দেশজুড়ে

দুই দশকে সফল ২০ হাজার উদ্যোক্তা

গত দুই দশকে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ অঞ্চলে শূন্য থেকে সফল উদ্যোক্তা হয়েছেন অন্তত ২০ হাজার মানুষ। রাষ্ট্রায়ত্ত কর্মসংস্থান ব্যাংকের অর্থায়নে নিজেদের ভাগ্য বদলেছেন এই উদ্যোগীরা। তাদের হাত ধরেই বদলে গেছে এ অঞ্চলের অর্থনীতির প্রবাহ।

Advertisement

জানা গেছে, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ, যানবাহন ও পরিবহন সেবা, শিল্প-কারখানা, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প, অন্যান্য উৎপাদনশীল প্রকল্পসহ বিভিন্ন সেবা এবং বাণিজ্যিক ২৪টি খাতে নিজেদের সফল হিসেবে গড়ে তুলেছেন এসব উদ্যোক্তা। ২০০১ সালের পর থেকে রাষ্ট্রায়ত্ত কর্মসংস্থান ব্যাংকের রাজশাহীর ছয়টি এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জের দুটি শাখা থেকে ঋণ সুবিধা নিয়েছেন তারা।

কর্মসংস্থান ব্যাংকের রাজশাহী আঞ্চলিক অফিস জানায়, এ দুই জেলায় গরু মোটাতাজাকরণ করে সফলতা পেয়েছেন ১০ হাজার ১১ জন। তাদের মাঝে ১০৯ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে কর্মসংস্থান ব্যাংক, যা এ অঞ্চলে ব্যাংকটির বিতরণকৃত ঋণের ৫২ শতাংশ।

এ ছাড়া মৎস্য খামারে এক হাজার ১৫৫ জনকে ১৭ কোটি টাকা, দুগ্ধ খামারে এক হাজার ৬২৫ জনকে ১৫ কোটি, ক্ষুদ্র ব্যবসায় এক হাজার ৫৮৬ জনকে ১১ কোটি ৫৮ লাখ, কাঠ ও স্টিলের আসবাবপত্র তৈরিতে ৭৪ জনকে ৫ কোটি ৪১ লাখ, সেলাই প্রকল্পে ৬৭৫ জনকে ৫ কোটি, হাঁস-মুরগির খামারে ৩৬৫ জনকে ৪ কোটি, ওষুধের দোকানে ৬০৮ জনকে ৪ কোটি এবং হস্ত ও কুটির শিল্পে ২২৫ জনকে ১ কোটি ৯১ লাখ টাকা ঋণ দেয়া দিয়েছে কর্মসংস্থান ব্যাংক। এই ঋণ গ্রহীতা সবাই নিজ নিজ উদ্যোগে সফল হয়েছেন।

Advertisement

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০০১ সাল থেকে এখন পর্যন্ত কর্মসংস্থান ব্যাংক রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জের ২০ হাজার ৯৩৬ জনকে ২১১ কোটি ৮৮ লাখ টাকা ঋণ সহায়তা দিয়েছে। ৯০ শতাংশ হারে এরই মধ্যে আদায় হয়েছে ১৮২ কোটি ৪০ লাখ টাকা।

যদিও খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২ কোটি ৭৩ লাখ টাকা, যা মোট ঋণের মাত্র ৩ শতাংশ। আর শ্রেণিকৃত ঋণ ৫০ লাখ ৩৬ হাজার টাকা। তারপরও এ অঞ্চলে আমানত সংগ্রহ হয়েছে ৩৩ কোটি টাকা।

নগরীর উপকণ্ঠ নওহাটা পৌর বাজারের মেহেদি সু-স্টোর। রকমারি জুতা-স্যান্ডেলে দোকান ঠাসা। কিন্তু ক্রেতা নেই। স্বত্বাধিকারী মকবুল হোসেন জানালেন, ১৭ বছর ধরে তিনি এ ব্যবসায়।

এই মৌসুমের কয়েকমাস ক্রেতাশূন্য থাকে বাজার। বেচাকেনাও হয় সীমিত। ফলে কর্মসংস্থান ব্যাংকের নেয়া এক লাখ টাকা ঋণের শেষ তিনটি কিস্তি তিনি পরিশোধ করতে পারেননি।

Advertisement

নওহাটা ও এর আশপাশের এলাকার কৃষকদের প্রধান ফসল আলু। এখন আলু তুলতে মাঠে নেমেছেন কৃষক। এর প্রভাব পড়েছে বাজারে। অধিকাংশ সময় ক্রেতাশূন্য থাকছে এখানকার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো।

বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন নওহাটা পৌর বাজারের যুথি বস্ত্রালয়ের মালিক শাহজাহান আলী। বেচাকেনা না থাকায় তিনিও শেষ তিনটি কিস্তি পরিশোধ করতে পারেননি। সামনে হালখাতার পর পুরো ঋণ পরিশোধ করে দেবেন। কর্মসংস্থান ব্যাংকের ঋণ সুবিধা উদ্যোক্তাবান্ধব বলে জানান এই ব্যবসায়ী।

তবে ব্যর্থতা ছাপিয়ে গেছে সফলতার গল্প। জেলার পবা উপজেলার দর্শনপাড়া ইউনিয়নের সুন্দরপুরে ৯৫ বিঘা বাণিজ্যিক মাছের খামার গড়েছেন রেজাউল হক। মৎস্য দফতর ও যুব উন্নয়ন অধিদফতর থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে ২০ বছর আগে শখের বসেই নেমেছিলেন এ কারবারে। এখন তিনি সফল মাছচাষি। তার দেখাদেখি এলাকায় অনেকেই মাছচাষে এসেছেন।

রেজাউল হক জানান, শুরুতে কর্মসংস্থান ব্যাংকের রাজশাহী শাখা থেকে ৫০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। মৎস্য ও যুব উন্নয়ন অধিদফতর থেকেও মেলে সহায়তা। এখন জমি ভাড়া, খনন ও মাছচাষ মিলিয়ে খামারে তার লগ্নি ছাড়িয়েছে এক কোটি টাকা। সর্বশেষ কর্মসংস্থান ব্যাংক থেকে ৮ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছেন। ব্যবসা উপরে উঠছে তরতরিয়ে।

রেজাউল আরও বলেন, গেল ১৫ বছর গেছে ব্যবসা বুঝতেই। তবে গত ৫ বছর থেকে সফলতা পাচ্ছেন। খরচপাতি বাদ দিয়ে গড়পড়তা বছরে তার আয় ১০ লাখ টাকা। দুই ছেলের পড়ালেখা ছাড়াও সংসার চালান এ আয় থেকে। কিছু সঞ্চয়ও করেছেন। সম্প্রতি নওহাটা পৌর বাজারে ২০ লাখ টাকায় তিন কাঠা জমিও কিনেছেন।

পবার বাগসাড়া এলাকার বাসিন্দা বোরহান উদ্দিন বছর-চারেক আগেও ছিলেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী। রেজাউল হকের দেখাদেখি এলাকায় তিনিও মাছের খামার গড়েছেন। তিনি জানান, ৭৫ বিঘা মাছের খামারে তার লগ্নি দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭৫ লাখ টাকা। ছয় লাখ টাকা কর্মসংস্থান ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে নতুন করে বিনিয়োগ করেছেন। আগামী বছর তার মোট বিনিয়োগ কোটি টাকায় পৌঁছাবে। প্রতিদ্বন্দ্বিতায় টিকতে বিনিয়োগ বাড়ানোর বিকল্প নেই বলে জানান এই উদ্যোক্তা।

ব্যাংকটির পবা শাখার ব্যবস্থাপক মিজানুর রহমান বলেন, তাদের হাত ধরেই সফল হয়েছেন এলাকার উদ্যোমী লোকজন। এই সফলতা এসেছে ঋণ বিতরণের আগে যথাযথ মূল্যায়ন, পরে নীবিড় নজরদারি এবং পরামর্শক হিসেবে ব্যাংক তাদের পাশে থাকায়।

এদিকে, সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সল্প সুদে ঋণ সহায়তা পেতে উদ্যোক্তাকে অবশ্যই বাংলাদেশের নাগরিক হতে হবে। তাছাড়া শাখার অধিক্ষেত্রের স্থায়ী বাসিন্দা অথবা স্থায়ী বাসিন্দা না হলে শাখার অধিক্ষেত্রের একজন স্থায়ী বাসিন্দাকে ঋণের গ্যারান্টার হতে হবে।

১৮ হতে ৪৫ বছর বয়সী বেকার অথবা অর্ধ বেকার এ ঋণ সুবিধা পাবেন। এ ক্ষেত্রে উদ্যোক্তাকে ইক্যুইটি বহনের ক্ষমতা থাকতে হবে। এর বাইরেও থাকতে হবে প্রকল্প পরিচালনায় উপযুক্ত প্রশিক্ষণ বা অভিজ্ঞতা। ঋণ ব্যবহারের যোগ্যতাসহ ঋণ পরিশোধের ক্ষমতা ও আর্থিক আচরণ দেখবে কর্তৃপক্ষ। অন্য কোনো ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, এনজিও অথবা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ঋণখেলাপিদের এ ঋণ সুবিধা মিলবে না।

ব্যাংকের আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক সালেহ মোহাম্মদ সিরাজুল সালেকিন বলেন, ঋণ আবেদন পেলে প্রথমে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা প্রকল্প পরিদর্শন করেন। পরে তিনিও যান পরিদর্শনে। তাছাড়া উদ্যোক্তাদের সবধরনের বিনিয়োগ পরামর্শও দেন। বকেয়া ঋণ আদায়েও অনেক বেশি তৎপর মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা। এসব কারণেই ঋণ অনাদায়ী থাকছে না।

ফেরদৌস সিদ্দিকী/জেডএ/জেআইএম