পৃথিবীর এমন কিছু স্থান আছে, ভয়ানক সুন্দর। মন চায় বারবার সেখানে ছুটে যেতে। সেখানে দেখা মেলে সুন্দর মনের সব মানুষের। আবার কিছু কিছু স্থান আছে, যেখানে চোখ মেললেই ধরা পড়বে হায়েনার লোলুপ দৃষ্টি, যেন আপনাকে ছিড়ে খেতে চাইবে।
Advertisement
তেমনি একটি স্থান পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশের শাহরাগ শহর। বেলুচিস্তানের হারনাই জেলার একটি পাহাড়ি উপত্যকায় শহরটির অবস্থান।
শাহরাগ শহরে ৩০০ থেকে ৪০০টি কয়লাখনি আছে। যেখানে কাজ করেন ৩০ হাজারের বেশি শ্রমিক। খনিগুলোতে যারা শ্রমিক হিসেবে ‘কাজ’ করেন তাদের অনেকেই শিশু বা কিশোর। কিন্তু সংখ্যায় তারা ঠিক কত, প্রাতিষ্ঠানিক কোনো হিসাব মিলবে না।
শহরটিতে প্রধানত পশতুন জাতির বাস। কিন্তু পাহাড়ি ওই এলাকায় মারি বেলুচরা বিচ্ছিন্নভাবে বসবাস করেন। শাহরাগের পাহাড়ি ভূমির অধিকাংশের মালিক পশতুনরা। এছাড়া শহরে তাদের সংখ্যাই বেশি। শহরের দক্ষিণ অংশের পাহাড়গুলো কয়লায় পূর্ণ। শোনা যায়, সেখানে মারি প্রজাতির লোকজনেরও বসবাস।
Advertisement
শাহরাগের স্থানীয় ও ক্ষমতাবান এক পশতুনের কথায়, ‘এখানে বেকার থাকার কোনো সুযোগ নেই। কেউ যদি আমাকে ২০০ লোকও এনে দেয় আমি সঙ্গে সঙ্গে কাজের ব্যবস্থা করে দিতে পারব। সেটি হবে কয়লাখনিগুলোতে।’
এ কারণে কাজের সন্ধানে এখানে ছুটে আসেন খাইবার পাখতুনখাওয়া ও পাঞ্জাব প্রদেশের অসংখ্য মানুষ। পাশের দেশ আফগানিস্তান থেকেও অনেকে আসেন এখানে। এ অঞ্চলে খনি শ্রমিকের ৮০ ভাগই পাখতুনখাওয়া ও পাঞ্জাব প্রদেশের। বাকি ২০ ভাগ স্থানীয় ও বেলুচরার অধিবাসী। যাদের মারি বলেও ডাকা হয়।
শাহরাগ শহরের সমাজব্যবস্থা ঐতিহ্যগতভাবে পিতৃতান্ত্রিক। এছাড়া এখানে ধর্ম পালনেও রয়েছে প্রচণ্ড কড়াকড়ি। এখানকার নারীদের ঘর থেকে বের হওয়া একটা দুর্লভ ঘটনা। পুরুষরা সারাদিন বসে বসে কর্তৃত্ব খাটান।
বেলুচিস্তান প্রদেশের বাকি অংশের সঙ্গে একেবারেই বিচ্ছিন্ন শাহরাগ শহর। এখানকার কেউ-ই জানেন না গোটা দেশে কী হচ্ছে? দেশের বাকি অংশেরও শাহরাগ নিয়ে কোনো আগ্রহ নেই, নেই মাথাব্যথাও।
Advertisement
কোনো আগ্রহ না থাকায় শাহরাগে প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে খুবই কুৎসিত, মারাত্মক কিন্তু গোপন একটি ঘটনা। সেটি হলো এখানকার কোনো ছেলে কিংবা কিশোর পুরুষের লালসা থেকে নিরাপদ নয়।
চলতি বছরের শুরুতে ১৩ বছরের কলিম দায়ার কয়লাখনিতে আসে কাজের সন্ধানে। বেশিকিছু আশা ছিল না তার। পরিবারের জন্য সামান্য অর্থ উপার্জন বা দুবেলা পেটপুরে খাওয়া। কিন্তু সে জানতো না, তার আসার অপেক্ষায় ছিল ওই কলোনির সব শ্রমিক।
পাহাড়ে ঘেরা আল-জিলানিতে আছে আটটি কয়লাখনি। কলিমের আসার খবরে খনি শ্রমিকদের মধ্যে যেন টানটান উত্তেজনা তৈরি হয়। চারদিকে দাবানলের মতো সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে যে, দায়ার কয়লা খনিতে নতুন একটি ছেলে এসেছে। গোটা শহরের মূল আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে কলিম। আশপাশের কয়লাখনি থেকে অনেকেই তাকে দেখতে আসে।
কিশোর কলিম সদ্য বিবাহিত কোনো বধূ নয় কিন্তু তারপরও তাকে দেখে পুরুষদের চোখগুলো যেন চিকচিক করে ওঠে।
শাহরাগ থেকে বেশ দূরে একটি পাহাড়ের চূড়ায় কাদা ও পাথরে তৈরি একটি নির্জন ঘরে আরও জনাবিশেক কিশোরের সঙ্গে কলিমকেও রাখা হয়। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, কলিম একটা কালো সালোয়ার-কামিজ আর হলুদ শার্ট পরে বসে আছে। অনেক প্রশ্নের পর তার কাছ থেকে জবাব আসে, ‘আমার বাবা নেই। পরিবারকে সাহায্য করতে কাজের খোঁজে এখানে আসা।’
কিন্তু ১৩ বছরের এক কিশোরকে সালোয়ার-কামিজ পরিয়ে কেন নির্জন জায়গায় রাখা হয়েছে তা বুঝতে এতটুকু অসুবিধা হয় না। কলিমকে যখন পুনরায় প্রশ্ন করা হয়, কী কাজ? তখন সে মৃদু হাসিতে উত্তর দেয়, ‘আমি এখানে রান্নার কাজ করি। এখানে যারা কাজ করে তাদের বাবা-মা নেই, স্ত্রী-সন্তান নেই; অথবা তারা পঙ্গু নয়তো বয়স্ক।’
কলিমের কাছ থেকে জানা যায়, তাকে প্রতি মাসে ১০ হাজার রুপি দেয়া হয়। সেখানকার গোপন কিন্তু কুৎসিত সত্যটা ভয়ে সে আড়াল করে যায়। কারণ, যখন এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কলিমের কথা হয় তখন তার মনিব নিচে যান প্রয়োজনীয় কাজে। প্রথমে তো কলিম কিছুই বলতে রাজি হচ্ছিল না। যখন তাকে শারীরিক সম্পর্কের বিষয়ে প্রশ্ন করা হয় তখন সে কোনো কথা না বলে ঘর থেকে বের হয়ে যায়।
কলিমের মতো হাজার হাজার কিশোর আছে শাহরাগে। তাদের বেশির ভাগই আসে খাইবার পাখতুনখাওয়া কিংবা আফগানিস্তান থেকে। তাদেরকে এখানে আনা হয় মূলত বয়স্ক খনি শ্রমিকদের যৌনসঙ্গী বানানোর জন্য। তারা কিছু বলতে পারে না আবার সইতেও পারে না।
দিনের পর দিন নির্মম নির্যাতনের পর একসময় অপ্রয়োজনীয় হয়ে গেলে তাদেরকে ছুড়ে ফেলে দেয়া হয়।
এসএ/এমএআর/বিএ