প্রবাস

পথেই কঙ্কাল তবুও চেষ্টা সাগর পাড়ির

বাংলাদেশ থেকে লিবিয়া পৌঁছানো পর্যন্ত নানা বিপদ কাটিয়ে ইউরোপের স্বপ্নে বিভোর মানুষগুলো এক সময় যে নিশ্চিত মৃত্যুকূপের দিকে স্বেচ্ছায় এগিয়ে যায়, সেই মৃত্যুকূপের নামই লিবিয়ার ভূমধ্যসাগর। এই সাগর দিয়ে কয়েক দশক ধরেই অভিবাসীরা বিপজ্জনকভাবে ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে আসছে।

Advertisement

সম্প্রতি লিবিয়া-সিরিয়া সঙ্কটের কারণে এভাবে সাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপীয় দেশগুলোতে যাওয়ার ঘটনা কয়েক গুণ বেড়েছে। নৌকা ডুবে মৃত্যুর ঘটনাও বেড়েছে বিগত বছরগুলোর চেয়ে কয়েক গুণ বেশি। পারাপারের জন্য মৌসুমের তোয়াক্কা না করে সব সময়ই নৌকায় মানব পাচার ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ায় দিনে দিনে মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে।

অধরাকে ধরার জন্য, অদেখাকে দেখার জন্য, উন্নত জীবনের প্রলোভনে পড়ে অনেক বাংলাদেশি যৌবনের সেই শক্তিতে ভর করে বাস্তবতাকে জলাঞ্জলি দিয়ে দালাল ধরে উন্নত দেশে পাড়ি জমানোর জন্য যাত্রা দেয় বিপদ সংকুল সব ভয়ানক পথ। সাগর-মহাসাগর, গভীর জংগল ভয়ঙ্কর এই সব যাত্রায় তারা সর্বশান্ত হয়ে পথিমধ্যেই কংকাল হয়, না হয় অনেকটা জীবন্ত লাশের মতো হয়েই কাঙ্খিত দেশে পৌঁছে তবে বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হয়।

দালালদের থেকে অর্থলুট, পথিমধ্যে নির্যাতন, সাগরে ডুবে মৃত্যু, ভয়ংকর জীবজন্তুর আক্রমণে মৃত্যু, অনাহার-অর্ধাহারে মৃত্যুসহ অসংখ্য প্রতিকূল অবস্থা বিরাজমান এই যাত্রায়। তারপরো চলছে এই যাত্রা থেমে নেই।

Advertisement

করিম (প্রতিকী নাম) টগবগে যুবক, সবে সাদি করেছে। এখনো হাতের মেহেদীর রং শুকায়নি। কাজ করে যুদ্ধ বিদ্ধস্ত লিবিয়ায়। নতুন বিবাহ করা করিমের দিনগুলো ভালো যাবে এটাই স্বাভাবিক, কিন্তু উন্নত জীবনের স্বপ্নে বিভোর করিম, সে ভাবে একবার যদি আমেরিকায় পৌঁছাতে পারি, ভরি ভরি স্বর্ণের গহনায় প্রিয়তমাকে লাগবে মহারানীর মতই। স্বপ্নের দেশ আমেরিকা, কতজন আর যেতে পারে, এবার যাবই হোকনা অবৈধ পথে।

রহিম (প্রতিকী নাম) করিমের বন্ধু থাকে জর্ডান মোটামুটি যাচ্ছিল অন্যসব প্রবাসীর মতই। দেশে রহিমের পরিবার বেশ ভালই আছে। কিন্তু রহিম স্বপ্নবাজ একজন তরুণ। সে কখনোই অল্পে তুষ্ট নয়। দিনার। দেরহাম এগুলো এখন তার কাছে অল্প মনে হয়। তার ভাবনাজুড়েই ইউরো আর পাউন্ড, ইউরোপের রঙ্গময় আর বেসামাল জীবন। স্বপ্নে সে ভাবতে থাকে, ইশ যদি একবার পাড়ি দিতে পারতাম স্বপ্নের সে রাজ্যে কতইনা জমতো জীবনটা।

এভাবে করিমের মতো স্বপ্নবাজরা ড্যারিয়েন গ্যাপ পাড়ি দিয়ে স্বপ্নের দেশ আমেরিকা যেতে যাত্রা করে। একইভাবেই মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে বা দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ৭-৮ লাখ টাকা খরচ করে। প্রথম আলোর একটি রিপোর্ট বলছে, ৮-১০ লাখ দিয়ে দালালদের মাধ্যমে তারা যাত্রা করে ইউরোপের উদ্দেশ্যে। আইওএম'র তথ্য অনুসারে এরা দালালদের ৭০০ ডলার দেন লিবিয়া থেকে সাগর পাড়ি দিতে শুধু। লিবিয়া পর্যন্ত যেতে লাগে ১০০০০ মার্কিন ডলার।

ইত্তেফাকের একটি রিপোর্ট অনুসারে দালালদের খপ্পরে পড়ে চটগ্রাম সিলেটসহ বিভিন্ন জেলা থেকে শাহ আমানত বিমানবন্দর হয়ে লিবিয়া তারপর সাগরপথে বিপদ সঙ্কুল পথ পাড়ি ইউরোপ গেছে এ রকম সংখ্যা অনেক। যাওয়ার পথে তারা লিবিয়া- তুরস্ক হয়ে ইতালি, ফ্রান্স, স্পেন পর্তুগাল ইত্যাদি দেশে পাড়ি জমিয়েছে।

Advertisement

চ্যানেল ২৪ এর ২৫ জুন ২০১৮ এর রিপোর্ট বলছে, সাগরপথে ইউরোপের যাত্রায় মৃত্যুবরণ করেছে ৩৫ জন। রিপোর্ট প্রকাশের কিছুদিন আগে। বাংলাদেশ প্রতিদিন ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী গতবছর ইতালি ঢোকার পথে নৌকাডুবিসহ অন্যান্য কারণে মৃত্যুবরণ করেছে প্রায় ১০০০ মানুষ। কতটা বিপদ সংকুল পথ এতেই বোঝা যায়।

প্রথম আলোতে প্রকাশিত প্রতিবেদনের পরিসংখ্যান বলছে, ২০০৮ -২০১৭ পর্যন্ত ১ লাখের বেশি মানুষ অবৈধভাবে প্রবেশ করেছে ইউরোপে। ইউএনএইচ সি আর এর মতে, ভূমধ্যসাগর ব্যবহার করে ইউরোপে প্রবেশের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ চতুর্থ। দালালদের মাধ্যমে যাওয়া এসব অভিবাসীর মধ্যে ২৮০ নাগরিক লিবিয়ার কারাগারে বন্দি জীবন কাটাচ্ছেন। ডারিয়েন গ্যাপ পাড়ি দেওয়ার গল্প আরো ভয়ংকর।

যুগান্তরের ২০১৬ সালের একটি রিপোর্ট বলছে, অনেক বাংলাদেশি যাদের মধ্যে বেশিরভাগ তরুণ বিভিন্ন পথ পাড়ি দিয়ে সড়ক পথে আমেরিকা প্রবেশের জন্য ব্রাজিল, বলিভিয়া, ইকুয়েডর কলম্বিয়া হয়ে পানামায় পৌঁছেছেন। পানামার একটি এনজিও'র হিসাবে গত দুই বছরে (রিপোর্টি প্রকাশের পূর্বে) ডেরিয়েন গ্যাপ পাড়ি দেয়ার মধ্যে বাংলাদেশিরা তৃতীয়। প্রতিবছর এ পথ পাড়ি দিতে গিয়ে অন্তত ১০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। প্রতি বছর রোডটি বেছে নেয় অন্তত ২৫০০০ মানুষ।

২ মে ২০১৫ সালে প্রকাশিত আল জাজিরার প্রতিবেদনেও সোমালিয়ান, নেপালির সঙ্গে ১৩ বাংলাদেশি সীমান্ত পুলিশের কাছে গ্রেফতার হওয়ার রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। পানামার অভিবাসন সংস্থার মত অনুযায়ী, ২০১৩ সালে ড্যারিয়েনে ৩০৭৮ অবৈধ আগমন ঘটে। পরের বছর এই দ্বিগুণ দ্বিগুণ ৭২৭৮ জন। এই চিত্রগুলোই বলে দিচ্ছে উন্নত জীবনের আশায় বিপদসংকুল পাড়ি দেয়া অভিবাসীদের বেশির ভাগের ভাগ্যেই জুটেছে চরম তিক্ততার অভিজ্ঞতা।

এসব আমেরিকাগামীদের পথে পথে মৃত্যু তাদের তাড়া করেছে প্রতিনিয়ত। ড্যারিয়েন গ্যাপে অনেকেই মৃত্যুর আগে লিখেছেন ঠিকানা, নিজ নিজ ভাষায় লিখে গিয়েছেন। নাম ঠিকানার পাশাপাশি তারা এই বিপদসংকুল পথের নানা খারাপ দিকও বর্ণনা করেছেন। প্রবাসী কিংবা দেশ থেকে উন্নত দেশ ইউরোপ আমেরিকা যাওয়ার স্বপ্ন যাদের আছে, তাদের উচিৎ বৈধ পথে যাওয়া। অবৈধ পথ পরিহার করা এবং অতিমাত্রায় দুঃসাহসী হয়ে দালাদের খপ্পরে না পড়া

অতিথি লেখক, মুহাম্মদ আবদুস শাকুর শারজাহ, আরব আমিরাত

এমআরএম/পিআর