মতামত

অস্বীকার করে সত্য আড়াল হয় না মাননীয় মন্ত্রী

ঘটনাবহুল এই দেশের বাসিন্দা আমরা। সৌভাগ্য হোক আর দুর্ভাগ্য হোক প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে আমরা সাক্ষি হচ্ছি নানারকম ঘটনার যেগুলোর বেশিরভাগই নাগরিক জীবনের ঘটে যাওয়া এবং সেগুলো আঘাত করে চলেছে আমাদের সাধারণ জীবনযাপনকে।

Advertisement

প্রতিদিন একেকটি ঘটনা ঘটছে আর তার মাত্রা অনুযায়ী প্রতিক্রিয়া করছি আমরা। ঘটনার ভয়াবহতার উপর নির্ভর করে প্রতিক্রিয়া করেন দায়িত্বশীল ব্যক্তিরাও। তবে এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এমন এক শক্তিশালী জায়গায় পৌঁছেছে যে নাগরিক জীবনে ঘটে যাওয়া কোন নেতিবাচক ঘটনাই আর প্রতিক্রিয়াবিহীন থাকে না এবং ঘটনার সত্যতাও আর আড়ালে থাকার উপায় নেই।

২০ ফেব্রুয়ারি রাতে চকবাজার এলাকায় যে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে গেলো যেখানে তাজা ৮১ টি প্রাণ ঝরে গেলো একনিমিষেই আর হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে মৃত্যুর প্রহর গুণছে আরও কয়জন তার কারণ অনুসন্ধানে চলছে সরকারি বেসরকারি শুনানী।

প্রথম দিনেই সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী মন্তব্য করেছেন যে সেখানে কোন কেমিকেলের গোডাউন ছিল না আর তাই কেমিকেল থেকে আগুন লাগার প্রশ্নই আসে না। অবশ্য তিনি মন্তব্য করেননি এক প্রকার অস্বীকারই করে এসেছেন।

Advertisement

তবে মন্ত্রীর এ অস্বীকার থামাতে পারেনি সত্যানুসন্ধানী মানুষের কার্যক্রমকে। এমনকি খোদ তদন্ত কমিটি স্বীকার করেছে যে সেখানে কেমিকেলের বিপুল সরবরাহ ছিল। একথা অস্বীকারের কোন কি উপায় আছে যে পুরানা ঢাকার আনাচে কানাচে গড়ে উঠেছে এমন প্রচুর রাসায়নিক পদার্থের কারখানা ও গোডাউন? এরজন্য নেই কোন নির্দিষ্ট সীমানা বা নিয়ম কানুন। আবাসিক বাসভবনেই চলছে এসবের ব্যবসা। সবাই জানছি আমরা কিন্তু আটকানোর কেউ দায় বোধ করেনি।

২০১০ সালের সেই একই পুরান ঢাকার নিমতলির ঘটনা আজও আমাদেরকে পীড়া দেয়। দগদগে ঘা এখনও শুকিয়ে যায়নি স্বজন-হারা সেইসব পরিবারগুলোর। তখন ঝড়ে পড়েছিলো ১২৯ টি প্রাণ। ঠিক এই চকবাজারের মতই সেখানেও ছিলো কোন সন্তানের মা, নব্য বিবাহিত স্ত্রী, সন্তান সম্ভবা মায়ের লাশ।

এবারেও আমরা মানবতার ঢেঁকুর তুলছি স্ত্রীকে বাঁচাতে পারছে না বলে আত্মাহুতি দেয়া স্বামীটির জন্য। কিন্তু ২০১০ সালের সিদ্ধান্তকে ভুলে গিয়েছিলাম আমরা। সেই ঘটনাতেও আমাদের মেয়র, মন্ত্রীরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছিলেন পুরান ঢাকা থেকে সমস্ত রাসায়নিক পদার্থের কারখানা সরানোর জন্য। আফসোস হচ্ছে সেদিনের সেই নির্দেশ কেবল কাগজেই ঠাঁই পেয়েছে।

মেয়র মহোদয় বলেছেন ব্যবসায়ীরা তার কথা শুনেনি। ব্যবসায়ীরা যদি তাঁর কথা নাই শুনেন তবে তিনি আর কী কী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন সেটা কিন্তু জানান নি। উনার যে প্রশাসনিক ক্ষমতা আছে সেগুলোর সব কী তিনি ব্যবহার করেছিলেন? এই বাংলাদেশে কারা এতটা শক্তিশালী হয়ে গেলেন যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশকেও অমান্য করতে পিছ পা হন না। কারা ছিলো এর পিছনে সেখানে কী আঘাত করা হয়েছিলো? না, হয়নি। হলে আজকে আরেকটি চকবাজার ঘটতোনা। গোটা বিশ্ব আজকে স্তব্ধ এই ঘটনায়। মানুষের জীবন বড় না ব্যবসা বড়?

Advertisement

প্রতিটা ঘটনার পরপরই আমাদের নেতারা আসেন, একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে দেন আর এমন কিছু মন্তব্য করেন যেখানে সেই কমিটির উপর মানুষের আস্থা আগেই নষ্ট হয়ে যায়। আমরা দেখেছি আমাদের শিক্ষা খাতেও এমন অস্বীকারের সংস্কৃতি ছিলো। প্রাক্তন মন্ত্রী কিছু হলেই আগে অস্বীকার করতেন তারপর তদন্তের আশ্বাস দিতেন। এতে কি তিনি শেষ রক্ষা করতে পেরেছিলেন? পারেন নি কারণ এখন কোন বিষয় আর লুকানোর উপায় নেই।

ট্রান্সপারেন্সি আপনারা রক্ষা না করলেও সাধারণ মানুষের কাছেই আছে সে অস্ত্র। আজকাল মানুষ সবকিছুই মোবাইলে ধারণ করে রাখে। সিটিজেন জার্নালিজম এখানেই সফল যে যেখানে মিথ্যাচার বা অস্বীকৃতির বিষয় আসে সেখানেই নাগরিকের চোখ এসে হাজির হয়। সিলেটের একটি বাচ্চাকে হাওয়া দিয়ে মেরে ফেলার ঘটনার রায়েও মাননীর হাইকোর্ট এমনি মানুষের চোখকেই গ্রহণ করে ঐতিহাসিক স্বীকৃতি দিয়েছিলেন।

আমরা চকবাজারের ঘটনার কারণ হিসেবে এখনও নতুন নতুন কাহিনী শুনছি। প্রতিদিনের সংবাদগুলো আমাদেরকে ভাবতে শিখাচ্ছে নতুন করে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী হাসপাতালের বিছানায় শোয়া অসহায় মানুষগুলোকে দেখতে গিয়েছেন। তিনি আবারও নির্দেশ দিয়েছেন পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিক দ্রব্যের কারখানা সরানোর। পুরনো আদেশ বাস্তবায়ন না হওয়ায় কষ্ট পেয়েছেন, দুঃখ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু এই ব্যর্থতা কার? এ ব্যর্থতা আপনার নয় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। এ ব্যর্থতা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, মেয়রসহ কয়েকজনের। তারাই প্রশ্রয় দিয়েছেন ব্যবসায়ীদেরকে এই ঔদ্ধত্য দেখানোর।

এবারের মন্ত্রিপরিষদ দেখে আমরা নাগরিকেরা অনেক বেশি আশাবাদী হয়েছিলাম। আছি এখনো। পুরনো ও গতানুগতিক রাজনৈতিক নেতৃত্বের আচরণে আমরা ত্যক্ত বিরক্ত ছিলাম। দায়িত্বে অবহেলার কারণে যদিও আমাদের দেশে এখনও পদত্যাগের মত সংস্কৃতি তৈরি হয়নি কিন্তু আমরা আশা করি ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনার দায় স্বীকার করার মত সৎসাহস দেখাবেন আমাদের প্রশাসনের লোকেরা।

এ কথা মাথায় রাখতে হবে যে এ এক বদলে যাওয়া বাংলাদেশ যেখানে পুরনো ধারার ধানাই পানাই দিয়ে আর মানুষকে শান্ত রাখা যাবেনা। যে ঘটনার যে কারণ সেটিকে ধরেই সমস্যার সমাধানের ব্যবস্থা নিতে হবে কর্তৃপক্ষকে। এর থেকে পরিত্রানের পুরষ্কার কেবল জনগনের প্রত্যাখ্যান। আর কিছু নয়। ইতিহাসের শিক্ষা বলে একটা কথা প্রচলিত আছে যদিও আমরা এটাও দেখি যে আমাদের দেশে ইতিহাসের শিক্ষা মানেই ইতিহাস থেকে শিক্ষা না নেয়ার অভ্যাস।

২০১০ এর ঘটনার থেকে যদি আমরা শিক্ষা নিয়ে উচিত কাজটা করে ফেলতাম তবে আজকের ২০১৯ এর ফেব্রুয়ারিতে এসে আমাকে বা আমার মত হাজার মানুষকে আর এমন বক্তব্য দেয়ার সুযোগ আসতোনা। আমরা গালি দিয়ে শান্তি পেতে চাইনা। চাই যার যে কাজের দায়িত্ব তিনি সেই কাজটি নিষ্ঠা ও দেশপ্রেমের সাথে করতে পিছ পা হবেন না।

এই কাজটি করতে যদি জনগণকে পাশে চান তবে আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি আপামর জনতা আপনাকে গার্ড দিয়ে এগিয়ে যাবে। মানুষের জীবনের চেয়ে বড় কোন স্বার্থ থাকতে পারে না। তাই আশা করছি আমাদের মন্ত্রী, এমপি বা প্রশাসনের লোকেরা চকবাজারের ঘটনা থেকে নিজেদের প্রাপ্য শিক্ষাটুকু নিবেন এবং যথাযথ কাজটুকু সম্পাদন করবেন যাতে আর কোন নিমতলি বা চকবাজার ফেরত না আসে।

লেখক : কলামিস্ট। priompritom@gmail.com

এইচআর/আরআইপি