বিশেষ প্রতিবেদন

এ শহরের একটি জীবনও নিরাপদ নয়

নিমতলী থেকে চকবাজার। তাজরিন থেকে রানাপ্লাজা। মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। চকবাজার ট্র্যাজেডিতে ডুকরে কাঁদছে বিশ্বও। একটি মাত্র বিস্ফোরণ, অতঃপর একের পর এক; মুহূর্তে পুড়ে আঙ্গার ৬৭ প্রাণ।

Advertisement

পোড়া মানুষের আর্তনাদে বাতাস যখন ভারী, তখন কেমিক্যাল নাকি সিলিন্ডার বিস্ফোরণে অগ্নিকাণ্ড- এ বিতর্কে চাপা পড়ছে রাজধানীর মূল সমস্যা। প্রাণ হারানোর বীভৎস ছবিগুলো সামনে এলে চোখ খোলে, আলোচনা হয়। দিন কয়েক পর তাও বেমালুম ভুলে যায়। ভুলে যায় মানুষ, ভুলে যায় রাষ্ট্রও।

আরও পড়ুন >> ঢাকার চেয়ে নিকৃষ্ট শহর একটিই

নতুন কোনো ঘটনা আসে, চাপা পড়ে যায় আগেরটি। এভাবেই চলতে থাকে। এ শহরে নতুন মৃত্যু দিয়ে পুরনো মৃত্যুর শোক ভুলতে হয়।

Advertisement

রাজধানী ঢাকাকে অনেক আগেই বসবাস অযোগ্য শহর ঘোষণা করে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো। দ্য ইকোনমিস্টের ইন্টেলিজেন্স ইউনিট বা ই আইইউ’র তথ্য অনুযায়ী, কোনো মানদণ্ডেই এ শহর মানুষের বসবাসের অনুকূলে নয়। মূলত অপরিকল্পিত নগরায়ন আর উন্নয়নের কারণেই রাজধানী এখন মৃত্যফাঁদ। সামান্য অগ্নিকাণ্ডেই মানুষ আর পালানোর পথ পায় না। একই চিত্র অন্য দুর্ঘটনার বেলাতেও।

এ প্রসঙ্গে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা হয় বাংলাদেশ প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পরিবহন ও নগর উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. সামছুল হকের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘মুমূর্ষু রোগী মারা যাওয়ার আগে যেমন অতিশক্তিশালী ইনজেকশন দিয়ে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয়, তেমনি মৃতপ্রায় ঢাকাকে বাঁচানোর চেষ্টায় মেট্রোরেল বা ফ্লাইওভারের মতো প্রজেক্ট করা হচ্ছে। ঢাকা নগর এখন নিবিড় পর্যবেক্ষণে (আইসিইউ) রয়েছে বলে আমি মনে করি।’

‘দুর্ভাগ্য যে নিবিড় পর্যবেক্ষণ থেকে ঢাকা শহরকে ফেরাতে আমরাও সঠিকভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না।’

আরও পড়ুন >> অযৌক্তিক উন্নয়নই সর্বনাশের মূল কারণ

Advertisement

বিভিন্ন সংস্থা এবং বিশেষজ্ঞের তথ্য মতে, ঢাকা পৃথিবীর সর্বোচ্চ জনঘনত্বের শহর। মাত্র ৩২৫ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এ শহরে এখন প্রায় দেড় কোটি মানুষের বসবাস। প্রতি বর্গকিলোমিটারে বাস করেন ৪৬ হাজারেরও অধিক এবং বছরে নতুন করে যুক্ত হয় পাঁচ লাখেরও বেশি মানুষ। যে কারণে এটি সারা বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল মহানগরীগুলোর মধ্যে অন্যতম।

জীবনবিনাসী শত সমস্যা দিয়ে রাজধানী ঢাকাকে চিনতে হয়। পৃথিবীর সবচেয়ে দূষিত বায়ুর শহরগুলোর যে সাম্প্রতিক তালিকা পাওয়া গেছে, সেখানেও ঢাকার অবস্থান শীর্ষ তিনের মধ্যে। এ শহরে যে আবশ্যিক উন্মুক্ত এলাকা রয়েছে অর্থাৎ পার্ক, খেলার মাঠ, স্টেডিয়াম ইত্যাদি; তার সর্বমোট আয়তন রাজউকের পরিকল্পনাধীন এলাকার মোট আয়তনের এক-শতাংশেরও সমান নয়।

স্বাধীনতার পর ঢাকার মোট খালের সংখ্যা ছিল ৬৫টি। এ সংখ্যা বর্তমানে কমে দাঁড়িয়েছে ২৬টিতে। ১৯৭৮ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত সমগ্র ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় জলাধারের পরিমাণ ২৯ বর্গকিলোমিটার। এখন তা কমে ১০.২৮ বর্গকিলোমিটারে নেমে এসেছে। নগরের কঠিন বর্জ্যের প্রায় অর্ধেক তথা ৪৫ শতাংশই এখনও সংগৃহীত হয় না। যার বেশির ভাগই শেষ পর্যন্ত নিচু জমি, জলাভূমি, নদী কিংবা খালে গিয়ে পড়ে ভয়াবহ দূষণ তৈরি করছে।

রাজধানীর মোট কর্মসংস্থানের ৮০ শতাংশের বেশি অনানুষ্ঠানিক কর্মসংস্থান। অর্থাৎ তাদের নিয়োগপত্র, ট্রেড লাইসেন্স বা এ রকম কোনো আনুষ্ঠানিক দলিলপত্র নেই। এ শহরের উচ্চ ১০ শতাংশের গড় আয় সর্বনিম্ন ১০ শতাংশের গড় আয়ের প্রায় ৩২ গুণ এবং সর্বোচ্চ আয়কারী ১০ শতাংশ মানুষের মোট আয় অবশিষ্ট ৯০ শতাংশের আয়ের চেয়ে বেশি। এখানে মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ বস্তিতে বাস করে এবং এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি মানুষ রয়েছেন দারিদ্র্য-সীমার নিচে। এছাড়া নিম্ন ও মধ্যম আয়ের বেশির ভাগ মানুষের জন্য এ শহরে বাসস্থান এখনও সামর্থ্যের সীমার বাইরে।

আরও পড়ুন >> রাজধানী স্থানান্তর ছাড়া বিকল্প কিছু নেই

ঢাকায় বসবাসরত ৯৫ শতাংশ পরিবারেরই ব্যক্তিগত গাড়ির মালিকানা নেই। নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যম আয়ের অর্ধেকের বেশি মানুষ এখনও দু’পায়ের ওপর ভরসা করে চলাচল করেন।

এত সব সমস্যা জিইয়ে রেখেই উন্নয়নের গল্প হয় এ শহরে। হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করে বড় বড় প্রকল্প তৈরি হচ্ছে শহরজুড়ে। তবে সেসব প্রকল্প কোনোভাবেই মুক্তি দিতে পারছে না মানুষকে। সড়কে রক্তের দাগ। বাতাসে লাশের গন্ধ। আর স্বজন হারানোর বুকফাটা চিৎকার নিত্যসঙ্গী নগরবাসীর।

জনজীবন ও নগর প্রসঙ্গে উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ সামছুল হক আরও বলেন, ‘ইতোমধ্যে ঢাকা শহর কলাপস (আটকে) করেছে। সংকটাপন্ন রাজধানী এখন আইসিইউ-তে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এমন অবস্থায় ঢাকায় বিনিয়োগ করব নাকি এখানে স্বল্পমেয়াদে বিনিয়োগ করে রাজধানীকে ধীরে ধীরে স্থানান্তরের চেষ্টা করব।’

‘রাজধানী এখন সরিয়ে নেয়াই হচ্ছে যুগোপযোগী ও বাস্তবমুখী সিদ্ধান্ত। ভারত এমন সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিল বলেই নয়াদিল্লি পরিকল্পিতভাবে সাজাতে পেরেছে। ইসলামাবাদ অনেক সুন্দর ও পরিকল্পিত নগরী। কারণ, তারা কোনো না কোনোভাবে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে পেরেছিল।’

আরও পড়ুন >> ঢাকার মৃত্যু ঘটিয়েছে ফ্লাইওভারগুলো

সামছুল হক বলেন, ‘দুর্ভাগ্য হচ্ছে, আমরা আজও সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে পারিনি। কুয়ালালামপুর চমৎকার একটি শহর। এরপরও তারা মনে করছে বাইরের বিনিয়োগ বাড়াতে হলে রাজধানী স্থানান্তর করতেই হবে। মিয়ানমার চায়নাকে দিয়ে তাদের রাজধানীর পরিকল্পনা করছে। এ দৃষ্টান্তগুলো তো আমাদের সামনে আছে। অথচ সভ্যতার এমন সময়ও আমরা অপরিকল্পিত উন্নয়নেই আটকে আছি। উন্নয়ননীতিতে পরিবর্তন না আনতে পারলে এ শহরের একটি জীবনও নিরাপদ নয়।’

এএসএস/এমএআর/জেআইএম