‘দুই দফায় চট্টগ্রামে দায়িত্ব পালন করছি। এ মহাসড়ক (ঢাকা-চট্টগ্রাম) দিয়ে যাওয়া কত ইয়াবা-হেরোইনের চালান জব্দ করেছি। কিন্তু এত বড় স্বর্ণের চালান! কখনো আমাদের হাতে ধরা পড়েনি। এভাবে ওপেন একটা সোনার চালান যেতে পারে তা আমরা কল্পনাও করিনি। আমার চাকরি জীবনে এমনটা ঘটেনি।’
Advertisement
সোমবার (৪ মার্চ) দুপুরে চট্টগ্রামের হালিশহর পুলিশ লাইন্সে সংবাদ সম্মেলনে এভাবেই নিজের বিস্ময়ের কথা জানান চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার (এসপি) নূরে আলম মিনা।
গতকাল রোববার (৩ মার্চ) ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের জোরারগঞ্জে জিপ তল্লাশি করে প্রায় ২৭ কোটি টাকা মূল্যের ৬০০ পিস স্বর্ণের বার উদ্ধারের ঘটনায় এ সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করা হয়।
রোববার দুপুরে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের জোরারগঞ্জে জেলা পুলিশ যখন সোনা চোরাকারবারিদের জিপটি জব্দের প্রস্তুতি নিচ্ছিল, ঠিক তখনই চট্টগ্রাম নগরের কোতোয়ালি থানার সিআরবি সাতরাস্তার মোড় থেকে অপর একটি প্রাইভেটকারে তল্লাশি চালিয়ে ১০০ পিস স্বর্ণের বার উদ্ধার করে নগর গোয়েন্দা পুলিশ। মাত্র দুই ঘণ্টার ব্যবধানে এত সংখ্যায় সোনার বার উদ্ধারের ঘটনায় উঠছে নানা প্রশ্ন। হটাৎ কেন চট্টগ্রামে তৎপর সোনা চোরাকারবারিরা?
Advertisement
অভিযোগ রয়েছে, চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরকে নিরাপদ রুট হিসেবে বেছে নিয়েছেন সোনা চোরাকারবারিরা। বিমান ও বিমানবন্দরের কর্মীদের সহায়তায় এ বন্দর ব্যবহার করে তারা মধ্যপ্রাচ্য থেকে অবৈধভাবে সোনা আনছেন।
সূত্র জানায়, ২০১৪ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত দেশের বিমানবন্দরে দেড় হাজার কেজির বেশি পরিমাণ সোনার বার জব্দ হয়। এ ছাড়া গত এক বছরে (চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত) শুধু চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সোনার বারের ১৪টি বড় চালান ধরা পড়ে। প্রায় ৮০ কেজি ওজনের এসব সোনার আনুমানিক মূল্য ৩৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এর মধ্যে গত নভেম্বরে ছয়টি চালানে মোট ৯ কেজি সোনা জব্দ করা হয়।
আশঙ্কার কথা হলো, গত এক বছরে বিমানবন্দর দিয়ে আসা ১৪ চালানে যে পরিমাণ সোনার বার জব্দ হয়েছে রোববার (৩ মার্চ) সড়কপথে জব্দ মাত্র দুই চালানেই তার চেয়ে বেশি সোনা জব্দ হয়। যার আনুমানিক মূল্য ৩২ কোটি ৫০ লাখ টাকা।
ঘটনা পরিক্রমায় দেখা যায়, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সোনা চোরাচালান জব্দের সংখ্যা বেড়েছে। তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগছে তাহলে কি অন্যকোনো উপায়ে দেশে সোনার চালান আসছে? আসলে তা চট্টগ্রামেই বা কেন? চট্টগ্রাম বন্দর, বঙ্গোপসাগর, বান্দরবান ও কক্সবাজারের সীমান্ত এলাকাকে কি সন্দেহের বাইরে রাখার সুযোগ আছে?
Advertisement
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জেলা পুলিশের এক কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সম্প্রতি মাদকের বিষয়ে জিরো টলারেন্স দেখাচ্ছে। টেকনাফ থেকে ফেনী পর্যন্ত এলাকা দিয়ে যেন কোনো প্রকার মাদক দেশে প্রবেশ করতে না পারে সে চেষ্টা করছে। র্যাব-পুলিশের এ ব্যস্ততাকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করতে পারে সোনা চোরাকারবারিরা। এ ছাড়া মহাসড়কে সব গাড়ি আলাদাভাবে চেকিংয়ের সুযোগ নেই, তাই প্রাইভেট গাড়িকে সোনা চোরাচালানে ব্যবহার করা হচ্ছে।’
এ বিষয়ে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেন নগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার (বন্দর) এসএম মোস্তাইন হোসেন। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে যেহেতু গোল্ড তৈরি হয় না, সেহেতু এসব গোল্ড অবশ্যই কোনো না কোনোভাবে বাইরে থেকে এসেছে। সেটা চট্টগ্রামের বিমানবন্দর ব্যবহার করে হতে পারে, অথবা অন্যভাবে। ইতোমধ্যে গ্রেফতার আসামিদের রিমান্ডের আবেদন করেছে পুলিশ। আশা করছি, অধিকতর জিজ্ঞাসাবাদে মূল ঘটনা জানা যাবে।’
তবে চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার নূরে আলম মিনা বলেন, ‘গ্রেফতার আসামিদের কাছ থেকে খুব সহজে কথা বের করা যাচ্ছে না। বিভিন্ন সময় আমরা জঙ্গিদের ইন্টারগেশনে নিয়ে গেলে তারা কথা বলে না। কোনো তথ্য দেয় না। গ্রেফতার সোনা চোরাচালানকারীরাও খুব শক্ত প্রকৃতির। গতকাল সারারাত জিজ্ঞাসাবাদে শুধু নিজেদের বিষয়ে ছাড়া আর কিছুই জানায়নি তারা।’
জানা গেছে, পাশের দেশ ভারতে সোনার আমদানি শুল্ক বৃদ্ধি এবং বিমানবন্দরসহ চট্টগ্রামকে নিরাপদ রুট বিবেচনাসহ নানা কারণে সোনার চোরাচালান সম্প্রতি বেড়েছে।
শুল্ক গোয়েন্দা সংস্থার সহকারী কমিশনার নাহিদ নওশাদ বলেন, ‘স্বাভাবিকভাবেই সোনা পাচারকারীরা যখন যেদিকে নিরাপদ মনে করে তখন সেই টার্মিনাল ব্যবহার করে। এখন বেশি তৎপর হওয়ায় হয়তো এখানে বেশি ধরা পড়ছে। এর পেছনে অন্য কোনো কারণ আছে কি না বলতে পারছি না।’
সূত্র বলছে, চট্টগ্রামকে সোনা চোরাচালানের নিরাপদ রুট হিসেবে বেছে নেয়ার অনেকগুলো কারণ আছে। এর অন্যতম কারণ প্রবাসী অধ্যুষিত চট্টগ্রামের অধিকাংশ মানুষ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে থাকে। শ্রমিক শ্রেণির এসব মানুষকে সহজেই সোনা চোরা চালানের বাহক হিসেবে ব্যবহার করা যায়।
বিশেষ করে চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি, রাঙ্গুনিয়া, রাউজান ও হাটহাজারী কেন্দ্রীক একটি বেল্ট এর পেছনে কাজ করে। বিগত সময়ে যেসব ফ্লাইট থেকে সোনার চালান জব্দ হয়েছে, তার সবগুলো মধ্যপ্রাচ্য, বিশেষ করে দুবাই থেকে চট্টগ্রাম হয়ে ঢাকা যাচ্ছিল। গতকাল দুটি পৃথক অভিযানে উদ্ধার ৭০০ সোনার বারের প্রতিটিতেই আরব আমিরাতের (ইউএই) সিল রয়েছে।
সম্প্রতি যেসব সোনার চালান জব্দ হয়েছে সেসব ঘটনায় আটক হয় বাহক। কিন্তু মূল হোতারা সব সময়ই থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে। কথিত আছে প্রবাসে বসেই এসব চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ করছে শক্তিশালী একটি চক্র।
নগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার (বন্দর) এস এম মোস্তাইন হোসেন বলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলা থেকে শ্রমিক হিসেবে যারা কাজ করছেন, চোরাচালান চক্রটি মূলত তাদের ব্যবহার করে থাকে। তারা দেশে আসলে এসব স্বর্ণবার তখন বহন করে নিয়ে আসে। বিনিময়ে তারা সামান্য টাকা পেয়ে থাকে।’
চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার নূরে আলম মিনা জাগো নিউজকে বলেন, ‘জোরারগঞ্জ থেকে আটক সোনা চোরাকারবারিরা জানিয়েছে তারা এ স্বর্ণবারগুলো ঢাকায় নিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে যা জেনেছি, গ্রেফতার করিম ও রাকিব দু’জনের বাড়ি চুয়াডাঙ্গা জেলার দর্শনাতে। সে হিসেবে তাদের বাড়ির পাশেই ভারত সীমান্ত। ধারণা করছি, করিম নিজেই সোনা চোরাচালান দলের সক্রিয় সদস্য। এ স্বর্ণবারগুলো চুয়াডাঙ্গা দিয়ে ভারতে পাচারের জন্য নিয়ে যাচ্ছিল। তার বিরুদ্ধে দর্শনা থানায় চোরাচালানের মামলাও আছে।’
‘এ ছাড়াও চট্টগ্রাম পার হলেই ফেনী, কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়াজুড়ে ভারত সীমান্ত। এ বিশাল সীমানার যেকোনো জায়গা দিয়েই তারা ভারতে সোনা পাচারের চেষ্টা করতে পারে। তাই চট্টগ্রাম থেকে সড়ক পথে সোনার চালান পৌঁছানো চোরাকারবারিদের জন্য সহজ লক্ষ্য হতে পারে,’ যোগ করেন পুলিশ সুপার নূরে আলম মিনা।
এনডিএস/জেআইএম