জাতীয়

‘আমার মাইয়ার শেষ নিশানাটাও কি পামু না’

ছোট্ট একটি কক্ষ। আসবাবপত্র খুব বেশি নেই। একটি সিঙ্গেল খাট। খাটের অদূরে দেয়াল ঘেঁষে একটি আলমারি। আলমারি ঘেঁষে একটি ওয়ারড্রোব, এর ওপর চিরুনি ও লিপস্টিকসহ কয়েকটি প্রসাধনী সামগ্রী ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। ওয়ারড্রোব ঘেঁষে বইয়ের মিনি টেবিল। টেবিলে গার্হস্থ্য অর্থনীতিসহ বিভিন্ন বিষয়ের বইপত্র। বইয়ের টেবিলের একপাশে একটি গিটার। কক্ষটির জানালা সংলগ্ন দেয়ালের দু’পাশে সুন্দর করে আলপনা আঁকা।

Advertisement

এ কক্ষটি একজন উঠতি বয়সী তরুণীর। নিজ কক্ষটিতে আপন করে সাজিয়েছিলেন তিনি। রাতবিরাতে গিটার হাতে নিয়ে তিনি গান গাইতে শুরু করতেন। শুধু গানই নয়, পছন্দ করতেন আবৃত্তি করতে। তবে কক্ষটিতে যে তরুণী থাকতেন তিনি এখন শুধুই অতীত।

যে কক্ষটির বর্ণনা দেয়া হলো সে কক্ষটি গত বুধবার (২০ ফেব্রুয়ারি) দিবাগত রাতে পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে নিহত (যদিও লাশ পাওয়া যায়নি কিংবা লাশ চিহ্নিত করা হয়নি তবে অগ্নিকাণ্ডের পর প্রাপ্ত সিসিটিভি ফুটেজে তরুণী ও তার এক বান্ধবীকে দেখা গেছে, দুজনেই মারা গেছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে) ফাতেমা তুজ জোহরা ওরফে বৃষ্টিদের ভাড়া বাসার।

বৃহস্পতিবার বেলা ১১টায় লালবাগের পোস্তার অদূরে রহিম বক্স লেনে বৃষ্টিদের ভাড়া বাসার চারতলায় কলিংবেল বাজাতেই দরজা খুলেন এক বৃদ্ধা। গণমাধ্যমকর্মী পরিচয় দিতেই বৃষ্টির দাদী পরিচয়দানকারী বৃদ্ধা নাতনির কথা মনে করে কান্নায় ভেঙে পড়েন। এ সময় ছুটে আসেন বৃষ্টির মা শামসুন্নাহার ও ছোট ভাই শুভ। মেয়েকে হারিয়ে মা শামসুন্নাহার পাগলপ্রায়। তার একটাই কথা শেষবারের মতো মেয়ের দেহের কোনো অংশ ছুঁয়ে দেখতে চান। লাশ না পেয়ে সিআইডির ডিএনএ টিমের কাছে শামসুন্নাহার ও তার ছেলে ডিএনএ নমুনা হিসেবে রক্ত দিয়ে এসেছেন।

Advertisement

জানা গেছে, নিউমার্কেটের ব্যবসায়ী জসিম উদ্দিনের দুই ছেলে এক মেয়ের মধ্যে সবার বড় বৃষ্টি গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের চাইল্ড নিউট্রেশন বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্রী ছিলেন। শিশু একাডেমি থেকে গিটার বাজানো শিখেছিলেন। আবৃত্তি ক্লাসে যেতেন।

বৃষ্টির দাদী জানান, সেদিন একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে ঘনিষ্ঠ বান্ধবী দোলাকে নিয়ে বাইরে গিয়েছিলেন বৃষ্টি। রাত ৯টার পরও বাসায় ফোন করে চিন্তা না করতে এবং সে খুব তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে আসছে বলে জানান। গভীর রাতে বাসায় না ফেরায় ও চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের খবর পেয়ে তারা ছুটে যান সেখানে। সকালে অনেক লাশ পাওয়া গেলেও বৃষ্টি আর দোলার লাশ খুঁজে পাননি তারা। পরে এক সিসিটিভি ফুটেজে দেখেছেন ওই সময় বৃষ্টি আর দোলা ওই এলাকায় অবস্থান করছিলেন। তাদের মোবাইলের সর্বশেষ লোকেশনও সেখানে দেখা যায়। এতেই তারা প্রায় নিশ্চিত হন বৃষ্টি বা দোলা দুজনের একজনও বেঁচে নেই।

তবে মেয়েকে খুঁজে না পাওয়া পাগলপ্রায় এ পরিবারটির কাছে বৃষ্টি ও দোলাকে ফিরিয়ে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে এক লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে একটি চক্র। তারা দুটি পরিবারে টেলিফোন করে ৫০ হাজার টাকা করে নগদ এক লাখ টাকা তাদের দিলে দুজনকে ফিরিয়ে দেয়ার প্রলোভন দেখান। এ ফাঁদে পা দিয়ে দুটি পরিবার এক লাখ টাকা বিক্যাশে পেমেন্ট করে দেন। পরবর্তীতে বুঝতে পারেন তারা ভয়ঙ্করভাবে প্রতারিত হয়েছেন। বৃষ্টির বৃদ্ধা দাদীর প্রশ্ন এভাবে প্রতারণা করে যারা টাকা হাতিয়ে নিয়েছে তাদের বিচার হবে কি?

বৃষ্টির দাদী জানান, বৃষ্টি ও দোলা চতুর্থ শ্রেণি থেকে একই স্কুলে পড়াশোনা করে এসেছে। তারা ছিল ঘনিষ্ঠ বান্ধবী। তারা অগ্রণী স্কুল থেকে একসঙ্গে এসএসসি পাস করে কলেজে ভর্তি হয়। সেদিনও দুজন একসঙ্গে ঘুরতে বেরিয়ে আর ফেরত আসেনি।

Advertisement

বৃষ্টির মা শামসুন্নাহার গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে প্রথমে রাজি হননি। একপর্যায়ে এ প্রতিবেদক তিনি সরকারের কাছে কী চান? এ কথা বললে কান্নায় ভেঙে পড়ে শামসুন্নাহার বলেন, ‘আমার মাইয়ার শেষ নিশানাটাও কি পামু না’। মেয়েটা আগুনে পুড়ে অঙ্গার হয়ে থাকলেও শেষবারের মতো শরীরের যে কোনো অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ছুঁয়ে দেখতে চান।

তিনি জানান, রাত ৯টায় তিনি মেয়ের সঙ্গে কথা বলে দ্রুত বাসায় ফিরে আসতে বলেন। এ সময় বৃষ্টি চিন্তা না করার অভয় দিয়ে বলছিল, মা খুব তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরব। এরপর আর কথা হয়নি।

শামসুন্নাহার যখন মেয়ের জন্য বিলাপ করছিলেন তখনই খবর আসে বৃষ্টির এক বছর বয়সী এক মামাত ভাই মারা গেছে। বৃষ্টির নিখোঁজ হওয়ার সংবাদ শুনে গত কয়েকদিন এ বাসাতেই ছিলেন বৃষ্টির মামা। আজ নরসিংদী ফিরে যাওয়ার সময় তার ছেলেটি মারা যায়। এ খবরে বৃষ্টির মা শাসমুন্নাহার বিলাপ করে বলতে থাকেন, আল্লাহ তুমি আমাকেও তুলে নাও ,কষ্ট আর সহ্য করতে পারছি না। বৃষ্টির মতো একই অবস্থা তার বান্ধবী দোলার পরিবারেরও।

বিদায় নিয়ে চলে আসার সময় বৃষ্টির দাদী প্রশ্ন রেখে বলেন, যারা বৃষ্টিকে জীবিত আছে, টাকা দিলে ফিরিয়ে দেবে বলে এক লাখ টাকা হাতিয়ে নিল তাদের কি আদৌ বিচারের আওয়ায় আনা সম্ভব হবে।

এমইউ/জেডএ/পিআর