মতামত

শুধু দুর্ঘটনা নয়

চকবাজারের সংকীর্ণ গলি অথবা মহাখালীর কড়াইল বস্তির সঙ্গে গুলশানের আলো-ঝলমল রাজপথের ব্যবধান দুস্তর। মিল শুধু একটিই- কোনো আলো বা কোনো অন্ধকারেই যে মিল ঢাকা পড়ে না। যে প্রান্তেই হোক, অগ্নি-নিরাপত্তার প্রশ্নটি এই শহরে সমান অবহেলিত। নয় বছর আগে নিমতলীতে কেমিক্যাল গুদামে আগুন লেগে শত মানুষের মৃত্যুর পর গত ২০ জানুয়ারি চকবাজারে ৭০ জনের কয়লা হওয়া স্পষ্ট করে দিলো এই শহরের অসুখ গভীরতর। রাজধানী ঢাকার এক ভয়ঙ্কর দুর্নাম যখন-তখন আগুন লাগা। চকবাজারের আগুন নির্বাপিত হয়েছে। কর্তৃপক্ষ আছে অনেক, কর্তা আছেন। তারা কথা বলছেন অনেক। আমাদের মেয়র, আমাদের মন্ত্রীরা, সচিবরা, কর্তাব্যক্তিরা জানেন জনগণের ক্ষোভ বা হতাশা আর কয়েকদিন পরেই প্রশমিত হয়ে যাবে, নতুন কোনো বিপর্যয় বা উৎসব এসে চকবাজারের বেদনাকে অনেক দূরে নিয়ে যাবে। ঢাকা কেবলই আকাশ ছুঁই ছুঁই করছে। কত সুরম্য ভবন। কিন্তু আগুন থেকে বাঁচার জন্য এসব ভবনের অনেকগুলোতেই নেই কোনো ব্যবস্থা, নেই কোনো সুনির্দিষ্ট বিধি বা আইন। আগুন লেগে গেলে তা নিয়ন্ত্রণে আনার সক্ষমতাও বাড়ছে না সেই গতিতে, যে গতিতে অগ্নিকাণ্ডের সংখ্যা বাড়ছে।

Advertisement

মানুষের জীবন-মরণের প্রশ্ন। বিধির ফাঁক গলে যখন একের পর এক আগুনের ঘটনা ঘটে, তখন বোঝা যায়, উচ্চমানের অগ্নি-নিরাপত্তা যেমন চাই, তেমনি মানুষের জন্য অনেক বেশি প্রয়োজন সরকারের প্রতিজ্ঞা রক্ষা করা। নয় বছর আগে বলা হয়েছিল শিক্ষা হয়েছে, রাসায়নিক গুদাম বা কারখানা পূরণে ঢাকায় থাকবে না। এবারও সড়কমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বললেন, শিক্ষা হয়েছে।

মেয়র বলছেন, পুরনো ঢাকায় রাসায়নিক কারখানা বা গুদাম থাকবে না। আমরা জানি না সত্যি কোন কাজ হবে কিনা। মানুষের জীবনের সুরক্ষায় এবার সত্যি কোনো ব্যবস্থা নেয়া হবে কিনা। শুধু এটুকু জানি আন্তর্জাতিক মানের বিধি তৈরি হলেও যতক্ষণ প্রশাসন তা প্রয়োগ করতে আন্তরিকভাবে চেষ্টা না করবে, ততক্ষণ সব বিধিই অসার। পরিদর্শক দলের হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিলেই আর নিয়ম মানার দায় থাকে না; এই অভিজ্ঞতা সর্বস্তরের। পরিদর্শন করার পর দোষ পায়নি, কিন্তু পরে আগুন লেগেছে এমন ঘটনা অসংখ্য।

তাহা শুধু টাকার জোরের প্রশ্ন না। ঢাকার মূল অসুখ, অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার গুরুত্ব বুঝতে এই শহর নারাজ। প্রশাসনও গুরুত্ব বুঝিয়ে দিতে পারেনি। সেই চেষ্টাও কখনও হয়নি। প্রতিবার আগুন লাগবার পর অবহেলার ছবিটি স্পষ্ট হয়। তার চেয়ে বেশি স্পষ্ট হয় আমাদের নীতি নির্ধারকরা যে এ কথা কথা বলেন। তারা টেলিভিশনের সামনে এসে বলেই যাচ্ছেন এটা করা হবে, সেটা করা হবে। কিন্তু কখনও কিছু করা হয় না। দুর্ঘটনা প্রতিদিন ঘটে না। যতক্ষণ না দুর্ঘটনা ঘটছে ততক্ষণ পর্যন্ত তার অভিঘাতের সম্পূর্ণ মর্ম উপলব্ধি করা মানুষের পক্ষে অসম্ভব। ফলে, প্রতিরোধক ব্যবস্থা গ্রহণের আর্থিক ভার স্বভাবতই অনেকের নিকটই গুরুতর ঠেকে। এবং তারা সেই ভার এড়িয়ে চলেন। নিমতলীর পর অনেকেই ভেবেছিলেন পুরনো ঢাকার মানুষ নিজেরা অন্তত সচেতন হবেন। বাড়ির নিচে দাহ্য পদার্থের স্তুপ বা কারখানা রেখে তারা কি করে যে ঘুমাতে পারেন, তা কেবল তারাই বলতে পারবেন। আইন মেনে সব ব্যবস্থা করতে হলে বহু বাড়িকেই কিছুদিনের জন্য খালি করতে হবে। এটা চান না বলেই বিপদের ঝুঁকি নিয়েও এখানে এভাবে থাকেন। তাই বিষয়টি বর্তায় প্রশাসনের ওপর। নিমতলী থেকে চকবাজার, কড়াইল থেকে গুলশানের ডিসিসি মার্কেট বা বেগুনবাড়ি বা কারওয়ান বাজারে এনটিভি আরটিভি ভবনে আগুন, প্রতিটি ক্ষেত্রেই বহিরঙ্গের চাকচিক্যের আড়ালে যে মারাত্মক বিপদটি লুকিয়ে আছে সেটা প্রশাসন তা দেখেও দেখেনি।

Advertisement

নগর ব্যবস্থাপনা সর্ম্পকে যার সামান্য ধারণাও আছে, সেও জানে দমকল বা পৌরসভার ছাড়পত্র, বিষ্ফোরক অধিদফতরের সনদ কাঞ্চনমূল্যে কেনা সম্ভব। তার জন্য প্রকৃত কোনো ব্যবস্থা নিতান্তই অবান্তর। অগ্নি নিরাপত্তার ব্যবস্থা আছে কিনা, তার নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ হচ্ছে কিনা, এই শহরে সেই নজরদারি নেই বললেই চলে। রাজনৈতিক সরকার কঠোর না হলে চিত্রটি বদলাবে না। নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বিন্দুমাত্র গাফিলতিও বরদাস্ত করা হবে না, এই কথাটি প্রশাসনের সর্ব স্তরে বুঝিয়ে দিতে পারেন কেবল প্রধানমন্ত্রী।

যে প্রতিষ্ঠানগুলোর অবহেলায় এমন ঘটনা ঘটলো, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার এখনই সময়। তা না হলে এই শহর আরও অনেক বিপদের অপেক্ষায় থাকবে।

কেমিক্যাল কারখানা সেখানে থাকবে না, সরিয়ে নিতে হবে। সরিয়ে যে জনপদে নেয়া হবে তাদের বিপদও বাড়বে যদি একটা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে তা না করা হয়। আশা করছি প্রধানমন্ত্রী নিজে নজর দেবেন। নাগরিক সমাজেরও দায়িত্ব আছে। প্রশাসন তার দায়িত্ব পালন করবে, কিন্তু আমরাও কেবল বিল্ডিং বানিয়েই যাবো, নিরাপত্তায় উদাসীন থাকব, তা হতে পারে না।

চকবাজারের আগুনকে শুধু দুর্ঘটনা বললে ভুল হবে। সংশ্লিষ্ট বিভাগুগুলোর কর্তব্যে অবহেলার চরম দৃষ্টান্ত এটি ঘটনা। জনজীবন কতটা অরক্ষিত সেটি স্পষ্ট করেছে এই ঘটনা। নিহত আর আহতদের কিছু টাকার ক্ষতিপূরণ দিয়ে দায় সারার সংস্কৃতি সমাপ্তি হোক এবার।

Advertisement

লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি। এইচআর/এমআরএম/আরআইপি