`কতোরূপ স্নেহ করি, বিদেশের কুকুর ধরি, স্বদেশের ঠাকুর ফেলিয়া’- বাঙালির বিদেশ প্রীতির কথা নতুন করে বলার নেই। মুখে মুখে দেশপ্রেমের বুলি আওড়ালেও বিদেশি জিনিস না হলে যেন আমাদের চলেই না। এর মধ্য দিয়ে আভিজাত্য প্রকাশের একটি অনাবশ্যক প্রবণতা থাকে। অথচ আমাদের দেশের পাট জাতীয় পণ্য, তাঁত শিল্প, জামদানি, বেনারসি পৃথিবীর যে কোনো মানদণ্ডে বিচার্য। ভুলে গেলে চলবে না মসলিন তৈরি হতো আমাদেরই দেশেই। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে বণিকরা আসতো এসবের টানে। এখন গার্মেন্টস শিল্প তো পৃথিবী জয় করেছে। ‘মেড ইন বাংলাদেশ’- এখন এক আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড। সেই দেশে এখনও কৃষিজাত অনেকপণ্য নিদারুণ অবহেলার শিকার। বিশেষ করে সম্ভাবনাময় চিনিশিল্প এখন ধ্বংসের মুখে। মুনাফালোভী মানসিকতার কারণে আমদনি নির্ভরতা আমাদের দেশীয় চিনি শিল্পকে ধ্বংস করছে। অথচ গুণে-মানে কোনো অংশেই বিদেশি চিনির থেকে দেশীয় চিনি পিছিয়ে নেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সঠিক নীতি গ্রহণ করে চিনি শিল্পকে বাঁচানো যায়। এতে একদিকে মানুষজন যেমন অপেক্ষাকৃত কম দামে চিনি পাবে তেমনি আখচাষীরাও লাভবান হবে। বাঁচবে চিনি কলগুলোও। সম্প্রতি চিনি আমদানিতে ২০ শতাংশ সংরক্ষণমূলক শুল্ক আরোপ করেছে এনবিআর। একই সঙ্গে পরিশোধিত ও অপরিশোধিত চিনি আমদানিতে নতুন ট্যারিফ মূল্য নির্ধারণ করছে সরকার। এর ফলে দেশীয় চিনি শিল্পগুলো সুরক্ষা পাবে বলে আশা করা যাচ্ছে। বুধবার এ নির্দেশ দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। নির্দেশ অনুযায়ী, পরিশোধিত চিনি প্রতি টন চারশ ডলার এবং অপরিশোধিত চিনির টনপ্রতি ট্যারিফ মূল্য তিনশ ২০ ডলার নির্ধারণ করা হয়েছে। এই ট্যারিফ মূল্যের ওপর ২০ শতাংশ সংরক্ষণমূলক শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এর সঙ্গে অপরিশোধিত চিনির ক্ষেত্রে টনপ্রতি দুই হাজার স্পেসিফিক ডিউটি ও পরিশোধিত চিনির ক্ষেত্রে সাড়ে চার হাজার টাকা স্পেসিফিক ডিউটি এবং চার শতাংশ অগ্রিম ভ্যাট (এটিভি) বহাল থাকবে। শুল্ক আরোপের ফলে আমদানি করা চিনির বাড়তে পারে। তবে এই বৃদ্ধির মূল লক্ষ্য যেন হয় দেশীয় চিনি শিল্পকে রক্ষা করা। বর্তমানে রাষ্ট্রায়ত্ত ১৫টি চিনি কলের শ্রমিকরা মানবেতর জীবন-যাপন করছে। আখচাষীরাও আখের নায্যমূল্য পাচ্ছে না। দেশে আমদানি করা অপরিশোধিত চিনি পরিশোধিত করে ৫০ শতাংশ রপ্তানি করার নিয়ম। কিন্তু আমদানিকারকরা সেটি মানছেন না। অথচ এই শর্তের কারণে তারা শুল্ক কম দিচ্ছে। এমন রাজস্বনীতি দেশীয় চিনি শিল্পের বিকাশের জন্য সহায়ক নয়। দেশে প্রতি বছর চিনির চাহিদা ১৫ লাখ টন। বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্পের অধীনে ১৫টি মিলের উৎপাদন ক্ষমতা ২ লাখ ১০ হাজার ৪৪০ টন। বাকি চিনির চাহিদা পূরণ হয় বেসরকারি খাতের রিফাইনারি মিলগুলোর মাধ্যমে।এটা ঠিক দেশীয় চাহিদা মিটানোরমেতো চিনি উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে কৃষকরা যদি আখের ন্যায্য মূল্য পেত, চিনিকল মালিকরা যদি উৎপাদন খরচ উঠাতে পারতো তাহলে চিনি উৎপাদনে বাংলাদেশ অনেকদূর যেতে পারতো। যেটুকু উৎপাদন হচ্ছে সেগুলোও পড়ে থাকছে গুদামে। একদিকে গুদামে চিনি নষ্ট হচ্ছে, অন্যদিকে বেশি দামে আমদানি করা চিনি বিক্রি হচ্ছে। এই বৈপরীত্য কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। অপরিশোধিত চিনি পরিশোধিত করে ৫০ শতাংশ রপ্তানি করার যে শর্ত সেটি যাতে আমদানিকারকরা মানতে বাধ্য হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। দেশীয় চিনি শিল্পকে বাঁচানোর জন্য ক্রেতাদেরও এগিয়ে আসতে হবে। সে ক্ষেত্রে ‘দেশীয় পণ্য কিনে হই ধন্য’- দীক্ষিত হতে হবে এই মূল মন্ত্রে। এইচআর/এমএস
Advertisement