বুকারজয়ী লেখিকা অরুন্ধতী রায় চৌধুরী বলেছেন শুধু ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পায় না। উপমহাদেশে সন্ত্রাসবাদ ছড়িয়ে যাওয়ার মূলে রয়েছে অন্ধ ধর্মবিশ্বাস আর অর্থনীতির ভ্রান্ত ধারণা।
Advertisement
মঙ্গলবার রাজধানীর মাইডাস সেন্টারে ছবিমেলার আয়োজনে ‘আটমোস্ট এভরিথিং’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় এমন মন্তব্য করেন ভারতের এই খ্যাতিমান লেখিকা। অনুষ্ঠানে তিনি বাকস্বাধীনতা, জাতীয়তাবাদ, উন্নয়ন, গণতন্ত্র, বড় বড় প্রকল্প এ সব কিছু নিয়ে কথা বলেন।
এ সময় প্রখ্যাত আলোকচিত্রী শহিদুল আলম তার পাশে বসা ছিলেন। নিবন্ধিত দর্শক-শ্রোতাদের নিয়ে ফার্মগেটের কৃষিবিদ ইনস্টিটিটিউশন মিলনায়তনে এই অনুষ্ঠানটি হওয়ার কথা থাকলেও পুলিশের বাধায় স্থান পরিবর্তন করা হয়। অনুষ্ঠানের শুরুতে তিনি একটি লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন। এরপর শহিদুল আলমের প্রশ্নের উত্তর দেন তিনি।
অরুন্ধতী রায় বলেন, ‘আমার দুটো সত্তা। একটি লেখক সত্তা ও অন্যটি কর্মী সত্তা। লেখক হিসেবে আমি বাংলাদেশের পাঠকের কাছে এসেছি’।
Advertisement
তিনি বলেন, ‘ভোট এল, রাজনীতিবিদরা দুয়ারে এসে উন্নয়নের ফিরিস্তি দিয়ে ভোট চাওয়া শুরু করল। তোমাদের কাছে এই হল গণতন্ত্র।’ তার মতে ‘গোটা উপমহাদেশের চিত্র আসলে একই। গণতান্ত্রিক চর্চা ভিন্ন হলেও এই চিত্রটা এখানে কেমন করে যেন মিলে যায়। গণতন্ত্র এভাবেই নষ্ট হয়ে যায়।’
অরুন্ধতীর মন্তব্য, ‘ধর্ম আর অর্থনীতি নিয়ে মানুষের মনে ব্যাপক আকারে ভ্রান্ত ধারণা জন্মানোয় ক্রমেই বাড়ছে সন্ত্রাসবাদ। সেই সঙ্গে বাড়ছে রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপ। আর তা মোকাবেলায় দেশগুলো যেন গণতন্ত্র ছেড়ে সামরিক পন্থা বেছে নিচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘আমি নদীকে কেন্দ্র করে বাঁধ কিংবা কোনো উন্নয়ন প্রকল্পে বিশ্বাসী নই। নদীকে ভাগ করা যায় না। বড় বড় বাঁধ নির্মাণের পেছনে ফ্যাসিবাদ আর জাতীয়তাবাদী চেতনা লুকানো থাকে।’
ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ট্রানজিট, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ নানা বিষয়ে জটিলতা প্রসঙ্গে ভারতের প্রগতিশীল গোষ্ঠী উচ্চকণ্ঠ নয় -এমন মন্তব্যর সঙ্গে পুরোপুরি একমত পোষণ করে লেখিকা জানান, তিনি জেনে–বুঝে এ বিষয়গুলো নিয়ে লিখছেন। প্রয়োজনে এই ইস্যুতে তিনি বাংলাদেশে আসবেন।
Advertisement
উন্নয়নের প্রথাগত ধারণার বাইরে ভাবেন অরুন্ধতী। তিনি বলেন, অক্সফামের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, ভারতে ৫০ কোটি লোকের সম্পদ পুঞ্জীভূত ৯ ব্যক্তির কাছে। তাই উন্নয়নের কথা এলে লোকজন জানতে চায়, কার জন্য উন্নয়ন।
উপমহাদেশের রাজনীতিবিদদের সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘কখনও কখনও তাদের উন্নয়ন কাজের জন্য জনগণকে অনেক মূল্য দিতে হয়। নীতির ঠিক থাকে না বলে উন্নয়নের নামে চলে সব বেআইনি কার্যক্রম।’
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রযুক্তির ছোঁয়া লেগেছে সাহিত্যাঙ্গনেও। তবে কি প্রযুক্তির আধিপত্যে সাহিত্যের আবেদন কমবে- এমন প্রশ্নে অরুন্ধতীর সাফ জবাব, সাহিত্যের উপাদান গুণগত মানসম্পন্ন হলে তার আবেদন কখনও ফুরাবে না।
তিনি বলেন, ‘লেখালেখি করতে এলে অবশ্যই এখন গুণগত মান নিয়ে ভাবতে হবে। যা তা লিখে ফেললেই হবে না। পাঠককে ভালো কিছু দেয়ার প্রবল ইচ্ছা থাকতে হবে। প্রযুক্তি যতই আসুক না কেন, পড়ুয়াদের কাছে সাহিত্যের আবেদন কখনোই ফুরাবে না।’
এই উপমহাদেশের মুক্তমনা লেখকরা তাদের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ নির্মাণে এখনও লড়াই করে যাচ্ছেন মন্তব্য করে অরুন্ধতী বলেন, ‘হাজারো সমস্যার পর লেখকরা টিকে থাকার লড়াই করছেন। কখনও তারা জেতেন, কখনও হারেন। আর হারের পর একেবারে বাস্তুচ্যুত হয়ে পড়েন কেউ কেউ। নোংরা লাগে ব্যাপারটা।’
তিনি বলেন, ভারতের হিন্দুত্ববাদীরা চায়, আমি তাদের মতো কথা বলি। প্রথম দিকে ব্যাপারটা খুব খারাপ লাগত। আমার জাতীয়তাবাদ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে বিভিন্ন সময়ে। আমার মতামত প্রকাশের পর চারপাশ থেকে ঘৃণাবাক্য বর্ষণ শুরু হল।’
গত বছর নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় গুজব ছড়ানোর অভিযোগে তথ্য প্রযুক্তি আইনের মামলায় শহিদুল আলম গ্রেফতার হওয়ার পর তার মুক্তির দাবিতে খোলা চিঠি লিখেছিলেন অরুন্ধতী রায়।
অরুন্ধতী রায়ের বাপ-দাদার ভিটে ছিল বরিশালে। প্রথম উপন্যাস ‘দ্য গড অব স্মল থিংস’ দিয়েই জিতে নেন ম্যান বুকার পুরস্কার। এর ২০ বছর পর প্রকাশিত হয় তার দ্বিতীয় উপন্যাস ‘দ্য মিনিস্ট্রি অব আটমোস্ট হ্যাপিনেস’।
দ্বিতীয় উপন্যাস প্রকাশে দুই দশকের দীর্ঘ বিরতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি আসলে এক মুক্ত মানুষ থাকতে চেয়েছি। এতটা চাপ নিতে চাইনি। প্রথম উপন্যাস লেখার পরই পরবর্তী উপন্যাস খুব দ্রুত প্রকাশ করে জনপ্রিয় হব, এই পুরস্কার পাব, সেই পুরস্কার পাব, এমনটা আমি কখনও ভাবিনি। এসব কঠিন ভাবনার মধ্যে আমি নাই।
এমএমজেড/জেআইএম