খেলাধুলা

প্রথম টি-টোয়েন্টি লিগের চমক জুনায়েদ, কম যাননি মাশরাফি-আশরাফুলরাও

শিরোনাম পড়ে হয়ত ভাবছেন, এক যুগ আগের আসর, এখন যারা দেশ সেরা ও তারকা ব্যাটসম্যান- তারা সবাই না হয় তার বড় অংশ হয়ত খেলেননি, তাই বুঝি জুনায়েদ সিদ্দিকী আসর সেরা হয়েছিল। আসলে মোটেই তা নয়।

Advertisement

এখন যারা বাংলাদেশের ক্রিকেটের শীর্ষ তারকা, তথা ‘পঞ্চ পান্ডব’ তাদের সবাই ছিলেন ওই আসরে। এ মুহূর্তে বাংলাদেশ জাতীয় দল তথা ঘরোয়া ক্রিকেট আসরে যাকে ভাবা হয় এক নম্বর ওপেনার ও সফলত ব্যাটসম্যান, সেই চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী খান পরিবারের কনিষ্ঠ সদস্য তামিম ইকবাল প্রথম টি-টোয়েন্টি লিগ খেলেছেন।

তামিমের দল ছিল ওল্ড ডিওএইচএস। চাচা আকরাম খান, আজকের জাতীয় দলের ম্যানেজার খালেদ মাহমুদ সুজনের সাথে ওল্ড ডিওএইচএসের পক্ষে নিয়মিত খেলেছেন তামিম। ফাইনালে বিজিত দল ওল্ড ডিওএইচএসের সর্বাধিক স্কোরারও ৩৬ বলে ৪৬ ছিলেন তামিম।

শুধু তামিম কেন? সাকিব আল হাসান, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ আর মাশরাফি বিন মর্তুজাও ছিলেন প্রথম টি-টোয়েন্টি লিগে। বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব খেলেছিলেন চ্যাম্পিয়ন মোহামেডানের হয়ে। তবে হাতের তালুতে ব্যাথা পাওয়ায় গ্রুপের শেষ ম্যাচ, সেমিফাইনাল আর ফাইনাল খেলা হয়নি সাকিবের।

Advertisement

তবে চির প্রতিদ্বন্দ্বী আবাহনীর বিপক্ষে বিকেএসপিতে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে বল হাতে স্পিন জাদুতে খালেদ মাসুদ পাইলট ও তুষার ইমরানের গড়া শক্তিশালি আবাহনীর বিপক্ষে মোহামেডানের জয়ের রূপকার ছিলেন তখনকার ২০ বছর বয়সী তরুণ সাকিব।

আজ যিনি বাংলাদেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে জনপ্রিয় চরিত্র, জাতীয় দলের সেই আদর্শ অধিনায়ক মাশরাফি সে আসরে ছিলেন আবাহনীর স্ট্রাইক বোলার। এছাড়া মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ খেলেছেন ভিক্টোরিয়ার পক্ষে।

শুধু পঞ্চপান্ডবের কথা বলা কেন, তখন যারা বাংলাদেশের শীর্ষ তারকা- সেই আকরাম খান, খালেদ মাহমুদ সুজন, নাইমুর রহমান দুর্জয়, খালেদ মাসুদ পাইলট, মোহাম্মদ রফিক, হাসিবুল হোসেন শান্ত, তুষার ইমরান, মঞ্জুরুল ইসলাম, তাপস বৈশ্য, মোহাম্মদ শরীফ, মোহাম্মদ আশরাফুল, আফতাব আহমেদ, আব্দুর রাজ্জাক- প্রমুখ নামী ও দেশ বরেণ্য ক্রিকেটারের সবাই অংশ নিয়েছিলেন প্রথম টি-টোয়েন্টি আসরে।

সবাইকে অবাক করে এবং ওপরে যাদের নাম বলা হলো সেই সব নামীদামি তারকাদের পিছনে ফেলে নৈপুণ্যের দ্যুতিতে ম্লান করে আসর সেরা পারফরমার হয়েছিলেন জুনায়েদ সিদ্দিকী ইমরোজ।

Advertisement

দুটি হাফসেঞ্চুরি আর এক সেঞ্চুরি (সোনারগাঁ ক্রিকেটার্সের বিপক্ষে ধানমন্ডি ক্রিকেট স্টেডিয়ামে ৬৪ বলে ১৩৪) ৭ খেলায় ১৯৩ বল খেলে করেছিলেন ৩১০ রান। যার গড় ছিল ৪৪.২৮। প্রায় ১৫০.০০ স্ট্রাইকরেটে ঐ রান করেছিলেন বাঁহাতি জুনায়েদ। টুর্নামেন্টের সর্বাধিক রান সংগ্রহকারিও ছিলেন জুনায়েদ।

এর মধ্যে গ্রুপ পর্বে সোনরাগাঁ ক্রিকেটার্সের সাথে ধানমন্ডি ক্রিকেট স্টেডিয়ামে ৬৪ বলে ১১ ছক্কা আর ৬ বাউন্ডারির সাহায্যে ১৩৪ রানের হ্যারিক্যান ইনিংস খেলে হৈচৈ ফেলে দিয়েছিলেন রাজশাহীর সেই যুবা। এছাড়া ওপেনার ইমতিয়াজ তান্না আর ড্যাশিং টপ অর্ডার আফতাব আহমেদও জুনায়েদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পারফরম করে মোহামেডানের সাফল্যে বড় ভূমিকা রাখেন।

এর মধ্যে সিলেটের আক্রমণাত্মক উইলোবাজ ইমতিয়াজ তান্না ফাইনালসহ (৮২) প্রায় ম্যাচে জুনায়েদের সাথে হাত খুলে খেলে মোহামেডানকে দারুণ সূচনা করে দেন। দুটি ফিফটিসহ সে আসরের দ্বিতীয় সর্বাধিক ২৪৫ রান সংগ্রহকারীও ছিলেন ইমতিয়াজ তান্না। এছাড়া রান তোলায় তৃতীয় ছিলেন আফতাব (৭ খেলায় ২২১)।

হাতের তালুর ইনজুরিতে সেমিফাইনাল ও ফাইনাল খেলা হয়নি সাকিবের

হাতের তালুর ইনজুরিতে পড়ে গ্রুপের শেষ ম্যাচে সোনারগাঁ ক্রিকেটার্স, সেমিতে ভিক্টোরিয়া আর ফাইনালে ওল্ড ডিএইচএসের বিপক্ষে তিন ম্যাচ খেলা হয়নি সাকিব আল হাসানের। কিন্তু তখনকার ২০ বছর বয়সী তরুণ বাঁহাতি স্পিনার সাকিব আল হাসান আবাহনীর বিপক্ষে ঐতিহ্য-মর্যাদার লড়াইয়ে মোহামেডানের জয়ে রাখেন সবচেয়ে বড় ভূমিকা।

বিকেএসপিতে হওয়া দুই জায়ান্টের লো স্কোরিং ম্যাচে মাত্র ১১৫ রানের সাদামাটা স্কোর নিয়েও মোহামেডান শেষ হাসি হাসে মূলত সাকিবের দুর্দান্ত বোলিংয়ে। আবাহনীর তখনকার ব্যাটিংয়ের আশা ভরসা তুষার ইমরানকে অসাধারন এক ডেলিভারিতে বোল্ড করা সহ মাত্র ১৭ রানে তিন উইকেট শিকারী হন সাকিব। সাকিবের সাথে আরেক বাঁহাতি স্পিনার আরাফাত সানি এবং তিন পেসার হাসিবুল হোসেন শান্ত, তাপস বৈশ্য ও মঞ্জুরুল ইসলাম মঞ্জু মোহামেডানের প্রথম টি-টোয়েন্টি শিরোপা জয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।

দ্বিতীয় সর্বাধিক উইকেট শিকারী মাশরাফি

তার দল আবাহনী সেমিফাইনালে ওল্ড ডিওএইচএসের কাছে হেরে বিদায় নেয়। তাই আর ফাইনাল খেলা সম্ভব হয়নি। তাতে কী? ৬ ম্যাচে ১১ উইকেট দখল করে তারপরও প্রথম টি-টোয়েন্টি লিগের দ্বিতীয় সর্বাধিক উইকেট শিকারী মাশরাফি। ৬ ম্যাচে ১১ উইকেট পেলেও মাশরাফি আসলে বল হাতে জ্বলে উঠেছিলেন দুই ম্যাচে।

এর মধ্যে চির প্রতিদ্বন্দ্বী মোহামেডানের সাথে বিকেএসপিতে ১৮ রানে চার উইকেটের পতন ঘটিয়েও দল জেতাতে পারেননি। সর্বাধিক উইকেট শিকারী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে না পারলেও ঐ আসরে এক ম্যাচে ৫ রানে ৫ উইকেট দখল করে ম্যাচ সেরা বোলিংয়ের এক অনুপম দৃষ্টান্ত স্থাপন করে রাখেন মাশরাফি। আজও সে রেকর্ড অম্লান।

মাশরাফির চেয়ে এক ম্যাচ কম (৫ ম্যাচ) খেলেও উইকেট শিকারে সবার ওপরে ছিলেন জাতীয় দলের সাবেক পেসার ও সোনারগাঁ ক্রিকেটার্সের হয়ে খেলা মোহাম্মদ শরীফ। তার উইকেট সংখ্যা ছিল ১৩ টি।

জুনায়েদ-আশরাফুলের সেঞ্চুরি সাজানো আগুন ম্যাচ

ক্রিকেটার, কোচ, সংগঠক, পৃষ্ঠপোষক, আয়োজক- ব্যবস্থাপক এবং দর্শক, অনুরাগি, ভক্ত ও সমর্থকদের কাছে প্রথম টি-টোয়েন্টি লিগ সবচেয়ে স্মরণীয় আছে মূলত দুটি কারণে।

প্রথমত, সব তারকা উইলোবাজদের পিছনে ফেলে দুই আনকোরা তরুণ ইমতিয়াজ তান্না এবং জুনায়েদ সিদ্দিকীর অতি নাটকীয় উত্থান। আসর শুরুর আগে যাদের কেউ হিসেবের ভিতরে আনেননি, সেই জুনায়েদ-তান্না জুটি প্রায় খেলায় মোহামেডানকে শুভ সূচনার পাশাপাশি ধারাবাহিকভাবে ভাল খেলে দলের সাফল্যে বড় অবদান রাখেন।

এর বাইরে ঢাকাই ক্লাব ক্রিকেটের প্রথম টি-টোয়েন্টি আসরটির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল জুনায়েদ সিদ্দিকী আর মোহাম্মদ আশরাফুলের এক ম্যাচে দুই সেঞ্চুরি। ভেন্যু ছিল ধানমন্ডি ক্রিকেট স্টেডিয়াম। গ্রুপ ম্যাচে জুনায়েদ সিদ্দিকী এক অভাবনীয় ঘটনা ঘটিয়ে ফেলেন।

ঢাকা তথা বাংলাদেশের কোন ব্যাটসম্যান আগে কখনো যা করতে পারেননি- মোহাম্মদ শরীফ আর মোহাম্মদ রফিকের মত বাঘা বাঘা বোলারের গড়া সোনারগাঁয়ের বিপক্ষে সেই অভুতপূর্ব ঘটনাই ঘটিয়ে ফেলেন জুনায়েদ। তার ছক্কা বৃষ্টিতে ভিজে একাকার হয় ধানমন্ডি ক্রিকেট স্টেডিয়ামের পূর্ব দিকের মাঠ।

৬৪ বলে ১১ ছক্কা আর ৬ বাউন্ডারিতে জুনায়েদের ১৩৪ রানের বিধ্বংসী ইনিংসটি মাঠ গরম করার পাশাপাশি যেমন সোনারগাঁ বোলিং ফিল্ডিংকে ছিন্ন ভিন্ন করে মোহামেডানকে খুঁজে দেয় ২২৬ রানের প্রায় নিরাপদ পুজি।

কিন্তু মোহাম্মদ আশরাফুলের অবিস্মরণীয় উইলোবাজির মুখে ঐ পাহাড় সমান স্কোর নিয়েও হারের শঙ্কায় পড়ে গিয়েছিল মোহামেডান। এক পর্যায়ে ২৩ রানে তিন উইকেট হারিয়ে ধুঁকছিল সোনারগাঁ। কিন্তু আশরাফুল নেমে পরিস্থিতি সামাল দেন। শুরু হয় অবিশ্বাস্য উইলোবাজি। প্রতি ওভারে একাধিক বাউন্ডারির মার আসতে থাকে আশরাফুলের ব্যাট থেকে।

মাত্র ৪৭ বলে ১৬ বাউন্ডারিতে ১০৪ রানের ‘টর্নেডো’ ইনিংস খেলে ফেলেন আশরাফুল। তার বিদায়ের পরও জেতার যথেষ্ঠ সম্ভাবনা ছিল সোনরাগাঁর। শেষ ১৬ বলে দরকার ছিল ৩৯ রানের। কিন্তু ৩০ রানের বেশী করা সম্ভব হয়নি। ৯ রানের স্মরণীয় জয়ে হাসিমুখে মাঠ ছাড়ে সাদা কালোরা। টি-টোয়েন্টি লিগের প্রথম আসরে এক ম্যাচে দুই সেঞ্চুরির সেই ম্যাচ যারা দেখেছিলেন, তাদের সবার স্মৃতিতে সে ম্যাচ এখনো উজ্জ্বল, জ্বল জ্বল করছে সবার মনের আয়নায়।

এআরবি/এসএএস/এমকেএইচ