নারী ক্ষমতায়নের সুবর্ণ যুগে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নারী প্রার্থীদের মনোনয়ন দেয়া ও তাদের বিজয়ী হওয়ার সংখ্যা বাড়ছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সংখ্যা সদস্য এবারই সরাসরি নির্বাচিত হয়ে সংসদে গেছেন। তবে সেই অনুপাতে মন্ত্রিসভায় তাদের সংখ্যা বাড়েনি।
Advertisement
জানা যায়, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৬৭ জন নারী প্রার্থী ৬৮টি নির্বাচনী এলাকায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। আর বিজয়ী হন ২৩ জন। এই ২৩ জনের মধ্যে ২০ জন আওয়ামী লীগ থেকে, দু’জন জাতীয় পার্টি এবং একজন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ থেকে নির্বাচিত হন।
অন্যদিকে বিগত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২৯ জন প্রার্থীর মধ্যে ২২ জন (২০১৪) নারী এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। এর মধে আওয়ামী লীগের ১৮ জন জাতীয় পার্টির ৩ জন ও ওয়ার্কাস পার্টির একজন এমপি ছিলেন।
তবে নারী এমপিদের মধ্যে নতুন মুখের খুব অভাব। এবার নির্বাচিতদের মধ্যে আওয়ামী লীগের তিনজন ছাড়া সবাই পুরানো মুখ। এ নতুন তিনজন হলেন-কুমিল্লা ২ আসন থেকে নারী উদ্যোক্তা সেলিমা আহমাদ, কিশোরগঞ্জ-১ আসন থেকে সৈয়দা জাকিয়া নুর এবং কক্সবাজার ৪ আসন থেকে শাহীন আকতার চৌধুরী। মাদক ব্যবসায় সঙ্গে সম্পৃক্ততার কারণে শাহীন আকতারের স্বামী আবদুর রহমান বদির পরিবর্তে তাকে মনোনয়ন দেয় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।
Advertisement
এ বিষয়ে জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, ‘বর্তমানে বাংলাদেশ নারীর ক্ষমতায়নে বিশ্বে সপ্তম স্থানে অবস্থান করছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক দূর এগিয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে নারী পুলিশের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা বাংলাদেশের নারীর ক্ষমতায়নকে আরও সুদৃঢ় করেছে। তবে প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, প্রতিরক্ষা বাহিনীসহ সব ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে নারীদের অংশগ্রহণ আরও বাড়াতে হবে।’
স্বাধীনতার পর যত নারী এমপি
স্বাধীনতার পর প্রথম সংসদে (১৯৭৩) সরাসরি কোনো নারী এমপি নির্বাচিত হতে পারেননি। সেই সময় কাউকে মনোনয়নও দেয়া হয়নি। তবে সংরক্ষিত ১৫ জন নারী সদস্য ছিলেন সংসদে। দ্বিতীয় সংসদে (১৯৭৯) দু’জন এমপি নির্বাচিত হন। সেই সময়ের খুলনা-১৪ আসন থেকে সৈয়দা রাজিয়া ফয়েজ ও টাঙ্গাইল-১ আসন থেকে আশিফা আকবর নির্বাচিত হন। তৃতীয় সংসদে পাঁচজন (১৯৮৬), চতুর্থ সংসদে চারজন (১৯৮৮), পঞ্চম সংসদে ছয়জন (১৯৯১), ষষ্ঠ সংসদে তিনজন (১৯৯৬), সপ্তম সংসদে আটজন (১৯৯৬), অষ্টম সংসদে সাতজন (২০০১), নবম সংসদে ২১ জন (২০০৮)। ২০১৪ সালের দশম সংসদে ২৯ জন প্রার্থীর মধ্যে ১৮ জন নারী নির্বাচিত হয়ে এমপি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
সংসদের নারী নেতৃত্ব বাড়লেও বাড়েনি মন্ত্রিত্ব
Advertisement
সংসদের নারী নেতৃত্ব বাড়লেও এবার মন্ত্রিত্ব বাড়েনি। গত সংসদে চারজন নারী মন্ত্রী ছিলেন। এবারও চারজন মন্ত্রী হয়েছেন। এবার মন্ত্রিসভায় স্থান পাওয়া নারীরা হলেন-প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ডা. দীপু মনি, বেগম মন্নুজান সুফিয়ান ও বেগম হাবিবুন নাহার।
২০০৮ সালে মন্ত্রিপরিষদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকা ডা. দীপু মনি এবার পেয়েছেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। এর আগে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন নুরুল ইসলাম নাহিদ। আর প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে বেগম মন্নুজান সুফিয়ান। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী হলেন বেগম হাবিবুন নাহার।
বিগত মন্ত্রিসভায় প্রধানমন্ত্রীসহ পূর্ণমন্ত্রী ছিলেন কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী। আর প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে ইসমত আরা সাদেক, নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে বেগম মেহের আফরোজ চুমকি ও তথ্য মন্ত্রণালয়ে তারানা হালিম। এদের সবাই এবার বাদ পড়েছেন।
ফেনী-১ আসনে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল থেকে নির্বাচিত শিরিন আক্তার জাগো নিউজকে বলেন, ‘নারী ক্ষমতায়নের মূল সমস্যা সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি। এজন্য শুধু বাংলাদেশ নয়; বিশ্বসমাজ ব্যবস্থা ও যুগ যুগ ধরে চলে আসা কুসংস্কার ও ভুল ধারণা দায়ী। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম না। তবে আমাদের দেশে নারী ক্ষমতায়ন বাড়ছে। মন্ত্রিসভায় নারীদের সংখ্যা না বাড়লেও তাদের ক্ষমতা বেড়েছে-এটা বলা যায়। তবে সরকারকে এ ব্যাপারে সচেষ্ট হতে হবে। এখনো অনেক নারী আছেন যারা মন্ত্রিসভায় যোগ দেয়ার যোগ্যতা রাখেন।’
সংসদে সংরক্ষিত আসনের যত এমপি
প্রথম সংসদে সংরক্ষিত আসনের ১৫ জনই আওয়ামী লীগের, দ্বিতীয় সংসদে ৩০ জনই বিএনপির, তৃতীয় ও চতুর্থ সংসদে ৩০ জনই জাতীয় পার্টির, পঞ্চম সংসদে ২৮ জন বিএনপির ও দু’জন জামাতের ছিলেন। জোট সরকার ক্ষমতায় থাকায় দুটি আসন জামায়াতকে দেয় বিএনপি।
ষষ্ঠ সংসদে ১৫ ফেব্রুয়ারি বিএনপি সরকারের আমলে এক তরফা নির্বাচনের পর সংরক্ষিত নারী আসনের এমপিদের নির্বাচনের আগেই সংসদ ভেঙে দেয়া হয়। সপ্তম সংসদে ৩০ জন আওয়ামী লীগের, অষ্টম সংসদে বিএনপির ৩৬ জন, ইসলামী ঐক্যজোটের দু’জন ও জামাতের চারজন নারী এমপি ছিলেন। নবম সংসদে আওয়ামী লীগের ৪১ জন, বিএনপির পাঁচজন ও জাতীয় পার্টির চারজন এমপি ছিলেন।
দশম সংসদে আওয়ামী লীগের ৪২ জন, জাতীয় পার্টির ছয়জন, ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের একজন করে সংরক্ষিত আসনের এমপি ছিলেন। একাদশ জাতীয় সংসদে আওয়ামী লীগের ৪৩ জন, জাতীয় পার্টির চারজন, ওয়ার্কার্স পার্টির একজন এবং আরেকজন স্বতন্ত্র প্রার্থী রয়েছেন। বিএনপির এমপিরা শপথ না নেয়ায় তাদের নির্ধারিত একটি আসন এখনও শূন্য রয়েছে।
স্বাধীনতার প্রথম সংসদে সরাসরি ভোটে কোনো নারী সংসদ সদস্য নির্বাচিত হতে না পারলেও ঠিক তার পরের নির্বাচনেই দু’জন এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। এরপর সরাসরি নির্বাচন ছাড়াও সংসদে নারীদের প্রতিনিধিত্ব বেড়েছে।
জাতীয় সংসদ ও নির্বাচন কমিশনের পাঠাগারে রাখা বিগত দশটি জাতীয় সংসদের নির্বাচন সংক্রান্ত নথিপত্র, সংসদের আইন শাখা ও নোটিশ শাখা থেকে প্রাপ্ত তথ্য উপাত্ত পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, দেশে পর্যায়ক্রমে নারী নেতৃত্ব বাড়লেও আইন প্রণয়নে তাদের অংশগ্রহণ নেই। নারীদের এখনও সংসদের অলঙ্কার হিসেবে দেখছেন কেউ কেউ। আবার এর পাল্টা যুক্তিও এসেছে ওপর পক্ষ থেকে। তবে সব পক্ষই গণতন্ত্র সুসংহত করার জন্য নারী নেতৃত্ব বা ক্ষমতায়নের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন।
সংসদ নিয়ে গবেষণা করা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বুধবার জাগো নিউজকে বলেন, ‘নারীদের প্রতিনিধিত্ব বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। সংসদের সংরক্ষিত আসনের সংখ্যা দিন দিন বাড়লেও নেতৃত্বের গুণগত মান বাড়েনি।’
এইচএস/এনডিএস/পিআর