গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের একজন কর্মকর্তা মৌসুমি বাইন হীরা। বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস) ৩০তম ব্যাচের প্রশাসন ক্যাডারের এই নারী কর্মকর্তা বর্তমানে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ব্যাংকার বাবা-মায়ের দ্বিতীয় সন্তান হীরা ছোটবেলা থেকেই একটি শব্দ তার হৃদয়ে লিপিবদ্ধ করে রেখেছিলেন। সেই শব্দটি ‘চিকিৎসক’।
Advertisement
মানুষকে দেয়া চিকিৎসকদের সেবা আকৃষ্ট করে হীরাকে। সেই থেকে নিজে চিকিৎসক হয়ে মানুষকে সেবা দেয়ার নেশা তৈরি হয় তার মনে। এজন্য অবশ্য বিজ্ঞান বিভাগ নিয়েই পড়ালেখা করেন তিনি। তবে শেষ পর্যন্ত আর চিকিৎসক হয়ে ওঠা হয়নি তার। অবশ্য সেজন্য আক্ষেপ নেই হীরার। কেন না, চিকিৎসা সেবার বদলে মানুষকে এখন সরকারি নানান সেবা দিয়ে যাচ্ছেন বিরামহীনভাবে। আর এটাই যেন তার আত্মতৃপ্তি।
বৃহস্পতিবার সকালে নিজ কার্যালয়ে নিজের কর্মজীবন আর চিকিৎসকের স্বপ্ন থেকে সরে গিয়ে কীভাবে বিসিএস ক্যাডার হলেন সেই গল্প জাগো নিউজকে শুনিয়েছেন ইউএনও মৌসুমি বাইন হীরা।
গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলার বাইরপাড়া গ্রামের কৃষ্ণ চন্দ্র বাইন ও লীরা রাণী মজুমদার দম্পতির তিন সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয় মৌসুমী বাইন হীরা। হীরার বাকি দুই বোনের একজন চাকরি করেন মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে, আরেকজন ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশোনা করছেন ঢাকায়।
Advertisement
বাবা-মা দুজনই ঢাকায় জনতা ব্যাংকে চাকরি করার সুবাদে হীরার বেড় ওঠা-শিক্ষা জীবন কেটেছে ঢাকাতেই। মুক্তিযোদ্ধা বাবা কৃষ্ণ চন্দ্র বাইনকে নিজের আদর্শ মনে করেন হীরা। হৃদয়ের গভীরে চিকিৎসক হওয়ার যে স্বপ্ন বুনেছিলেন তাতে সায় ছিল বাবা-মা দুজনেরই। এজন্য বিজ্ঞান বিভাগ নিয়ে পড়ালেখা করেন তিনি।
হীরা জানান, ২০০০ সালে ঢাকার ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি গার্লস হাইস্কুল থেকে এসএসসি এবং ২০০২ সালে বেগম বদরুন্নেছা সরকারি মহিলা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন তিনি। এরপর চিকিৎসা বিদ্যা নিয়ে পড়ার জন্য মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষা দেন। তবে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হওয়ার কারণে চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন ভেঙে যায় তার। এক বছর পর তিনি ভর্তি হন শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে।
হীরা আরও জানান, অনার্স দ্বিতীয়-তৃতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় ভাই-বোনদের বিসিএস পরীক্ষা দিতে দেখে তিনি নতুন করে স্বপ্ন দেখেন বিসিএস ক্যাডার হওয়ার। অবশ্য বাবা-মাও তাকে বিসিএস ক্যাডার হওয়ার ব্যাপারে অনুপ্রেরণা দেন। পরে অনার্স-মাস্টার্স সম্পন্ন করার পরপরই ৩০তম বিএসএস পরীক্ষায় অংশ নেন তিনি। মেধাবী হীরার প্রথমবারই বিসিএস ক্যাডার হওয়ার স্বপ্ন পূরণ হয়। তিনি প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা হিসেবে ২০১২ সালের ৩ জুন রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে যোগ দেন। সেখান থেকে সহকারী কমিশনার হিসেবে নাটোর জেলায় তাকে পদায়ন করা হয়।
নাটোরে চার বছর কাজ করার পর সেখান থেকে ২০১৬ সালে সহকারী কমিশনার (ভূমি) হিসেবে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ে যোগ দেন। এরপর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল ও নবীনগর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর গেল বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি আশুগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মর্তা (ইউএনও) হিসেবে যোগদান করেন হীরা।
Advertisement
আশুগঞ্জে যোগদানের পরপরই তিনি আলোচিত হয়ে উঠেন অবৈধ দখলদারদের হাত থেকে সরকারি সম্পত্তি উদ্ধার করা নিয়ে। স্থানীয় প্রভাবশালীদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করেই হীরা তার কাজ সরকারি দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। তার কাজগুলোর মধ্যে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের আশুগঞ্জ গোলচত্বরের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ, মহাসড়ক সংলগ্ন সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সামনে জেব্রা ক্রসিং নির্মাণ, কাঁচারি বিথির আধুনিকায়ন ও উপজেলা পূর্ব বাজারের খাস পুকুর খনন করে সৌন্দর্য বর্ধন এবং উপজেলার স্টেশন রোড ও শরীয়তনগরের ময়লা-আবর্জনার ভাগাড় অপসারণ অন্যতম।
চিকিৎসক না হতে পারায় আক্ষেপ নেই জানিয়ে হীরা বলেন, মানুষের সেবা করার জন্যই চিকিৎসক হতে চেয়েছিলাম। বিসিএস ক্যাডার হয়ে এখন মানুষকেই সেবা দিয়ে যাচ্ছি। এজন্য মনে দুঃখ নেই। আর এটাই আমার প্রাপ্তি। কাজ করতে গেলে কিছু বাধার সম্মুখীন হতেই হয়। তারপরও সব বাধা অতিক্রম করে আমাদের কাজ করতে হবে। প্রভাবশালীদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করেই কাজ করতে হয়েছে এবং এভাবেই করতে হবে।
এমএএস/পিআর