গোটাবিশ্বই এখন যুদ্ধবাজ নেতৃত্বে ভরা। এ ধারাবাহিকতায় যুদ্ধাবস্থায় পাক-ভারত। দেশ দু’টিতে চূড়ান্ত যুদ্ধ বাঁধবে কি-না, সেটি ভবিতব্য। কিন্তু নগদে দুই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও ইমরান খান লাভবান। এরইমধ্যে তারা জিতে গেছেন যৌথভাবে।
Advertisement
যুদ্ধ ও কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, যুদ্ধংদেহী মনোভাব দেখালেও ভারত ও পাকিস্তানের যুদ্ধ অনিবার্য নয়। তবে, নিজদেশীয় রাজনীতিতে মোদি-ইমরান দু’জনের জন্যই একটি উত্তেজনাকর পরিস্থিতি জরুরি। পাক-ভারতের যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলার নেপথ্যে স্ব-স্ব স্বার্থ নিয়ে তারা এগুচ্ছেন বলে আলোচনা বেশ জমজমাট।
১৪ ফেব্রুয়ারি কাশ্মীরে ভারতের ৪৪ আধা সামরিক সেনা হারানোর ঘটনা জাতীয়তাবাদী উত্তেজনায় উদ্বেল হয়ে উঠেছে দেশটিতে। নরেন্দ্র মোদি সরকার দ্রুত এ উত্তেজনাকে ক্যাশ করতে সক্ষম হয়েছে। দেরি না করে ১২টি ভারতীয় যুদ্ধবিমান সীমান্ত অতিক্রম করে প্রায় ৬০ কিলোমিটার ভেতরে গিয়ে পাকিস্তাননিয়ন্ত্রিত ভূমিতে বোমা ফেলেছে। সেখানে ৩৫০ জঙ্গি হত্যার দাবি করেছে ভারত।
দাবিটি ভারতজুড়ে তাৎক্ষণিত তৃপ্তিভাব এনেছে। যদিও ২৬ ফেব্রুয়ারি যেখানে বোমা পড়েছে সেটা জাবা নামের জঙ্গলাকীর্ণ একটি গ্রাম মাত্র। সেখানে ৩৫০ জঙ্গি হত্যার যুতসহ প্রমাণ এখনো দাঁড় করাতে পারেনি ভারত। অন্যদিকে, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দুটি ভারতীয় যুদ্ধবিমান ফেলে দিয়ে পাইলটকে আটকে হিরোইজম দেখিয়েছে পাকিস্তান। পরে তাকে ছেড়ে দিয়ে হিরোইজমের সঙ্গে যোগ করেছে উদারতা-আন্তরিকতার প্রমাণ।
Advertisement
আজাদির আন্দোলনের নামে প্রায় ৯০ বছর ধরে উত্তাল কাশ্মীর। লাশের পর লাশ পড়ছে ভূ-স্বর্গ নামে পরিচিত-প্রচারিত অঞ্চলটিতে। বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সামরিকায়িত অঞ্চল মনে করা হয় কাশ্মীরকে। অন্যদিকে, জইশ-ই-মুহাম্মদ কিংবা আদিল আহমেদ ধর আকস্মিক সৃষ্ট সন্ত্রাসী গোষ্ঠি নয়। কেবল বিদায়ী বছরেই কাশ্মীরে ২৬০ জন স্থানীয় গেরিলার পাশাপাশি ভারতীয় ১৫০ সৈন্যও মারা গেছে। হতাহত বেসামরিক মানুষের সংখ্যাও প্রায় এমন। আবার পাকিস্তানের বালাকোটের বনাঞ্চলে কোনো কল্পিত লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালালেই কাশ্মীরে শান্তি এসে যাবে এমনও নয়।
পাকিস্তানে বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় বসেছেন ইমরান খান। আর ভারতে চলছে নির্বাচনী ভর মৌসুম। এপ্রিল-মে জুড়ে কয়েক দফায় হবে ভারতের জাতীয় নির্বাচন। লোকসভার পাশাপাশি অন্ধ্র, ওডিশা, সিকিম, অরুণাচল চারটি রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনও হবে এক সঙ্গে। নির্বাচনী প্রচারণায় বিজেপি পাকিস্তানে বোমাবর্ষণকে তার বিশাল সাফল্য হিসেবে প্রচার করছে। বিজেপির পাকিস্তান বিদ্বেষে বেশ সাড়া পড়েছে।
পাঁচ বছর ধরে ভিন্নমতাবলম্বী, ভিন্নধর্মাবলম্বীদের বিরুদ্ধে হামলা-মামলার সঙ্গে সরকার ও সরকারি দলের সংশ্লিষ্টতা থেকে বোঝাই যায়, একধরনের অসহিষ্ণুতার সংস্কৃতি ও রাজনীতিকে উসকে দেওয়া, তাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া ও স্থায়ী করা হচ্ছে বিজেপির উদ্দেশ্য। পুলওয়ামার হামলা সেই সুযোগ তৈরি করেছে।
মোদি সরকার পুলওয়ামার দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাকে রাজনৈতিক পুঁজিতে রূপান্তরিত করেছে, আরো করবে- এটা হিসাবেরই কথা। এই ঘটনার জবাব দেওয়ার নামে বিমান অভিযান চালানোর মধ্য দিয়ে মোদি দেখাতে চাইছেন তিনিই একমাত্র জাতীয়তাবাদী, ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা তার হাতেই সুরক্ষিত।
Advertisement
এর জেরে দেশজুড়ে কাশ্মীরি শিক্ষার্থী, ব্যবসায়ী ও চাকরিজীবীরা হামলার টার্গেটে পড়েছে। বাড়তি হিসেবে মুসলমান ঘৃণাও দেশটিতে নতুন করে চাঙ্গা হয়েছে। ভারতের বিরোধী দলগুলো বিজেপি ও মোদির কারসাজি বুঝলেও কুলাতে পারছে না। খেই হারিয়ে কিছু কিছু দল এরইমধ্যে কথিত এ জাতীয়তাবাদী উন্মাদনার সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে বিজেপির কৌশলের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে।
এ সুযোগে মোটা দাগের পলিটিক্যাল বেনিফিট ঢুকছে মোদির থলেতে। নিজ দেশের রাজনীতিতে এমন বেনিফিসিয়ারি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। তিনি কোন মার্কা নির্বাচনে, কাদের সঙ্গে আঁতাতে মসনদে বসেছেন সেই আলোচনা-সমালোচনা এ উছিলায় থেমে গেছে।
খাইবার-পাখতুনওয়ারায় প্রথম ভারতীয় হামলায় পাকিস্তানের নাগরিকেরা হতবিহ্বল থাকলেও দিন দুয়েকের মধ্যে ভারতীয় বিমান ভূপাতিত হওয়ায় যুদ্ধ-উন্মাদনার বাতিকে আক্রান্ত। বিভিন্ন শহরের রাজপথে মিষ্টি বিতরণের মধ্যে অন্যরকম জোস পাচ্ছে এই হিন্দুবিদ্বেষীরা।
ইমরান খানের জন্য এমন দৃশ্য সোনায় সোহাগা। জইশ-ই-মুহাম্মদ ২০০০ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর, বিশেষত গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে থাকে বলে অভিযোগ আছে। এই সংগঠনের নেতা মাসুদ আজহার পাকিস্তানে বসবাস করেন এবং অভিযোগ সত্ত্বেও তাঁকে কখনোই পাকিস্তানের সরকার বিচারের মুখোমুখি করেনি।
২০০১ সাল থেকে ভারতে একাধিক জঙ্গি হামলার জন্য জইশ-ই-মুহাম্মদ ও পাকিস্তানভিত্তিক আরেকটি জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তাইয়েবাকে ভারত দায়ী করে। কিন্তু পাকিস্তান এ অভিযোগ এড়িয়ে যায়। বলা হয়ে থাকে, সেই ধারাবাহিকতায় জঙ্গিগোষ্ঠীকে স্ট্র্যাটেজিক অ্যাসেট হিসেবে নিচ্ছেন ইমরান খানও।
এরমধ্যে আবার পাকিস্তানের হাতে ধরা পড়া ভারতীয় হামলাকারী পাইলট অভিনন্দনকে ফেরত দিয়ে উদারতার কাণ্ডারি ও শান্তিকামী রাষ্ট্রনায়কের ভূষণ পেয়েছেন তিনি। তার ক্ষমতার সিঁড়ি পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর হিম্মত ও ইমেজ বাড়াতে পেরেছেন বলেও প্রচার পাচ্ছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, ভারতের বিমান হামলা ছিল পাকিস্তানের সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন। ফলে পাকিস্তানিদের আহত আবেগের খোরাক ইমরান দিয়েছেন।
পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও ক্ষমতার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা এই ধরনের যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরির উপাদান হিসেবে কাজ করেননি তা বলা যায় না। ইমরান খান দেখাতে পারছেন, ক্ষমতার রাজনীতিতে নতুন হলেও তাঁর দেশপ্রেম প্রশ্নাতীত। দেশের নিরাপত্তার স্বার্থে যেকোনো ধরনের সামরিক পদক্ষেপে তিনি মোটেই পিছপা নন। পাকিস্তানের সাধারণ নাগরিক, সেনাবাহিনী ও ডিপ স্টেটের কাছে দরকারি হয়ে ওঠার বিশাল সুযোগ হয়েছে তার। ভারতের বুদ্ধিজীবীদের একাংশও ইমরানের নেতৃত্বের প্রশংসা করছেন।
পাক-ভারত বা ইমরান-মোদির এ যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায় সৈন্যের চেয়েও বেশি মারা পড়ছে কাশ্মীরিরা। সেই বিবেচনায় মূল দুর্যোগটা তাদেরই। এই যুদ্ধাবস্থার আগেই কাশ্মীরজুড়ে প্রতি ১০ জন বেসামরিক মানুষের বিপরীতে ছিল একজন ভারতীয় সৈন্যের অবস্থান। সেখানে নতুন করে ১০ হাজারের মতো সৈন্য মোতায়েন করেছে ভারত।
কাশ্মীরজুড়ে চলছে ব্যাপক ধরপাকড়, নিপীড়ন। ভূ-স্বর্গ নামের কাশ্মীরের প্রধান নেতাদের প্রায় সবাইকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কাশ্মীরজুড়ে ওষুধ, খাবারসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সংকট শুরু হয়েছে। ভারতীয় নেতৃত্ব, প্রশাসন এমন কি প্রচারমাধ্যমেরও এ নিয়ে ভ্রুক্ষেপ নেই। দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির জন্য মৌসুম। আর পাকিস্তানের ক্ষমতাসীনদের জন্য শুধুই ইস্যু। ইমরান খানের জন্য স্পিন বোলিংয়ের মওকা।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।
এইচআর/জেআইএম