>> খাদ্য মন্ত্রণালয় ৪,১৬,৪৪০ মার্কিন ডলার ক্ষতিপূরণ দাবি করে>> ১১,৩২,৪১১ ডলার চার প্রতিষ্ঠানকে দেয়ার নির্দেশ আদালতের
Advertisement
খাদ্য অধিদফতরের মাধ্যমে ২০ হাজার মেট্রিক টন চাল আমদানির জন্য ১৯৯৫ সালে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে ভারতের চার প্রতিষ্ঠানের চুক্তি হয়। পরবর্তীতে তাদের কাছ থেকে ১৮ হাজার ৩৭১ দশমিক ৬৩৭ মেট্রিক টন চাল গ্রহণ করে অধিদফতর।
চুক্তি অনুযায়ী গুণগতমান ভালো না হওয়ায় এক হাজার ৬২৮ দশমিক ৩৬৩ মেট্রিক টন চাল গ্রহণ করেনি বাংলাদেশ। এর পরিপ্রেক্ষিতে খাদ্য মন্ত্রণালয় সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে চার লাখ ১৬ হাজার ৪৪০ মার্কিন ডলার ক্ষতিপূরণ দাবি করে। কিন্তু সংক্ষুব্ধ হয়ে সরবরাহকারী চার প্রতিষ্ঠান মামলা করে এবং রায় তাদের পক্ষে যায়।
আরও পড়ুন >> ভারতীয় চালে মুখভার দেশীয় ব্যবসায়ীদের
Advertisement
ফলে চাল না দিয়েই ১১ লাখ ৩২ হাজার ৪১১ মার্কিন ডলার অর্থাৎ এক দশমিক ১৩২ মিলিয়ন ডলার নিয়ে যায় ভারতের চার প্রতিষ্ঠান। অর্থ মন্ত্রণালয় ও খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এক চিঠিতে বলা হয়, খাদ্য অধিদফতরের মাধ্যমে চাল আমদানির জন্য ১৯৯৫ সালে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে ভারতের কোথারি ফারমেন্টেশন অ্যান্ড বায়োসিম লিমিটেড, কোথারি ফারমেন্টেশন অ্যান্ড বায়োকেমিক্যাল, সম্পদ ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন কোম্পানি এবং কোথারি গ্লোবাল লিমিটেডের চুক্তি হয়। চুক্তিসমূহের মধ্যে বিজি-১৩/১৯৯৫ অনুসারে, এসব প্রতিষ্ঠান খাদ্য মন্ত্রণালয়কে ২০ হাজার মেট্রিক টন সিদ্ধ চাল সরবরাহ করে। কিন্তু চালের গুণগতমান ভালো না হওয়ায় খাদ্য অধিদফতর ২০ হাজার মেট্রিক টনের মধ্যে ১৮ হাজার ৩৭১ দশমিক ৬৩৭ মেট্রিক টন চাল গ্রহণ করে। অবশিষ্ট এক হাজার ৬২৮ দশমিক ৩৬৩ মেট্রিক টন গ্রহণ করেনি। চুক্তি অনুসারে সম্পূর্ণ চাল সরবরাহ করতে না পারায় সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে খাদ্য মন্ত্রণালয় চার লাখ ১৬ হাজার ৪৪০ মার্কিন ডলার ক্ষতিপূরণ দাবি করে।
এরপর সংক্ষুব্ধ হয়ে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষে কোথারি ফারমেনন্টেশন অ্যান্ড বায়োসিম লিমিটেড খাদ্য মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে চারটি আরবিট্রেশন বা সালিসি মামলা করে। শুনানির পর চারটি আরবিট্রেশনের বিপরীতে সরবরাহ প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে চারটি অ্যাওয়ার্ড দেয়া হয়। আরবিট্রেশন অ্যাওয়ার্ডে ১১ লাখ ৩২ হাজার ৪১১ ইউএস ডলার সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে দেয়ার জন্য মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেয়া হয়। এ অ্যাওয়ার্ড সরকারের পক্ষ হতে কার্যকর না করায় কোথারি ফারমেনন্টেশন অ্যান্ড বায়োসিম লিমিটেড ঢাকার জেলা জজ আদালতে চারটি মামলা দায়ের করে। সব মামলা একত্রে শুনানির পর খাদ্য মন্ত্রণালয়ের বিপক্ষে রায় আসে।
আরও পড়ুন >> অতিরিক্ত চাল আমদানিতেই কৃষকের সর্বনাশ
Advertisement
ওই রায়ের বিরুদ্ধে সরকারের পক্ষ হতে চারটি আরবিট্রেশন মিস কেস দায়ের করা হয়। আরবিট্রেশন মিস মামলাগুলোও একত্রে শুনানির পর আদালত সরকারের বিপক্ষে রায় দেন। একই সঙ্গে কোথারি গ্লোবাল লিমিটেড কোম্পানি তাদের দাবিকৃত টাকা অবমুক্তির জন্য হাইকোর্ট বিভাগে রিট দায়ের করে। আদালত ৬০ দিনের মধ্যে পারফরমেন্স গ্যারান্টি বন্ড ফেরত প্রদানের জন্য আদেশ দেন। রিটের আদেশ খাদ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক বাস্তবায়ন না করায় খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিবকে বিবাদী করে গত ২০১২ সালের ২৮ জুন আদালত অবমাননা মামলা দায়ের করা হয়।
২০১২ সালের ১৭ জুলাই খাদ্য সচিব ব্যক্তিগতভাবে আদালতে উপস্থিত হয়ে মামলার রায় বাস্তবায়নের জন্য সময় প্রার্থনা করেন। পরবর্তীতে সরকারের পক্ষ হতে ফাস্ট আপিল দায়েরের জন্য আবেদন করা হলে আদালত এফএ মামলা দায়েরের সুযোগ দেন। শুনানির পর মামলাগুলোও সরকারের বিপক্ষে খারিজ করে দেয়া হয়।
এফএ মামলার আদেশের বিরুদ্ধে সরকারপক্ষ হতে সিভিল পিটিশন ফর লিভ টু আপিল দায়ের করা হয়। শুনানির পর আদালত মামলাটিও ডিসমিস করে দেন। সিভিল পিটিশন ফর লিভ টু আপিল আদেশের বিরুদ্ধে সরকারপক্ষের মামলার শেষ ধাপ রিভিউ পিটিশন দায়ের করা হয়।
২০১৮ সালের ২৫ অক্টোবর আদালত শুনানির পর রিভিউ মামলাটিও ডিসমিস করে দেন। অপরদিকে, ডিক্রি জারি মামলা বাস্তবায়নের জন্য কোথারি গ্রুপ কর্তৃক এক্সিকিউশন মামলা আনায়ন করা হয়। এসব মামলায় খাদ্য সচিবের দাফতরিক আসবাবপত্র ক্রোকের আদেশ জারি হয়।
ওই চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়, ভারতের কোথারি ফারমেন্টেশন অ্যান্ড বায়োসিম লিমিটেড এবং খাদ্য মন্ত্রণালয়ের মধ্যে উদ্ভূত সব মামলার রায় সরকারের বিপক্ষে হয়েছে। সব মামলার সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত সরকারপক্ষ হতে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সত্ত্বেও মামলায় হেরে যাওয়ার কারণে আদালতের আদেশ অনুসারে চারটি প্রতিষ্ঠানকে মোট ১১ লাখ ৩২ হাজার ৪১১ দশমিক ২৩ মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ নয় কোটি ৫১ লাখ ২২ হাজার ৫৪৩ টাকা আবশ্যকভাবে প্রদান করতে হবে।
এর মধ্যে কোথারি ফারমেন্টেশন অ্যান্ড বায়োসিম লিমিটেডকে এক লাখ ৫২ হাজার ৫৬৬ দশমিক ৬০ ডলার, কোথারি ফারমেন্টেশন অ্যান্ড বায়োকেমিক্যাল লিমিটেডকে দুই লাখ ৭৪ হাজার ৪৫৫ দশমিক ২৯ ডলার, সম্পদ ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেডকে চার লাখ ৪৬ হাজার ৭২৭ দশমিক ৬০ ডলার এবং কোথারি গ্লোবাল লিমিটেডকে দুই লাখ ৫৮ হাজার ৬৬১ দশমিক ৭৪ ডলার প্রদান করতে হবে।
আরও পড়ুন >> অস্থির চালের বাজার, নেপথ্যে ভারত
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, পর্যালোচনায় দেখা যায়, চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন ‘আদালত রায়/আদেশ অনুযায়ী অর্থ পরিশোধ’ খাতে বরাদ্দ প্রদান করা হয়নি। এছাড়া ডলারের বিনিময় হার পরিবর্তনশীল। এ পরিপ্রেক্ষিতে ওই খাতে নয় কোটি ৭০ লাখ টাকা বরাদ্দ প্রদান কিংবা চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটে খাদ্য অধিদফতরের নিজস্ব সম্পদ দ্বারা আমদানির আওতায় চাল ক্রয় খাতে বরাদ্দকৃত অর্থ হতে অর্থ পরিশোধ উপযোজনে অর্থ বিভাগের সম্মতি চাওয়া হয়েছে। আদালতের রায় বাস্তবায়নের স্বার্থে এ পর্যায়ে নতুনভাবে অর্থ বরাদ্দ না করে প্রস্তাবিত পুনঃউপযোজনে সম্মত হওয়া যায়।
এমন প্রেক্ষাপটে আদালতের রায় বাস্তবায়নকল্পে ভারতীয় চাল সরবরাহকারী চার প্রতিষ্ঠানকে ১১ লাখ ৩২ হাজার ৪১১ দশমিক ২৩ মার্কিন ডলার পরিশোদের নিমিত্তে চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটে খাদ্য অধিদফরের নিজস্ব সম্পদ দ্বারা আমদানির আওতাধীন ‘চাল ক্রয়’ খাতে বরাদ্দকৃত দুই হাজার ৭০৪ কোটি ৮০ লাখ টাকা হতে ডলারের বিনিময় হার পরিবর্তনের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে নয় কোটি ৫২ লাখ টাকা পনঃউপযোজনে সম্প্রতি অর্থ বিভাগ সম্মতি জানায়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে খাদ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক মো. আরিফুর রহমান অপু জাগো নিউজকে বলেন, ‘চাল বা অন্যকোনো পণ্য চুক্তি অনুযায়ী মানসম্পন্ন না হলে তা গ্রহণ করা হয় না। একই সঙ্গে সময়মতো ও মানসম্মত পণ্য না দেয়ার কারণে সরবরাহকরী প্রতিষ্ঠানের নিকট থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করা হয়।‘
তাহলে কেন ভারতের চার প্রতিষ্ঠানকে উল্টো টাকা দেয়া লাগলো- এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এটা একটু ভিন্ন বিষয়। আমরাই প্রথমে ক্ষতিপূরণ দাবি করেছিলাম। কিন্তু সেটার পরিমাণ বেশি হয়ে যায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে তারা আদালতে মামলা করে এবং মামলার রায় তাদের পক্ষে যায়। এ কারণে তারা অর্থ ফেরত পায়।’
আরও পড়ুন >> কী পরিমাণ চাল কতদিন মজুদ রাখা যাবে
এ বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘এটা আদালতের রায়, মানতেই হবে। অন্যদিকে, এটা খুবই উদ্বেগের বিষয়। আসলে খাদ্য অধিদফতর কিসের ভিত্তিতে মানসম্মত নয় বললো, আবার আদালতে গিয়ে মানসম্মত নয়- এটা প্রমাণ করতে পারলো না। এ বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা দরকার। অবশ্যই খাদ্য অধিদফতর চালের গুণগত মান ভালো ছিল না- এটা নিশ্চিত হয়েই আদালতে গিয়েছিল। তাহলে আদালতের রায়ের পর আন্তর্জাতিক আরবিট্রেশনেও যাওয়া যেত।’
এমইউএইচ/এমএআর/পিআর