষাণীদের সব ধরনের সেবা ও সহযোগিতা করে আসছেন।চর সেমাইয়া ইউনিয়নের ৭, ৮ ও ৯নং ওয়ার্ডের মহিলা ইউপি সদস্য ও একই বাড়ির প্রতিবেশী শাহিদা আক্তার বলেন, নাসরিনের স্বামীর চাকরি চলে যাওয়ার পর তার সংসারে অনেক অভাব ও কষ্ট ছিল। কিন্তু নাসরিন সাহসী নারী থাকায় সব সময় কষ্টগুলোকে সহজভাবে দেখেছে। নিজের কষ্টে থাকলেও প্রতিবেশীদের কাছ থেকে আর্থিক কোনো সহযোগিতা নেয়নি। সব সময় সে নিজের ভাগ্য পরিবর্তন করার জন্য কাজ করেছে। একজন গ্রামের গৃহবধূ হয়ে সে মাঠে গিয়ে চাষ করেছেন। এটা গ্রামের মানুষ ও প্রতিবেশীরা সহজভাবে নেয়নি। তারা সব সময় নাসরিনকে নিয়ে সমলোচনা করেছেন। কিন্তু নাসরিন কারও কথায় কোনো প্রতিবাদ না করে নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। আর তার ফলেই সে সফল হয়েছে। আমাদের গ্রামের অনেক নারী এখন তার কাছ থেকে পরামর্শ নেয়ার জন্য ছুটে আসে। নাসরিনের কাছ থেকে অনেকে এসে সফল হয়েছে। গ্রামের নারীরা যে সকল বাধা অতিক্রম করে সফল হতে পারে তারই দৃষ্টান্তরমূলক উদাহরণ নাসরিন সুলতানা। সে আমাদের নারী সমাজের জন্য গর্ব।
Advertisement
প্রতিবেশী কৃষক ছালাউদ্দিন বলেন, নাসরিন সুলতানা যখন মাঠে গিয়ে কৃষি কাজ শুরু করে। তখন আমরা তাকে নিয়ে অনেক মজা করছি। কিন্তু সে কখনও রাগ হয়নি। আমরা পুরুষরা যে কাজ ১০ জনে মিলে করতাম। নাসরিন টাকার অভাবে সে কাজ একা একা করতো। এ ক্ষেত্রে নানা সমস্যা নিয়ে আমাদের সঙ্গে আলাপ করতো। তখন আমরা তাকে কৃষি অফিসরদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলি। তিনি আরও বলেন, তার মনের জোর বড় থাকায় সে সহজে সফল হয়েছে।
নাসরিন সুলতানার স্বামী মো. জামাল হোসেন হারুন বলেন, আমি আমার স্ত্রীর সফলতায় গর্বিত। আমার সংসারে যখন অভাব ছিল তখন সে কষ্টের মাঝেও সব সহজ করে দেখেছে। আমাকে যখন সে বলেছে যে কৃষি কাজ করবে। যখন আমি তাকে বলছি এটা খুবই কষ্টের কাজ। অনেক টাকা লোকসান হতে পারে। এ পরিস্থিতিতে যদি আমাদের লোকসান হয় তাহলে আমরা একদম শেষ হয়ে যাব। কিন্তু নাসরিন এক কথায় বলেছে লোকসান যাতে না হয় সেজন্য সে সব ধরনের কষ্ট করবে। আমি ওই সময় র্দীঘদিন অসুস্থ থাকায় তার পাশে থেকে সহযোগিতা করতে পারিনি। গ্রামের লোকজন তার কাজ করা ভালোভাবে নেয়নি। অনেকে আমাদের নিয়ে বাজে মন্তব্য করেছে। নাসরিনকে বলেছি, কিন্তু সে বলেছে আমরা যখন সফল হবো তখন তো আর কেউ বাজে কথা বলবে না। তাই আমিও তার কথা একমত হলাম।
ভোলা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক বিনয় কৃষ্ণ দেবনাথ বলেন, নাসরিন সুলতানা ভোলার নারী কৃষাণীদের জন্য একটি উৎসাহ। তাকে অনুকরণ করে গ্রামের অনেক নারী-পুরুষের পাশাপাশি কৃষি চাষ করে সফলতা অর্জন করেছেন। আমরা সবাই সব ধরনের সহযোগিতা করেছি। এছাড়াও উন্নত প্রশিক্ষণ ও উন্নত জাতের বীজও প্রদান করছি। বর্তমানে ভোলা জেলার কৃষি খাতের উন্নতির জন্য পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও ভূমিকা রাখছে।
জুয়েল সাহা বিকাশ/এমএএস/পিআর