দেশজুড়ে

ভাষা দিবসের ছুটিতে সৈকতে ভাসছে লাখো পর্যটক

ভাষা দিবস ও সপ্তাহিক ছুটি মিলিয়ে পাওয়া তিনদিনের ছুটিকে কাজে লাগিয়ে কক্সবাজার বেড়াতে এসেছেন লাখো ভ্রমণ পিপাসু। শীতের শেষ, বসন্তে দিনের গরম-রাতের হিমশীতলতার ছোঁয়া নিতে আসা পর্যটকে সরগরম হয়েছে সৈকত নগরীর বালিয়াড়ি ও পর্যটন স্পটগুলো।

Advertisement

দেশের বিভিন্ন প্রান্তের পর্যটকের পাশাপাশি ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের ছুটির সঙ্গে সপ্তাহিক ছুটি মিলিয়ে পরিবার পরিজন নিয়ে ঘুরতে আসছেন স্থানীয়রাও।

বুধবার রাত থেকেই শুরু হয়েছে পর্যটকদের আসা। মৌসুমের শেষ সময়ে জমজমাট ব্যবসার হাতছানিতে খুশি পর্যটন সংশ্লিষ্টরা। যে যার অবস্থান থেকে পর্যটকদের সেবা দিতে চেষ্টা করছে পর্যটন ব্যবসায়ীরা।

ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, আগাম বুকিং হয়েছে কক্সবাজারের সাড়ে ৪শ হোটেল-মোটেল, গেস্ট হাউস, কটেজসহ আবাসনস্থল। ৯০ শতাংশ রুম আগেই বুকিং ছিল। অল্প যা খালি আছে তাও বৃহস্পতিবার ওয়াকিং গেস্টরা নিচ্ছেন। রাত অবধি শতভাগ রুম পর্যটকে ভরে যাবে এমনটি আশা হোটেল কর্তৃপক্ষের। মৌসুমের শেষ প্রান্তের টানা এ ছুটিতে বালিয়াড়িতে তিল ধারণের ঠাঁই নেই অবস্থা বিরাজ করছে।

Advertisement

শুধু হোটেল ও বালিয়াড়ি নয় পর্যটন স্পট ইনানী, সেন্টমার্টিন, হিমছড়ি, সোনাদিয়া, মহেশখালীর আদিনাথ মন্দির, ডুলাহাজারা বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক, টেকনাফের মাথিনের কূপ, কদুম গুহা, রামুর রামকোট, ১শ ফুট সিংহশয্যা বৌদ্ধমূর্তি দেখতেও ভিড় জমাচ্ছেন পর্যটকরা। সমান তালে যাচ্ছেন বার্মিজ মার্কেট ও শুটকী মহাল।

বিকেলে সৈকতে গিয়ে দেখা যায়, বালিয়াড়িতে আসা আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা ঢেউয়ের সান্নিধ্য নিতে গোসলে নেমেছে। স্থানীয় পর্যটকরা বিচ চেয়ার কিংবা বালিতে বসে সুখ-দুঃখের অনুভূতি শেয়ার করছেন। আবার কেউ হাটছেন এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত।

পর্যটন সংশ্লিষ্টদের মতে, ২০০০ সালের শুরু থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত সময়ে থার্টিফাস্ট নাইট, ইংরেজি বর্ষকে বিদায়-বরণ ও জানুয়ারির শীতকালিন ছুটির অবকাশ যাপনে কক্সবাজার আসতো লাখ লাখ পর্যটক। কিন্তু রামু ট্রাজেড়ির পর এ নিয়ম পাল্টে যায়। নানা আশঙ্কায় তখন থেকে থার্টিফাস্ট নাইট পালনে ধরাবাধা নিয়ম বেধে দেয় প্রশাসন। মৌসুমের এ সময়টা তাই আগের মতো আর জমে না। কিন্তু ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা ইস্যুর পর হতে সারা বছরই দেশি-বিদেশি সাংবাদিক, এনজিও কর্মকর্তা-কর্মচারি, সরকারি নানা পর্যায়ের কর্মকর্তা মিলে সরবই রয়েছে পর্যটন জোনের সকল ছোট-বড় প্রতিষ্ঠান। অনেক গেস্ট হাউস ও ফ্লাট পুরো মাসের জন্য বুকিং নিয়ে অফিস কার্যক্রম চালাচ্ছে এনজিও প্রতিষ্ঠান। হোটেলগুলো কমবেশি নিত্যদিন ব্যবসা করলেও বেশিরভাগ রুম খালি থাকত। তবে, সপ্তাহিক ছুটিসহ ভিন্ন ছুটি এক হলে পর্যটকে টৈ টম্বুর হয়ে উঠছে কক্সবাজার। তেমনি ভাষা দিবসের ছুটির সঙ্গে সপ্তাহিক ছুুটি মিলিয়ে টানা কয়েকদিন জমজমাট সৈকত নগরী। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে জেলার পর্যটন স্পটগুলো দাঁপিয়ে বেড়াচ্ছেন ভ্রমণপিপাসুরা।

ভ্রমণপিপাসুদের জন্য বাড়তি আনন্দ যোগ করেছে পর্যটন গলফ্ মাঠে চলমান শিল্প ও বাণিজ্য মেলা। রাজপ্রাসাদের গেইটের আদলে গড়া প্রবেশ পথ ও শতাধিক নানা পণ্যের বাণিজ্যিক দোকান পর্যটকদের মনের খোরাক মেটাচ্ছে। পরিবার-পরিজন নিয়ে স্থানীয় ভ্রমণ পিপাসুদের পাশাপাশি দূরের পর্যটকরাও মেলায় ঘুরে এটা, ওটা কিনছেন বলে জানান মেলার প্রধান সমন্বয়ক সাহেদ আলী শাহেদ। নিরাপত্তা নিশ্চিত ও যেকোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে মেলার ভেতর বাইরে পর্যাপ্ত সংখ্যক সিসি ক্যামেরা বসানো হয়েছে। কাজ করছে পুলিশসহ নিজস্ব নিরাপত্তাকর্মীরা। এদিকে, পর্যটকবাহী অতিরিক্ত যানবাহনের চাপে পড়েছে মহাসড়ক। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের পটিয়া, চন্দনাইশ, দোহাজারি, কেরানিহাট, পদুয়া, লোহাগাড়া, চকরিয়া, ঈদগাঁও, লিংকরোড় ও বাস টার্মিনাল এলাকায় পড়া জ্যামে কাহিল হচ্ছেন পর্যটকসহ সাধারণ যাত্রীরা।

Advertisement

জেলা ট্রাফিক বিভাগের সহকারী পুলিশ সুপার বাবুল চন্দ্র বণিক বলেন, যানজট এড়াতে শহরের অভ্যন্তরে সকাল ৮ থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত পর্যটকসহ সব ধরনের পরিবহন প্রবেশ রদ করা হয়েছে। ফলে বাস টার্মিনাল-কলাতলী থেকে হলিডে মোড় পর্যন্ত আগের যানজটের ভোগান্তি থেকে অনেকটা মুক্তি মিলেছে। ফলে পর্যটকে ভরপুর হলেও চলাচলে ভোগান্তি নেই।

কক্সবাজার গেস্ট হাউস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম সিকদার বলেন, টানা ছুটি থাকলে ভ্রমণ পিপাসুরা আগাম হোটেল কক্ষ বুকিং করেন। এবারও তেমনটি হয়েছে। প্রায় ৮০-৮৫ শতাংশ রুম বুকিং হয়েছে আগে আর বাকিটা বৃহস্পতিবার হওয়া শুরু হয়েছে। আগামী ২৪ ফেব্রুয়ারি সকাল পর্যন্ত কক্সবাজারের সর্বত্র জমজমাট থাকবে এমনটি আশা আমাদের।

এদিকে, পর্যটকদের আনন্দকে পূঁজি করে কিছু কিছু হোটেল-মোটেল-রোস্তোরায় গলাকাটা দাম নেয়ার অভিযোগ প্রায় উঠে। এবারও তেমনটি হবে ভেবে আগাম সতর্কাবস্থায় রয়েছে জেলা প্রশাসনের পর্যটন সেল। কোনো হোটেল কক্ষের ভাড়া অতিরিক্ত নেয়া, রেস্তোরাঁগুলো মাত্রাতিরিক্ত টাকা আদায় করছে বলে মনে হলে প্রতিটা হোটেল লবিতে টানানো পর্যটন সেলের নম্বরে যোগাযোগ করতে অনুরোধ করেছেন সেলের দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সাইফুল ইসলাম জয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে হোটেল সংশ্লিষ্টরা জানান, দালালদের সঙ্গে ৫০ শতাংশ ভাগাভাগির চুক্তি থাকায় বাধ্য হয়ে পর্যটকদের কাছ থেকে বেশি দাম নিতে হয় হোটেল সংশ্লিষ্টদের। এতে পর্যটকরা বিড়ম্বনার শিকার হন বলে উল্লেখ করেন তারা।

সী-নাইট গেস্ট হাউসের ব্যবস্থাপক শফিক ফরাজী জানান, এ বছরের পর্যটন মৌসুম সবার ভালো কেটেছে। বৃহস্পতিবার থেকে টানা বুকিং রয়েছে আমাদের। কোয়ালিটি মেনটেইন করে সব সময় একই দাম রাখার চেষ্টা করি আমরা। কেউ কেউ হয়তো প্রয়োজনকে পূজি করে নীতি বির্সজন দিয়ে বদনাম কুড়ায়।

কক্সবাজার হোটেল-মোটেল ওনার্স এসোসিয়েশন সভাপতি শাখাওয়াত হোসেন বলেন, তারকা হোটেলগুলোর রুম ভাড়া পুরো বছরই এক। তার উপর মৌসুম ভেদে ডিসকাউন্ট থাকে। কিন্তু নন স্টার হোটেলগুলো চাহিদাকে কাজে লাগিয়ে কম-বেশি দাম আদায় করে বলে অভিযোগ শুনি। পর্যটনের স্বার্থে এটা বন্ধ হওয়া দরকার।

ট্যুর অপারেটর এসোসিয়েশন (ট্যুয়াক) সদস্য দিগন্ত ট্যুরিজমের পরিচালক ইয়ার মোহাম্মদ বলেন, টেকনাফ-সেন্টমার্টিন নৌ-রুটে পর্যটকবাহী ৬টি জাহাজ চলাচল করছে। প্রতিদিন এসব জাহাজে ৮ থেকে ১০ হাজার পর্যটক প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিনের রূপ উপভোগ করতে যান। শনিবার পর্যন্ত সকল জাহাজের টিকেট আগাম বিক্রি হয়ে আছে।

তিনি আরও জানান, পর্যটকবাহী বাস এত বেশি এসেছে বাসটার্মিনাল হতে পায়ে হেঁটেই কলাতলী ও সৈকতে যেতে হচ্ছে পর্যটকদের। যারা সেন্টমার্টিন যাবার সুযোগ পাচ্ছেন না তারা ইনানীসহ জেলার অন্য পর্যটন স্পটগুলোতে ঢু মারছেন। কক্সবাজার ট্যুরিস্ট পুলিশের পুলিশ সুপার জিল্লুর রহমান বলেন, নিরাপত্তা সেবার প্রতিষ্ঠান হিসেবে পর্যটকদের নির্বিঘ্ন চলাচল নিশ্চিতে লাবণী, সুগন্ধা পয়েন্ট, মেইন বিচসহ গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে কয়েকটি টিম সার্বক্ষণিক কাজ করবে। মোটরসাইকেল নিয়ে সকাল ৮ থেকে রাত ৯ পর্যন্ত মোবাইল ডিউটিতে রাখা হয়েছে অপর টিম। এছাড়াও জেলা পুলিশের বিশেষ শাখা, গোয়েন্দা বিভাগের সদস্যরা একাধিক টিমে বিভক্ত হয়ে মাঠে রয়েছে।

ঢাকার বনশ্রী থেকে পরিবার নিয়ে বেড়াতে আসা ইয়াছিন হোসেন জানান, কাজের চাপে পরিবারকে সময় দেয়া হয়ে উঠে না। ভাষা দিবসের সঙ্গে সাপ্তাহিক মিলিয়ে টানা তিনদিন ছুটি পেয়ে পরিবারের সবাইকে নিয়ে সৈকতে এসেছি। আগের কক্সবাজারের সঙ্গে বর্তমানের কক্সবাজারের তফাৎ অনেক। এখন অবকাঠামোর অনেক পরিবর্তন হয়েছে। গরম শুরু হওয়ায় পর্যটক কম আসবে বলে ধারণা করেছিলাম। কিন্তু বালিয়াড়িতে ধারণার চেয়েও অধিক পর্যটক এসেছে। কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন বলেন, পর্যটন শহর হিসেবে সহজলভ্য সেবা নিশ্চিতে প্রশাসনের সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকে। সেই বিষয়ে বলা থাকে আবাসন সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোকেও। যারা নীতিভ্রষ্ট তারাই অভিযোগ সৃষ্টির কাজগুলো করে। পর্যটন এলাকায় ঘুরছে আমাদের ভ্রাম্যমাণ আদালতের কয়েকটি টিম। পর্যটকরা হয়রানির যেকোনো অভিযোগ তাদের কাছে পৌঁছালে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হয়।

এমএএস/পিআর