জুজুৎসু- শব্দটি দেখে অনেকই ভ্রু কুঁচকাবেন। এটা আবার কী? এটা দেশের একটি ক্রীড়া অ্যাসোসিয়েশন। পুরো নাম ‘বাংলাদেশ জুজুৎসু অ্যাসোসিয়েশন’। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের সর্বকণিষ্ঠ সন্তান। গত বছর ১৮ অক্টোবর সর্বশেষ এই অ্যাসোসিয়েশনটিকে অনুমোদন দিয়েছে দেশের খেলাধুলার অভিভাবক সংস্থাটি।
Advertisement
এটি ক্রীড়া ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশনের তালিকায় ৫৩ নম্বরে। চার মাস আগে এই অ্যাসোসিয়েশন জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের অনুমোদন পেলেও এখনো কমিটি গঠন হয়নি। এমন কী কমিটি গঠনের কোনো প্রস্তাবও পায়নি জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ। দেশের ক্রীড়া ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশনগুলো কীভাবে চলছে তার একটা উদাহরণ এই নতুন সংস্থাটি।
দেশ পরিচালনা করছে গণতান্ত্রিক সরকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সমাজের সর্বক্ষেত্রে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় জোর দিয়েছেন। কিন্তু ক্রীড়াঙ্গন থেকে আস্তে আস্তে উধাও হচ্ছে গণতন্ত্র। ৫৩ টি ক্রীড়া ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশনের মধ্যে ৩০টিতেই নেই নির্বাচিত কমিটি।
যে ২৩ টিতে এখন আছে নির্বাচিত কমিটি তার মধ্যে ৫টির মেয়াদ শেষ। ৫৭ ভাগের বেশি অনির্বাচিত ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশন নিয়ে চলছে দেশের খেলাধুলা। যা সরকারের মনোভাবের সঙ্গে মোটেও যায় না।
Advertisement
নতুন যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী মো. জাহিদ আহসান রাসেল এমপি ক্রীড়াঙ্গনে পুরনো ও অভিজ্ঞজন। সরকারের গত দুই মেয়াদে তিনি ছিলেন যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়বিষয়ক সংসদীয় কমিটির সভাপতি। ক্রীড়াঙ্গনকে গতিশীল করতে একজন অভিজ্ঞ ব্যক্তিকেই এই মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী করেছেন শেখ হাসিনা।
মো. জাহিদ আহসান রাসেল যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেয়ার পর প্রথম যেদিন সভায় বসেছিলেন সব ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে সেদিন তার একটা খারাপ লাগার কথা বলেছিলেন।
তা হলো ক্রীড়াঙ্গনের অগণতান্ত্রিক ধারা দেখে। তিনি বলেছিলেন ‘এত অ্যাডহক কমিটি দিয়ে ক্রীড়াঙ্গন চলছে, যা দেখে আমার খারাপ লেগেছে। অনির্বাচিত কমিটি দিয়ে ভালো ফলাফল করা দূরহ কাজ। যে সব ফেডারেশনে অ্যাডহক কমিটি আছে সেগুলোকে দ্রুত নির্বাচনের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ কমিটি করতে হবে।’
ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশনগুলোর শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী মতবিনিময় সভায় বসেছিলেন ৮ জানুয়ারি। ইতোমধ্যে পেরিয়ে গেছে এক মাসের অধিক। এ সময়ের মধ্যে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ শেষ করেছে বাংলাদেশ টেবিল টেনিস ফেডারেশনের নিবার্চন।
Advertisement
নির্বাচনের উদ্যোগ নিয়েছে হকি ও শরীরগঠন ফেডারেশনও। হকির নির্বাচন নিয়ে ইতোমধ্যেই তোড়জোড় শুরু হয়েছে। মঙ্গলবার ফেডারেশন তাদের গঠনতন্ত্র ও হালনাগাদ কাউন্সিলর তালিকা জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে জমা দিয়েছে। আর শরীরগঠন ফেডারেশনের নির্বাচনের জন্য কমিশন গঠন করেছে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ।
নির্বাচিত কমিটি দিয়ে চলছে ফুটবল, ক্রিকেট, সাঁতার, ব্যাডমিন্টন, বাস্কেটবল (মেয়াদোত্তীর্ণ), জিমন্যাস্টিকস, শ্যুটিং, ভলিবল, টেবিল টেনিস, শরীরগঠন (মেয়াদোত্তীর্ণ), বক্সিং, দাবা, জুডো, রোইং, কুস্তি (মেয়াদোত্তীর্ণ), হ্যান্ডবল, রোলার স্কেটিং, কারাতে, তায়কোয়ানদো (মেয়াদ উত্তীর্ণ), খো খো (মেয়াদ উত্তীর্ণ), আরচারি, বাশআপ ও ন্যাশনাল প্যারালিম্পিক।
অ্যাথলেটিকস, হকি ও কাবাডির মতো গুরুত্বপূর্ণ ফেডারেশনসহ অনির্বাচিত কমিটি দিয়ে চলছে সাইক্লিং, টেনিস, ভারোত্তোলন, বধির, স্কোয়াশ, বিলিয়ার্ড অ্যান্ড স্নুকার, মহিলা ক্রীড়া সংস্থা, ব্রীজ, গলফ, ক্যারম, মার্শাল আর্ট, ঘুড়ি, রাগবি, ফেন্সিং, উশু, বেসবল-সফটবল, কিক বক্সিং, আন্তর্জাতিক তায়কোয়ানদো, ব্যুত্থান, ইয়োগা, সার্ফিং, মাউন্টেনিয়ারিং, কান্ট্রি গেমস, সেপাক টাকরো, চুকবল, থ্রোবল ও জুজুৎসু।
স্কোয়াশ, বিলিয়ার্ড অ্যান্ড স্নুকার ও গলফসহ কিছু ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশন আছে তাদের নির্বাচন করার মতো সাধারণ পরিষদও নেই। তাই এসব ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাচন কবে হবে কিংবা আদৌ হবে কি-না তা কেউ বলতে পারছে না।
মজার বিষয় হলো ৫৩ টি ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশনের মধ্যে ৯টি জন্মলগ্ন থেকেই চলছে প্রতিষ্ঠাকালীন কমিটি দিয়ে। বছরের পর বছর পার হলেও এ অ্যাসোসিয়েশনগুলো জাতীয় ক্রীড়া পরিষদকে কমিটি গঠনের প্রস্তাব দেয়নি। অনুমোদন নিয়েই খালাস তারা। এখন শুধু সরকারের অনুদানই নিয়ে যাচ্ছে; কিন্তু সরকারের নিয়ম মানছে না।
ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশন গঠনের উদ্যোক্তারা প্রথমে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে একটি কমিটিসহ নিবন্ধনের জন্য আবেদন জমা দেয় জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে। দেশের খেলাধুলার অভিভাবক সংস্থাটি অনুমোদন দেয়ার সময়ই বলে দেয় দ্রুত সময়ের মধ্যে কমিটি গঠনের প্রস্তাব দিতে। কিন্তু সেই দ্রুততম সময় আর আসে না। বেশিরভাগ ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশন অনুমোদন নেয় প্রভাব খাটিয়ে। নিবন্ধনের কাগজ পাওয়ার পর তারা থোরাই কেয়ার করে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদকে।
প্রতিষ্ঠাকালীন কমিটি দিয়ে চলছে যেসব ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশন
বাংলাদেশ মার্শাল আর্ট কনফেডারেশন জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের অনুমোদন পেয়েছে ১৯৯৭ সালের ১০ মার্চ। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ থেকে মঙ্গলবার পাওয়া তথ্য অনুযায়ী এ ফেডারেশনটি দীর্ঘ ২২ বছর ধরে চলছে প্রতিষ্ঠাকালীন কমিটি দিয়ে। কমিটি গঠনের জন্য জাতীয় ক্রীড়া পরিষদকে কখনো প্রস্তাবও দেয়নি এ ফেডারেশন।
বাংলাদেশ ঘুড়ি অ্যাসোসিয়েশনের জন্ম ২০০৬ সালের ২৩ অক্টোবর। ১৩ বছরেও এ অ্যাসোসিয়েশন থেকে কমিটি গঠন করে দেয়ার জন্য কোনো প্রস্তাব পায়নি জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ। ২০০৯ সালের ৩০ জুন জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের অনুমোদন পেয়েছে বেসবল-সফটবল অ্যাসোসিয়েশন। ১০ বছর ধরে এ অ্যাসোসিয়েশনও চলছে প্রতিষ্ঠাকালীন কমিটি দিয়ে।
২০১০ সালের ২৩ ডিসেম্বর অনুমোদন পাওয়ার পর থেকে নিজেদের করা কমিটি দিয়ে চলছে বাংলাদেশ কিক বক্সিং অ্যাসোসিয়েশন। ২০১২ সালের ৬ সেপ্টেম্বর থেকে একইভাবে চলছে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক তায়কোয়ানদো অ্যাসোসিয়েশন। তবে এ সংস্থাটি ইতিমধ্যে কমিটি গঠনের প্রস্তাব দিয়েছে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদকে।
বাংলাদেশ ব্যুত্থান অ্যাসোসিয়েশনের জন্ম ২০১৩ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি। চলছে সেই প্রতিষ্ঠাকালীন কমিটি দিয়েই। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদকে এ অ্যাসোসিয়েশনটিও কমিটি গঠনের প্রস্তাব দেয়নি। গত বছর ১৮ অক্টোবর যে চারটি অ্যাসোসিয়েশনকে অনুমোদন দিয়েছে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ সেই থ্রোবল, সেপাক টাকরো ও জুজুৎসু চলছে নিজেদের জমা দেয়া কমিটি দিয়েই। এর মধ্যে বাংলাদেশ থ্রোবল অ্যাসোসিয়েশন কমিটি গঠন করে দিতে প্রস্তাব দিয়েছে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদকে।
ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশনগুলোর নির্বাচন বিষয়ে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের সচিব মো. মাসুদ করিম বলেছেন, ‘মন্ত্রী মহোদয়ের নির্দেশক্রমে আমরা নির্বাচনী প্রক্রিয়া শুরু করেছি। ইতোমধ্যে টেবিল টেনিস ফেডারেশনের নির্বাচন শেষ হয়েছে। হকির নির্বাচনের তোড়জোড় চলছে। গঠন করা হয়েছে শরীর গঠন ফেডারেশনের নির্বাচনের জন্য কমিশন। আমরা পর্যায়ক্রমে নির্বাচন প্রক্রিয়া শেষ করবো।’
আরআই/এসএএস/পিআর