বিশেষ প্রতিবেদন

যেমন হবে স্বপ্নের টানেল

ভারতের মিজোরামের লুসাই পাহাড় থেকে নেমে আসা স্রোতস্বিনীর কোনো এক বাঁকে চট্টগ্রামের রাজপুত্রের সঙ্গে পরিচয় আরাকান (বর্তমানে রাখাইন) রাজকন্যার। প্রেমিকের দেয়া ফুল উদ্ধারে যে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়েন রাজকন্যা, তা আজ ইতিহাসের কর্ণফুলী। সেই রাজকন্যা কি জানেন? তাদের করুণ প্রেমকাহিনি থেকে নারকরণ করা নদীর বুকেই রচিত হচ্ছে বাংলাদেশের নতুন ইতিহাস!

Advertisement

না… ইতিহাসের সেই মাহেন্দ্রক্ষণের এতটুকুও টের পাবেন না রাজকন্যা। কর্ণফুলীর তলদেশ থেকে অন্তত ৪০ মিটার গভীরতায় এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিয়ে চলে যাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল। শুধু কি রাজকন্যা? ওই গভীরে কী কর্মযজ্ঞ শুরু হতে যাচ্ছে তা আঁচও করতে পারছেন না কর্ণফুলীর হাজার বছরের সঙ্গী সাম্পানওয়ালা, জেলে আর মাঝি-মাল্লারাও।

চট্টগ্রামের পতেঙ্গা পয়েন্টে বসানো হয়েছে টিবিএম মেশিন, যা নদীর তলদেশে টানেলের খননকাজ চালাবে

আগামী রোববার (২৪ ফেব্রুয়ারি) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ বিশাল কর্মযজ্ঞের উদ্বোধন করবেন।

Advertisement

বৃহস্পতিবার (২১ ফেব্রুয়ারি) সকালে চট্টগ্রাম নগরের পতেঙ্গায় টানেল প্রজেক্ট এলাকায় দেখা যায়, রাজ্যের ব্যস্ততা। শত শত দেশি-বিদেশি শ্রমিকের নিপুণ হাতে কর্ণফুলীর পাড়ে চলছে কাজের মহাযজ্ঞ। খননের মূল কাজ শুরুর আগেই সব প্রস্তুতি সেরে নিচ্ছেন দেশি-বিদেশি প্রকৌশলী, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

টানেলে প্রবেশ পথে টিবিএম মেশিনের বসানোর পর সর্বশেষ অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছেন চীনা প্রকৌশলীরা

চট্টগ্রামের পতেঙ্গা এলাকায় কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক হারুনুর রশীদ জাগো নিউজকে বলেন, এ প্রকল্পে দেশি-বিদেশি প্রায় এক হাজার ২০০ লোক তিন শিফটে কাজ করছেন। এরই মধ্যে নদীর দুই অংশে প্রকল্পের ২৪ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। ২৪ তারিখ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খনন কাজের উদ্বোধনের পরপরই শুরু হবে টানেল বোরিং মেশিন (টিবিএম) দিয়ে সুড়ঙ্গ পথ তৈরির কাজ।

খননকাজের মূল যন্ত্র টিবিএম মেশিন তিনতলা ভবনের সমান আয়তনের, এর ভেতরটা যেমন

Advertisement

যেমন হবে স্বপ্নের টানেল

টানেলের দৈর্ঘ্য হবে ৩ দশমিক ৪ কিলোমিটার। নদীর তলদেশ দিয়ে দুটি টিউবে চারলেন টানেল সড়ক নির্মাণ করা হবে। এর পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তে সাড়ে ৫ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক থাকবে। নদীর পূর্ব ও পশ্চিম উভয় পাশের সংযোগ সড়কসহ এ প্রকল্পের দৈর্ঘ্য হবে ৯ দশমিক ৩৩ কিলোমিটার।

খননকাজের মূল যন্ত্র টিবিএম মেশিন তিনতলা ভবনের সমান আয়তনের, এর ভেতরটা যেমন

এর মধ্যে আনোয়োরা প্রান্তে ৭০০ মিটারের একটি ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হবে, যা আনোয়ারা চাতুরী চৌমুহনীতে এসে চট্টগ্রাম আনোয়ারা বাঁশখালী পিএবি সড়কের সঙ্গে মিলিত হবে। টানেলের প্রবেশ প্রান্ত মিলিত হবে নগরীর পতেঙ্গা নেভাল একাডেমি পয়েন্ট থেকে। গড়ে উঠবে সাংহাইয়ের মডেলে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন।’

প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, টানেল দিয়ে বছরে প্রায় ৬৩ লাখ গাড়ি চলাচল করবে। চালুর তিন বছর পর ওই সংখ্যা দাঁড়াবে ৭৬ লাখে। চালুর প্রথম বছরে চলাচল করা গাড়ির প্রায় ৫১ শতাংশ হবে কন্টেইনারবাহী ট্রেইলর এবং বিভিন্ন ধরনের ট্রাক ও ভ্যান। বাকি ৪৯ শতাংশের মধ্যে ১৩ লাখ বাস, মিনিবাস ও মাইক্রোবাস এবং ১২ লাখ কার, জিপ ও বিভিন্ন ছোটগাড়ি থাকবে।

খননকাজের মূল যন্ত্র টিবিএম মেশিন তিনতলা ভবনের সমান আয়তনের, এর ভেতরটা যেমন

কীভাবে চলবে নদীর তলদেশের খননকাজ?

গত বছরের জুলাই মাসের শেষ দিকে চট্টগ্রাম পৌঁছায় টানেল প্রকল্পে নদীর তলদেশে খননের মূল যন্ত্র টানেল বোরিং মেশিন (টিবিএম), যা দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় টানেল বোরিং মেশিন। ইতোমধ্যে চীন থেকে আনা টিবিএম মেশিন পরীক্ষামূলক খনন কাজ সফলভাবে শুরু করেছে। প্রায় তিনতলা বাড়ির সমান উঁচু দৈত্যাকৃতির এ টিবিএম কর্ণফুলীর পতেঙ্গা পয়েন্ট থেকে মাটি কেটে কেটে এগিয়ে যাবে, যা কোনো কোনো পয়েন্টে নদীর তলদেশের মাটি থেকেও ১৪০ ফুট গভীর পর্যন্ত পাতালে ঢুকবে, যার মধ্য দিয়ে তৈরি হবে সুড়ঙ্গ পথ। মেশিনটি নদীর উত্তরপ্রান্ত থেকে পথ কাটা শুরু করে দক্ষিণপ্রান্ত দিয়ে বের হবে।

চট্টগ্রামের পতেঙ্গা পয়েন্টে বসানো হয়েছে টিবিএম মেশিন, যা নদীর তলদেশে টানেলের খননকাজ চালাবে

প্রকল্পের প্রকৌশলীরা জাগো নিউজকে জানান, টিবিএম মেশিনের ঠিক সামনে আছে ধারালো কাটার, যা মাটি কাটতে কাটতে এগিয়ে যাবে। কাটার মেশিন যখন মাটি কাটবে তখন সব মাটি ও পাথর একটি পাইপের মাধ্যমে আলাদা ট্রিটমেন্ট প্লান্টে চলে যাবে। পেছন দিক দিয়ে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কংক্রিটের একেকটি সেগমেন্ট ঢুকে চারিদিকে গোলাকারের শক্ত দেয়াল তৈরি করবে। ফলে মেশিন যত এগোবে, ততই আকার পাবে টানেল।

টানেলের শক্ত দেয়াল হিসেবে কাজ করবে ২০ হাজারের বেশি সেগমেন্ট। চীনের জিয়াংসু প্রদেশের জিংজিয়ান শহরে টানেলের সেগমেন্টগুলো তৈরি হচ্ছে

টানেল নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক হারুনুর রশীদ জাগো নিউজকে বলেন, টানেল বোরিং মেশিন দিয়ে খনন শুরু করার জন্য ‘ওয়ার্কিং শ্যাফট’ এবং প্রয়োজনীয় ‘কাট অ্যান্ড কাভার’ অংশ নির্মাণ কাজ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। এখন চীনের জিয়াংসু প্রদেশের জিংজিয়ান শহরে টানেল সেগমেন্ট কাস্টিং প্ল্যান্টে সেগমেন্ট নির্মাণের কাজ চলছে। গত বছর পর্যন্ত ৪ হাজার ২৫০টি সেগমেন্ট নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে। এর মধ্যে ২ হাজার ৬৮টি সেগমেন্ট চট্টগ্রামে প্রকল্প এলাকায় এসে পৌঁছেছে। পুরো টানেল তৈরিতে এমন ২০ হাজারের বেশি সেগমেন্ট প্রয়োজন হবে।

টানেলের শক্ত দেয়াল হিসেবে কাজ করবে ২০ হাজারের বেশি সেগমেন্ট। চীনের জিয়াংসু প্রদেশের জিংজিয়ান শহরে টানেলের সেগমেন্টগুলো তৈরি হচ্ছে

প্রতি আটটি সেগমেন্টে দুই মিটারের একটি রিং তৈরি হবে। প্রতিদিন এভাবে ৪ থেকে ৫ মিটার করে টানেল তৈরির কাজ এগোবে। প্রথম যাত্রায় পতেঙ্গা থেকে শুরু করে টিবিএম মেশিনটি আনোয়ারা অংশে বের হবে, যা দুই লেনের একটি টিউব সড়ক হবে। সেটি শেষ হলে টিবিএম আনোয়ারা প্রান্ত থেকে নদীর তলদেশে ঢুকে আরেকটি দুই লেনের সড়ক খোদাই করে পতেঙ্গা অংশে বের হবে। এভাবে দুটি টিউবে চার লেনের সড়ক পথ হবে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে,- যোগ করেন হারুনুর রশীদ।

টানেলের পতেঙ্গা পয়েন্টের প্রবেশপথ

স্বপ্ন নির্মাণ যাদের হাতে

টানেল নির্মাণে ইতোমধ্যেই যুক্ত হয়েছেন দেশি-বিদেশি ১২’শ মানুষ, যাদের অক্লান্ত পরিশ্রম আর মেধায় রচিত হচ্ছে বাংলাদেশের নতুন ইতিহাস। এখানে রাতদিন কাজ করছেন অন্তত ৮০০ জন নিয়মিত শ্রমিক। তাদের মধ্যে প্রায় সাড়ে ৩০০ জন চীনা শ্রমিক। এর বাইরে প্রতিদিন ৩০০ শ্রমিক দৈনিক হিসেবে কাজ করেন। প্রকল্পের পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের অধীনে কাজ করছেন কমপক্ষে ৪০ জন সেতু প্রকৌশলী। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন ২৫ জন। প্রতিদিন তিন শিফটে অবিরত কাজ করে যাচ্ছেন তারা।

পাখির চোখে টানেলের পতেঙ্গা ও আনোয়ারা প্রান্ত

আগামী রোববার টিমিএম মেশিন মূল খননকাজ শুরু করলে কয়েকটি টিম এই টিবিএম মেশিন পরিচালনা করবে। এর মধ্যে একটি টিম কাটার মেশিন পরিচালনা করবে, একটি টিম সেগমেন্ট বসানো নিয়ন্ত্রণ করবে। আরেকটি টিম সেগমেন্টগুলো রেলট্রাকে আনা মনিটরিং করবে। অন্য টিম সেগমেন্ট ঠিকমতো লেগেছে কি না বা তার পজিশনিং ঠিক হয়েছে কি না তা দেখবে।

পাখির চোখে টানেলের পতেঙ্গা ও আনোয়ারা প্রান্ত

যেভাবে টানেল’র পথে বাংলাদেশ

২০০৮ সালে চট্টগ্রামের লালদীঘি মাঠে এক জনসভায় আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ক্ষমতায় গেলে কর্ণফুলীতে টানেল নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তিনি ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ সালে প্রস্তাবটি প্রকল্প আকারে উত্থাপন করা হয়। ২০১২ সালের ডিসেম্বরে ১২ কোটি টাকা ব্যয়ে সম্ভাব্যতা যাচাই রিপোর্ট চূড়ান্ত হওয়ার পর স্থান নির্বাচন নিয়ে কেটে যায় আরও দুই বছর। ২০১৪ সালের শেষ দিকে এসে কর্ণফুলীর মোহনায় টানেল নির্মাণে একমত হন নগরবিদ, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ), সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের পরামর্শক ও সেতু বিভাগের কর্মকর্তারা।

পাখির চোখে টানেলের পতেঙ্গা ও আনোয়ারা প্রান্ত

টানেল নির্মাণে ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে চীনা কোম্পানি চায়না কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকশন কোম্পানির (সিসিসিসি) সঙ্গে সমঝোতাস্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ। ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং যৌথভাবে কর্ণফুলী টানেল নির্মাণ প্রকল্পসহ মোট ৬টি প্রকল্পের ভিত্তিফলক উদ্বোধন করেন।

এই বোর্ডের সুইচ টিপে টিবিএম মেশিন চালুর মাধ্যমে বাংলাদেশের নতুন ইতিহাস লিখবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

টানেল নির্মাণে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব পায় সিসিসিসি। প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ৮ হাজার ৪৪৭ কোটি টাকা। এরই মধ্যে চীন অর্থায়ন করছে প্রায় ৪ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। বাকি টাকা বাংলাদেশ সরকার নিজস্ব তহবিল থেকে জোগান দিচ্ছে। ২০২২ সাল নাগাদ টানেল নির্মাণ শেষে হলে কর্নফুলীর তলদেশ দিয়ে শুরু হবে গাড়ি চলাচল। বিশ্ব দেখবে সাংহাইয়ের আদলে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ মডেলের বন্দরনগরী চট্টগ্রাম।

আবু আজাদ/জেডএ/এমকেএইচ