খেলাধুলা

আহা, এমন যদি প্রথম ইনিংসে হতো!

নিউজিল্যান্ডের মাটিতে আট বছর পর টেস্ট সেঞ্চুরি। সংখ্যাতত্ত্বে নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়া। টেস্টে আগে তিন তিনটি শতরানের ইনিংস টপকে সবচেয়ে বেশি ১৪৬ রান করে ফেলা। ভাল লাগার এক আদর্শ প্রেক্ষাপট। কোথায় ভাল লাগায় আচ্ছন্ন থাকবে দেহ-মন। চোখে মুখে ঝরবে মুক্তার হাসি। তা না, ম্যাচ শেষে গোমড়া মুখ মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের। পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে কয়েক মিনিটের ছোট্ট কথোপকোথনে এক মুহূর্তের জন্যও হাসতে পারলেন না।

Advertisement

বাংলাদেশ অধিনায়ক কথা বললেন ধরা গলায়। কেন এমন সাহসী আর সংগ্রামী সেঞ্চুরি উপহার দেয়ার পরও মনে সুখ নেই, চোখ-মুখে রাজ্যের হতাশা- তাও জানিয়ে দিলেন তিনি, ‘আসলে সব ব্যক্তিগত অর্জন পূর্ণতা পায় দল ভাল করলে। দল সফল হলে ব্যক্তিগত কৃতিত্ব বড় হয়ে দেখা দেয়। দল হারলে সব ব্যক্তিগত অর্জনই অর্থহীন হয়ে পড়ে।’

কণ্ঠে আক্ষেপ-অনুশোচনা। অল্প কথায় পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন, ‘আসলে প্রথম ইনিংসের ব্যাটিং ব্যর্থতা আর কম রানে অলআউট হওয়াইটাই ডুবিয়েছে। না হয় উইকেটটা ভাল ছিল। শুরুতে একটু আধটু সমস্যা হলেও তা কেটে যায়। গেছেও; কিন্তু আমরা সে সুযোগ কাজে লাগাতে পারিনি। প্রথম ইনিংসের স্কোরটা কম হয়ে গেছে। প্রথমবার বেশি রান করতে পারলে দৃশ্যপট ভিন্ন হতে পারতো।’

একদম খাটি কথা। হ্যামিল্টন টেস্ট যারা মন দিয়ে দেখেছেন, তারা সবাই একমত হবেন, সাকিবের অনুপস্থিতিতে বাংলাদেশকে টেস্টে নেতৃত্ব দেয়া মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ যথার্থই বলেছেন। সত্যি, দল হারলে শত ব্যক্তিগত কৃতিত্ব আর বড় অর্জনও ফিকে-ম্লান হয়ে যায়। তখন আর তা নিয়ে হৈ চৈ হয় না। সাড়া পড়ে না। ইতিহাসের খাতায়ও তেমভাবে লিখা থাকে না।

Advertisement

হ্যামিল্টন টেস্টে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ আর সৌম্য সরকার বুক চিতিয়ে লড়াই করেছেন। ধ্বংস্তুপের মাঝে দাঁড়িয়ে ডরে-ভয়ে অসহায় আত্মসমর্পন না করে তারা বীরের মত লড়ার চেষ্টা করেছেন। তাদের সে লড়াইয়ের কাহিনী কিন্তু ইতিহাসে লিখা থাকবে না। সবাই জানবে হ্যামিল্টনে বাংলাদেশ ইনিংস ও ৫১ রানে হেরেছে। সেটাই মনে থাকবে সবার। তাইতো মন খারাপ অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের।

শুধু রিয়াদ একা নন, এমন ঝলমলে ব্যাটিংয়ের পরও টিম বাংলাদেশের প্রতিটি ক্রিকেটার, কোচ, টিম ম্যানেজমেন্ট আর ভক্ত ও সমর্থক- কারো মুখেই হাসি নেই। মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের অধিনায়কোচিত শতক আর সৌম্য সরকারের সংগ্রামী সেঞ্চুরির পরও মন ভাল নেই কারো। অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহর মত মন খারাপ বাংলাদেশের ভক্তদেরও।

কারণ একটাই এমন একজোড়া শতক আর ২৩৫ রানের বিশাল জুটি কোনোটাই কাজে আসেনি। ম্যাচ বাঁচানো তো বহুদুরে ইনিংস পরাজয়ও এড়ানো যায়নি। মাহমুদউল্লাহকে আরও একটি আফসোস পোড়াচ্ছে। ভেতরে কাঁটার মত বিধছে।

ইস! এই ব্যাটিংটাই যদি প্রথম ইনিংসে হতো! তাহলে এমন ইনিংস পরাজয় নাও হতে পারতো। সেই উপলব্ধি থেকেই আজ টেস্ট শেষে বাংলাদেশ অধিনায়কের মুখে এমন অনুশোচনা, প্রথম ইনিংসে ২৩৪ রানের মামুলি সংগ্রহে অলআউট হওয়াতেই সর্বনাশ ঘটেছে। তাতেই ম্যাচ হেলে পড়েছে কিউইদের দিকে।

Advertisement

বাংলাদেশ অধিনায়কের উপলব্ধি শতভাগ ঠিক। ক্রিকেটীয় যুক্তি, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণও তাই বলছে। একটু খুঁটিয়ে দেখলেই পরিষ্কার হবে, টাইগাররা দ্বিতীয় ইনিংসে যে ব্যাটিং করেছেন, দ্বিতীয়বার রিয়াদ বাহিনীর সংগ্রহ যা, প্রথম ইনিংসে ঠিক এই রান মানে ২৩৪-এর বদলে ৪২৯ করতে পারলে খেলার চালচিত্র অন্যরকমও হতে পারতো।

অন্যরকম মানে, এমন ইনিংস পরাজয় ঘটতো না অন্তত। দেড়দিন আগেও খেলা শেষ হতো না। ম্যাচ নির্ঘাত পঞ্চম দিনে গড়াতো। আর বাংলাদেশের ইনিংস পরাজয়ের সম্ভাবনাও যেতো অনেক কমে।

কিভাবে? জানতে ইচ্ছে করছে? তাহলে দেখুন, শুনুন এবং জানুন- প্রথম ইনিংসে বাংলাদেশ ৫৯.২ ওভার ব্যাট করে তুলেছে ২৩৪ রান। আর পরের ইনিংসে ব্যাট করেছে ১০৩ ওভার। মানে ৪৩.৪ ওভার বেশি। ঘন্টা প্রতি ১৪ ওভার করে ধরলেও সময়ের হিসেবে অন্তত তিন ঘণ্টা সময় বেশি ব্যাট করেছে। পরের ইনিংসটি যদি প্রথম ইনিংসে হতো, বাংলাদেশের ইনিংস আর কোনোভাবেই প্রথম দিন চা বিরতির ঠিক পর শেষ হতো না।

ওই ইনিংস শেষ হতো দ্বিতীয় দিন প্রথম ঘণ্টার পর। তাতে করে দুটি কাজ হতো। এক) বাংলাদেশের বোর্ডে ২৩৪’র বদলে ৪২৯ রান জমা পড়তো। যা দলের মনোবল অন্যরকম থাকার বিশেষ করে বোলার ও ফিল্ডারদের উজ্জীবিত ও অনুপ্রাণিত করার খোরাক হতো। দল আরও চাঙ্গা থাকতো। বারবার মনে হতো আমরা চারশো রান করে ফেলেছি। আমাদের হাতে আছে ৪০০ প্লাস রানের পুঁজি। অন্যদিকে এতে করে কিউইরাও একটু হলেও চিন্তায় পড়ে যেত। খানিক সংযত, সতর্ক ও সাবধানি অ্যাপ্রোচ চলে আসতো। কারণ, তখন রান পাহাড় গড়ার আগে বাংলাদেশের রান টপকানোর চিন্তা থাকতো মাথায়।

রাভাল, লাথাম, উইলিয়ামসন, নিকোলাস, ওয়াগনার ও গ্র্যান্ডহোমরা তখন এত বেপরোয়া ব্যাটিং করতেন না। তাদের অ্যাপ্রোচ থাকতো আরও অনেক বেশি সংযত। তাতে করে ৭০০ প্লাস করাও হতা খুব কঠিন। ধরা যাক, তারপরও কিউইরা ৭০০ প্লাস রান করতেন।

তা করলেও তারা যে সাবলীল ঢং ও আক্রমণাত্মক মেজাজে মিনিটে এক রানের বেশি (৬৯০ মিনিটে ৭১৫ রান) ১৬৩ ওভারে ওভার পিছু ৪.৩৮ করে ফেলেছে, তা কিছুতেই হতো না। সেভাবে খেললে ঝুঁকি থাকতো অনেক বেশি উইকেট হারানোর। তাই কিউইরা অনেক রয়ে-সয়ে খেলতো। বাংলাদেশের বোলারদেরও এতটা হতোদ্যম মনে হতো না। তাদের বলে আরও ধার পরিলক্ষিত থাকতো।

অনিবার্য্যভাবে কিউইদর ৭১৫ করতে অনেক কাঠ খড় পোড়াতে হতো। আর করলেও অন্তত সাত থেকে আট সেশন লেগে যেত। তাতে করে ম্যাচের আয়ু বেড়ে যেত আপনা-আপনি। সব মিলে চিত্র আর দৃশ্যপটাই থাকতো ভিন্ন।

এখন যেমন প্রথম ইনিংসে ২৩৪ রানে অলআউট হয়ে কিউইদের ৭১৫ রানের হিমালয় সমান স্কোরের নীচে চাপা (ইনিংস পরাজয় এড়াতে দরকার পড়েছে ৪৮১ রান) পড়ার শঙ্কা যেত কমে। তখন ইনিংস পরাজয় এড়াতে দরকার হতো ২৮৬ রান। কে জানে, তখন তামিম, মাহমুদউল্লাহ আর সৌম্যরা মিলে ওই রান বা তার বেশি করে স্বাগতিকদের দ্বিতীয়বার ব্যাটিংয়ে নামাতেও পারতেন।

একটা সম্ভাবনা থেকেই যেত। কিন্তু ২৩৪ রানের মামুলি স্কোরে প্রথম ইনিংস গুঁড়িয়ে যাবার পর যে সে সম্ভাবনার দরজা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।

এআরবি/আইএইচএএস/জেআইএম