অমর একুশে বইমেলা বাঙালির প্রাণের মেলা। প্রাণের মেলায় সবার প্রাণসঞ্চার করতে ভালোবাসার ডালি সাজিয়ে বসেছে একঝাঁক তরুণ-তরুণী। তাদের নিঃস্বার্থ ভালোবাসায় মুগ্ধ বইমেলায় আসা বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ। মেলার শুরু থেকে শেষলগ্ন পর্যন্ত তাদের কর্মযজ্ঞের মুহূর্তগুলো দেখার মতো। বিস্তারিত জানাচ্ছেন আবু রায়হান মিকাঈল-
Advertisement
প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে চলে এ প্রাণের মেলা। শতশত লেখকের অজস্র বইয়ের সমারোহ আর দর্শনার্থীদের উপস্থিতি মেলাকে প্রাণবন্ত করে তোলে। মাসব্যাপী বইমেলা কী শিখিয়েছে জানি না; তবে টিএসসির সামনে বইমেলার প্রবেশপথের একটি দৃশ্য কিছু একটা শিখিয়েছে। ২৫ ফেব্রুয়ারি বিকেল সাড়ে ৪টা। গাড়ি থেকে বইমেলার প্রবেশপথে নামতেই দেখলাম একঝাঁক তরুণ-তরুণী হুইল চেয়ার নিয়ে দাঁড়িয়ে। যারা শারীরিক প্রতিবন্ধী ও হেঁটে চলতে পারেন না, তাদের জন্য এ ব্যবস্থা। বইমেলায় বিনাখরচে সেবাটি দিচ্ছে ‘সুইচ বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন’ নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। সংগঠনটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট এবং ঢাকা মেডিকেলসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে চালাচ্ছে এ কার্যক্রম।
শারীরিক অসুস্থতার কারণে আমি হুইল চেয়ারে চড়ে মেলা প্রাঙ্গণ ঘুরেছি বেশ কিছুক্ষণ। আমাকে পুরো মেলা ঘুরে দেখিয়েছেন সুইচ বাংলাদেশের সদস্য ও সদ্য গ্রাজুয়েট শেষ করা তরুণ শিপলু। শিপলু ভাইয়ের আন্তরিকতা আর ভালোবাসা আমাকে খুব মুগ্ধ করছিল। আমি বুঝতে পারছিলাম, আমাকে নিয়ে এভাবে ঘুরে বেড়াতে তার বেশ কষ্ট হচ্ছে। এজন্য আমি বারবার বলছিলাম, ভাইয়া থাক, আর না। এবার চলে যাই। তখন তিনি একটু মুচকি হেসে বললেন, ‘কেন, মাত্র তো মেলায় আসলেন। আরেকটু ঘোরেন।’ এই বলে তিনি আমাকে দীর্ঘক্ষণ মেলা প্রাঙ্গণ ঘুরে দেখালেন।
> আরও পড়ুন- রাতের আঁধারে আলোর পাঠশালা
Advertisement
বইমেলা ঘুরে টিএসসি মোড়ে এসে সুইচ বাংলাদেশের সদস্যদের মাঝে প্রায় ঘণ্টাখানেক সময় কাটালাম। তাদের সঙ্গে পরিচিত হয়ে জানতে পারলাম, তারা সবাই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। ইডেন কলেজের কয়েকজন ছাত্রীও ছিল তাদের সঙ্গে। পড়াশোনা আর টিউশনির মধ্যদিয়ে ব্যস্ত সময় কাটে তাদের। ব্যস্ততার মাঝে তবুও একটু অবসর সময় বের করে এখানে এসেছেন তারা।
হুইল চেয়ার ধরে প্রতিবন্ধীদের সেবাদানে অপেক্ষায় থাকা এক তরুণী বললেন, ‘মেলার শুরু থেকে আমরা প্রতিদিন এ সেবা দিয়ে যাচ্ছি। আশা করি, এভাবে একদিন এ কংক্রিটের শহরে ভালোবাসার মেলবন্ধন তৈরি হবে।’ সেখানে আমি বসে থাকতেই দেখলাম, শারীরিক প্রতিবন্ধী ও অন্ধ ব্যক্তিরা মেলায় এ ফ্রি হুইল চেয়ার সেবা পেয়ে অনেক খুশি। তাদের প্রতি এমন ভালোবাসা দেখে কেউ কেউ আবার আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ছেন।
এসময় সেখানে আমার সঙ্গে কথা হয় সুইচ বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনের প্রধান সমন্বয়ক মোস্তাফিজুর রহমানের। তিনি জানান, গত তিন বছর ধরে সংগঠনের সদস্যরা শারীরিক প্রতিবন্ধী ও যারা পায়ে হেঁটে চলাফেরা করতে অক্ষম, তাদেরকে হুইল চেয়ারের মাধ্যমে মেলায় প্রবেশের সুযোগ করে দিচ্ছেন। কোন প্রকার বিনিময় ছাড়াই একজন শারীরিক প্রতিবন্ধীর যতক্ষণ মন চায় ফাউন্ডেশনের সদস্যদের সহায়তায় হুইল চেয়ারে করে মেলা প্রাঙ্গণে ঘুরতে পারেন। মেলায় এবারই প্রথম শিশুদের জন্য বিশেষ হুইল চেয়ারের ব্যবস্থা করেছে সংগঠনটি।
> আরও পড়ুন- ৭ শতাধিক পরিবারের পাশে উইন্টার প্রজেক্ট
Advertisement
এদিকে রাজধানীর ঢাকা উদ্যানে একটি বিনামূল্যে স্কুল পরিচালনা করছে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনটি। যেখানে প্রায় দেড় শতাধিক সুবিধাবঞ্চিত শিশু শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে। খুব কম সময়ে সংগঠনটি আর্ত মানবতার সেবায় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
কংক্রিটের শহরে হুইল চেয়ারে তারুণ্যদীপ্ত এ ভালোবাসা একদিন বদলে দেবে চারপাশ। যে বয়সের তরুণ-তরুণীরা স্বেচ্ছায় আত্মোৎসর্গ করেছে এই সেবায়; ঠিক সেই বয়সের বহু তরুণ-তরুণী নিজেকে ব্যস্ত রেখেছে নানা আড্ডায়।
এসইউ/এমকেএইচ