অর্থনীতি

আসছে নতুন বিনিয়োগকারী, আছে আতঙ্কও

প্রতিদিনই নতুন নতুন বিনিয়োগকারী বিনিয়োগ করছেন দেশের শেয়ারবাজারে। গত ছয় মাসে নতুন পুরুষ বিনিয়োগকারী এসেছে দেড় লাখের উপরে। আর নারী বিনিয়োগকারী এসেছে অর্ধলাখের বেশি। ব্যক্তি বিনিয়োগকারীর পাশাপাশি নতুন প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীও ঢুকছে শেয়ারবাজারে।

Advertisement

ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা শেয়ারবাজারমুখী হওয়ায় গত ছয় মাসে দেশের পুঁজিবাজারে নতুন বিনিয়োগকারীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২ লাখের উপরে। নতুন এ বিনিয়োগকারীর মধ্যে দেশে অবস্থান করা বিনিয়োগকারীরা যেমন রয়েছেন, তেমনি রয়েছেন প্রবাসী ও বিদেশি বিনিয়োগকারীও।

নতুন নতুন বিনিয়োগকারী শেয়ারবাজারে এমন স্রোতের মতো আসলেও সবার মধেই এক ধরনের আতঙ্ক বিরাজ করছে। ফলে সম্প্রতি অস্থিতিশীল অবস্থা দেখা দিয়েছে শেয়ারবাজারে। ব্যাংকের ঋণ আমানত অনুপাত (এডিআর) সমন্বয় নিয়ে এ আতঙ্ক বিরাজ করছে বলে বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।

সাইফুল ইসলাম নামে এক বিনিয়োগকারী বলেন, ‘চলতি মাসের ৩১ তারিখের মধ্যে ব্যাংকগুলোর এডিআর সমন্বয় করতে হবে। কিন্তু কয়েকটি ব্যাংকের এডিআর এখনও নির্ধারিত সীমার উপরে রয়েছে। বিভিন্ন মাধ্যমে জানতে পেরেছি, বাংলাদেশ ব্যাংক এবার এডিআর সমন্বয়ে আর সময় বাড়াবে না। তাহলে তো যেসব ব্যাংকের এডিআর নির্ধারিত সীমার বেশি তাদের শিগগিরই বিনিয়োগ উঠিয়ে নিতে হবে। এতে বাজারে অর্থের ফ্লো কিছুটা হলেও কমবে।’

Advertisement

জানা গেছে, এডিআর নিয়ে আগেও শেয়ারবাজারে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। ঋণপ্রবৃদ্ধি ব্যাপক হারে বাড়তে থাকায় গত বছরের ৩০ জানুয়ারি ব্যাংকগুলোর ঋণ-আমানত অনুপাত কমিয়ে একটি নির্দেশনা জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই নির্দেশনায় ৩০ জুনের মধ্যে এডিআর কমিয়ে প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলোর জন্য ৮৩ দশমিক ৫০ শতাংশ এবং ইসলামী ব্যাংকগুলোর জন্য ৮৯ শতাংশে নামিয়ে আনতে বলা হয়। আগে যা ৮৫ ও ৯০ শতাংশ ছিল।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই নির্দেশনা জারির পর শেয়াবাজারে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এতে এক মাস না যেতেই ওই বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি আরেকটি নির্দেশনা জারির মাধ্যমে এডিআর সমন্বয়ের সময় বাড়িয়ে ৩১ ডিসেম্বর করা হয়। তবে ব্যাংক মালিকদের পক্ষ থেকে এডিআর সমন্বয়ের সময় আরও বাড়ানোর দাবি জানানো হয়।

এ পরিস্থিতিতে গত বছরের ১ এপ্রিল ব্যাংক মালিকদের সংগঠন ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (বিএবি) সঙ্গে রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে অর্থমন্ত্রীর সভাপতিত্বে বৈঠক হয়। এতে গভর্নর ফজলে কবিরের নেতৃত্বে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি প্রতিনিধি দল অংশ নেয়। বৈঠকে বিএবির সদস্যরা এডিআর সমন্বয়ের সময়সীমা বাড়ানোর দাবি জানালে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এক প্রজ্ঞাপন জারি করে চলতি বছরের ৩১ মার্চ পর্যন্ত সময় বেঁধে দেয়।

এডিআর নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক থাকলেও শেয়ারবাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমানে দেশের অর্থনীতি ও শেয়ারবাজার যে অবস্থায় আছে তাতে বিনিয়োগকারীদের আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। বরং এখন শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের ঝুঁকি তুলনামূলক কম। তবে বিনিয়োগকারীদের অবশ্যই সতর্কতার সঙ্গে বিনিয়োগ করতে হবে।

Advertisement

এদিকে সেন্ট্রাল ডিপোজেটরি বাংলাদেশ লিমিটেড (সিডিবিএল)-এর তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের ৩ মার্চ পর্যন্ত বিও হিসাবের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৮ লাখ ৩৬ হাজার ৭৩৭টি। যা গত বছরের ১ আগস্ট ছিল ২৬ লাখ ১৬ হাজার ৯৪৫টি। অর্থাৎ ছয় মাসে নতুন বিও হিসাব বেড়েছে ২ লাখ ১৯ হাজার ৭৯২টি।

নতুন এ বিও হিসাবগুলোর মধ্যে ১ হাজার ৫৬টি প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী রয়েছে। বাকি সবগুলোই ব্যক্তি পর্যায়ের বিনিয়োগকারী। এরমধ্যে একক বিনিয়োগকারীর বিও হিসাব বেড়েছে ১ লাখ ২৫ হাজার ২৬৪টি। বর্তমানে একক বিও হিসাব আছে ১৭ লাখ ৮১ হাজার ৬২৯টি। গত ছয় মাসে যৌথ বিও হিসাব বেড়েছে ৯৩ হাজার ৪৭২টি। বর্তমানে যৌথ বিও হিসাব আছে ১০ লাখ ৪২ হাজার ১৬৪টি।

যৌথ ও একক বিও হিসাবের পাশাপাশি নারী ও পুরুষ বিনিয়োগকারী উভয় ধরনের বিও হিসাবের সংখ্যা বেড়েছে। তবে নারী বিনিয়োগকারীর তুলনায় পুরুষ বিনিয়োগকারী বেশি বেড়েছে।

গত ছয় মাসে পুরুষ বিনিয়োগকারীর বিও হিসাব বেড়েছে ১ লাখ ৫৮ হাজার ৬৯৬টি। আর নারী বিনিয়োগকারীর বিও হিসাব বেড়েছে ৬০ হাজার ৪০টি। সিডিবিএল’র ৩ মার্চের হিসাব অনুযায়ী, শেয়ারবাজারে পুরুষ বিনিয়োগকারীর সংখ্যা ২০ লাখ ৭০ হাজার ৩৯৬ জন এবং নারী বিনিয়োগকারীর সংখ্যা ৭ লাখ ৫৩ হাজার ৩৯৭ জন।

এডিআর সমন্বয়ের বিষয়ে ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ডিবিএ) সভাপতি শাকিল রিজভী বলেন, ‘এডিআর নিয়ে এক ধরনের আতঙ্ক থাকলে থাকতে পারে। আমি মনে করি, বারবার পলিসি পরিবর্তন করা ঠিক না। এডিআর সমন্বয়ের কারণে হয় তো বাজারে সাময়িক নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে, তবে দীর্ঘে মেয়াদে চিন্তা করলে তা বাজারের জন্য কোনো ক্ষতিকারক হবে না। কিন্তু বারবার পলিসি পরিবর্তন করলে তা ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।’

তিনি বলেন, ‘বর্তমানে বাজার যে উত্থান-পতন দেখা যাচ্ছে তা স্বাভাবিক। টানা এক মাস সূচক বাড়ার কারণে এখন কিছুটা মূল্য সংশোধন হচ্ছে। এতে বিনিয়োগকারীদের আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। আমি মনে করি, এডিআরের কারণে কিছু ব্যাংক টাকা তুলে নিলেও বাজারে কোনো ক্ষতি হবে না, যদি তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলো শেয়ারহোল্ডারদের ভালো লভ্যাংশ দেয়।’

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘একপ্রকার শান্তিপূর্ণ পরিবেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়ে গেছে। যে দল ক্ষমতায় ছিল নির্বাচনের মাধ্যমে সেই দলই আবার ক্ষমতায় এসেছে। এতে সরকারের ধারাবাহিকতা রক্ষা হয়েছে। ফলে এখন সব ধরনের বিনিয়োগ বাড়বে বলে আশা করা যায়। আর বিনিয়োগ বাড়লে শেয়ারবাজারে অবশ্যই ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। এ কারণেই হয় তো বাজারে নতুন নতুন বিনিয়োগকারী আসছে।’

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. বখতিয়ার হাসান বলেন, ‘শেয়ারবাজারে উত্থান-পতন স্বাভাবিক নিয়ম। বর্তমানে বাজারে উত্থানের থেকে পতন বেশি হলেও বিনিয়োগকারীদের আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। প্রতিনিয়তই বাজারে বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ বাড়ছে, এটা ভালো লক্ষণ। কারণ বাজারে বিনিয়োগকারী বাড়লে অর্থের ফ্লো বাড়ে।’

তিনি বলেন, ‘বাজারে বিনিয়োগকারীর সংখ্যা বাড়লে এক ধরনের ঝুঁকি বাড়ে। তবে বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগের বিকল্প মাধ্যম বেশি থাকলে ঝুঁকির মাত্রা কমে যায়। তাই এখন পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে ভালো ভালো কোম্পানি আইপিওতে আনার দিকে মনোযোগ দিতে হবে। বাজারে ভালো কোম্পানি যতবেশি থাকবে বিনিয়োগকারীদের ততো বেশি বিকল্প বিনিয়োগের সুযোগ থাকবে। এতে ঝুঁকির মাত্রাও কমে আসবে।’

বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সাইফুর রহমান বলেন, ‘বাজারের যেসব ইন্ডিকেটর আমরা দেখতে পারছি, সেগুলো পুঁজিবাজারের দিকে বিনিয়োগেরই ইঙ্গিত করে। নতুন বিনিয়োগকারী ক্রিয়েট (সৃষ্টি) হয়েছে। নতুন নতুন কোম্পানি আসবে, পাইপ লাইনে অনেক কোম্পানি আছে।’

এমএএস/এনডিএস/জেআইএম