মতামত

বুড়িগঙ্গা ও তুরাগ: দরকার দূষণ রোধ ও পরিকল্পিত খনন

সম্প্রতি শেষ হয়েছে বুড়িগঙ্গা ও তুরাগের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান। ২৯ জানুয়ারি থেকে ২০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চার ধাপে তিনদিন করে ১২ কার্যদিবস এই অভিযান চলে। উচ্চ আদালতের রায়ের আলোকে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় ও আন্ত:মন্ত্রণালয় বৈঠকের সিদ্ধান্তে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) এই উচ্ছেদ কার্যক্রম চালায়। অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে এবারের অভিযান ছিল অনেক বড় ও ফলপ্রসূ; যা সকল মহলে প্রশংসিত হয়েছে।

Advertisement

যদিও বুড়িগঙ্গার তীরে বছিলার কাছে একটি ১০ তলা ভবন অক্ষত রয়েছে। এছাড়া চিহ্নিত অন্যসব স্থাপনা অপসারণ করা হয়েছে। অবৈধ ভবনটি অপসারণের জন্য রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ওই ভবনমালিককে ১৫ দিন সময় দিয়েছে- এমন কথা শোনা যাচ্ছে। তাই সবার প্রত্যাশা, খুব শিগগির এই অবৈধ স্থাপনাটিও উচ্ছেদ হবে। তবে বিআইডব্লিউটিএ বা রাজউক আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু বলেনি।

বুড়িগঙ্গা ও তুরাগের সংকট শুধু অবৈধ দখল নয়; নদী দুটি বিপন্ন হওয়ার অন্যতম একটি কারণ হলো মারাত্মক দূষণ। বিশেষ করে বুড়িগঙ্গা অপরিমেয় বিষাক্ত বর্জ্যের আধারে পরিণত হয়েছে। তরল বর্জ্যে পানি দূষিত হয়; আর কঠিন বর্জ্যে দূষণ ও ভরাট- দুটিই হয়। এভাবে একদিকে বুড়িগঙ্গার পানি পরিণত হয়েছে বিষাক্ত তরল পদার্থে, অন্যদিকে নদীর কিনারে ও তলদেশে পলিথিন ও প্লাস্টিকজাত দ্রব্যসহ বিভিন্ন ধরনের কঠিন বর্জ্য জমে এর প্রবাহ বন্ধের উপক্রম হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. দিদার-উল-আলমের ভাষ্য মতে, রাজধানীর ১৪ লাখ ঘনমিটারেরও বেশি পয়ঃবর্জ্যের মাত্র ৩০ শতাংশ শোধন হচ্ছে। বাকি বর্জ্য যাচ্ছে বুড়িগঙ্গা ও অন্য নদীতে। প্রতিলিটার পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের মাত্রা ৪ থেকে ৬ মিলিগ্রাম থাকার কথা। কিন্তু বুড়িগঙ্গায় এ মাত্রা শূন্যের কোঠায়। (সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ১২ অক্টোবর ২০১৭)।

Advertisement

এভাবে দূষণের কারণে বুড়িগঙ্গার সঙ্গে সাধারণ মানুষের যোগাযোগ দিনদিন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় কার্যত দখলদাররাই লাভবান হচ্ছেন। বছরের পর বছর দূষণ ও ভরাটের শিকার বুড়িগঙ্গা ও তুরাগের বিস্তীর্ণ এলাকা চলে গিয়েছিল ভূমিদস্যুদের কবলে।

যদিও দখলদারদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থার এক শ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর সব সময়েই যোগসাজশ ছিল। আশার কথা, দুটি নদীর কিছু অংশে পরিচালিত এবারের অভিযানে বহু দখলদার ও তাদের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ হয়েছে।

তবে শুধু অবৈধ স্থাপনা অপসারণ করে বুড়িগঙ্গা ও তুরাগকে রক্ষা করা যাবে না। ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত বাংলাদেশ নৌবাহিনীর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বুড়িগঙ্গা নদী দূষণের জন্য দায়ী মূলত শিল্পবর্জ্য। নদীতে পড়া বর্জ্যের ৬০ শতাংশ শিল্পখাতের। এর মধ্যে ৪০ শতাংশ ট্যানারি, ২০ শতাংশ অন্য শিল্পের।

এর বাইরে ১৫ শতাংশ কঠিন বর্জ্য, ১৫ শতাংশ অন্য ও ১০ শতাংশ নৌযান বর্জ্য। প্রতিবেদনে বলা হয়, বুড়িগঙ্গা নদীতে প্রতিদিন ঢাকা শহরের ৪ হাজার ৫০০ টন আবর্জনা ও ২২ হাজার লিটার বিষাক্ত ট্যানারিবর্জ্য পড়ছে। এছাড়া পলিথিন জমে নদীটির তলদেশ ১০-১২ ফুট ভরাট হয়ে গেছে।

Advertisement

পরিবেশবাদীদের আন্দোলন ও উচ্চ আদালতের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে ট্যানারি কারখানাগুলো রাজধানী থেকে স্থানান্তর হয়েছে বটে; তবে অন্যান্য উৎস থেকে নদীতে বর্জ্য পড়া বন্ধ হয়নি। তাই সর্বাগ্রে প্রয়োজন দূষণ বন্ধ করা। এজন্য সরকারকে সর্বোচ্চ কঠোর হওয়া দরকার।

এছাড়া বুড়িগঙ্গার তলদেশে জমে থাকা ট্যানারিসহ অন্যান্য শিল্পের কঠিন বর্জ্য এখনও অপসারণ হয়নি। নদীর গভীরতা বৃদ্ধির জন্য এসব আবর্জনা অপসারণ অত্যন্ত জরুরি। এছাড়া নদীর মধ্যে ও তীরে অসংখ্য অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করে বুড়িগঙ্গা ও তুরাগকে সংকুচিত করে ফেলায় দুই নদীর স্রোতধারাও দুর্বল হয়ে পড়েছে।

২০১৬ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন পানিসম্পদ মন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ জাতীয় সংসদে বলেছিলেন, বুড়িগঙ্গার পানিপ্রবাহ বৃদ্ধির মাধ্যমে দূষণমুক্ত করার লক্ষ্যে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের অধীন ‘বুড়িগঙ্গা নদী পুনরুদ্ধার (নিউ ধলেশ্বরী-পুংলী-বংশী-তুরাগ-বুড়িগঙ্গা রিভার সিস্টেম)’ শীর্ষক প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন রয়েছে।

ওই প্রকল্পের আওতায় নিউ ধলেশ্বরী, পুংলী, বংশী, তুরাগ ও বুড়িগঙ্গা খনন করে যমুনা নদী থেকে পানি এনে বুড়িগঙ্গাসহ ঢাকা মহানগরীর চারপাশের প্রবহমান নদীগুলোতে শুষ্ক মৌসুমে পানিপ্রবাহ বৃদ্ধির মাধ্যমে পানির গুণগতমান বৃদ্ধি ও পানি দূষণমুক্ত করার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ৯৪৪ দশমিক ৯ কোটি টাকার প্রকল্পটি ২০১৭ সালের জুনে সমাপ্তির লক্ষ্যে প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে বলেও মন্ত্রী জানিয়েছিলেন। (সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন ও বাসস)। তৎকালীন ওই মন্ত্রীর বক্তব্যের সুফল জনগণ আজও দেখেনি।

তবে সুফল দেখতে না পেয়ে হতাশ হলেও বুড়িগঙ্গা ও তুরাগের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে সাম্প্রতিক সফল অভিযান সাধারণ মানুষকে আশান্বিত করেছে। এই অভিযান পরিচালনায় বিআইডব্লিউটিএর যুগ্ম পরিচালক ও ঢাকা নদীবন্দর ইনচার্জ যথেষ্ট সাহসিকতার পরিচয়ও দিয়েছেন।

দৃশ্যত কোনো প্রভাবশালী দখলদারের রক্তচক্ষু বা প্রলোভন তাঁকে টলাতে পারেনি। এখন দরকার সাফল্য ধরে রাখা। এজন্য এস্কেভেটর দিয়ে নদীর তলদেশের বর্জ্য অপসারণ ও পরিকল্পিত খননের মাধ্যমে নৌ চলাচল উপযোগী নাব্যতা বা গভীরতা ফিরিয়ে আনা দরকার।

এ কথা অনস্বীকার্য যে, নদীর ব্যবহার নিশ্চিত ও নৌযান চলাচল স্বাভাবিক না হলে সে নদীকে প্রবহমান রাখা যায় না। বুড়িগঙ্গা ও তুরাগে একসময়ে অসংখ্য নৌযান চলতো; যা এখন অনেক কমে গেছে। তবে বিপন্ন অবস্থার মধ্যেও দুই নদীতে বিভিন্ন ধরনের ছোট-বড় বহু নৌযান চলে।

যেহেতু স্বীকৃত নৌপথ খননের দায়িত্ব বিআইডব্লিউটিএর এবং বুড়িগঙ্গা-তুরাগ দখলমুক্ত করতে সংস্থাটি আশাব্যঞ্জক ভূমিকা দেখিয়েছে, সেহেতু নদী দুটির বর্জ্য অপসারণ ও খননের দায়িত্ব এই সংস্থাকে দেয়া যেতে পারে। এছাড়া নদী খনন করে প্রয়োজনীয় নাব্য সংরক্ষণের ক্ষেত্রে বিআইডব্লিউটিএর দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতা রয়েছে। উচ্ছেদের মতো খননেও তারা সাফল্য দেখাবে বলে প্রত্যাশা করি।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও অধিকারকর্মী। ashisptb@gmail.com

এইচআর/জেআইএম