মতামত

ফুটবলে প্রাণের ঢেউ

সম্প্রতি সাফ অনূর্ধ্ব-১৬ ফুটবলে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বাংলাদেশ। বলা বাহুল্য এ আসরে বাংলাদেশের ক্ষুদে ফুটবলারদেরও এটাই প্রথম ফাইনাল খেলার অভিজ্ঞতা।এফসি ক্লাব কাপে বাছাইয়ে প্রাথমিক পর্ব পেরিয়েছে শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাব। সাফ অনূর্ধ্ব-১৯ ফুটবল প্রতিযোগিতায় সেমিফাইনালে পৌঁছেছে বাংলাদেশ। সাফ অনূর্ধ্ব-১৬ আসরের ফাইনালে ২০ হাজার ধারণক্ষমতা সম্পন্ন সিলেট স্টেডিয়ামপূর্ণ হয়ে ওঠে খেলা শুরুর অনেক আগেই। খেলা শুরুর আগে স্টেডিয়ামের বাইরে টিকেটের আশায় তখনও অপেক্ষমান হাজার হাজার ফুটবল ভক্ত। দুর্ঘটনা এড়াতে স্টেডিয়াম কর্তৃপক্ষ মাইকিং  করে দর্শকদের অনুরোধ করলেন, সবাই যেন বাড়ি গিয়ে টিভিতে খেলা উপভোগ করেন। ফাইনাল খেলাকে নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করার এ অনুরোধে সাড়া দিলেন দর্শকরাও।ভাল ফুটবল আর দর্শক সমার্থক। মাঠে মান সম্পন্ন ফুটবল থাকলে দর্শকের অভাব যে কখনোই হয় না সেটাই দেখা গেল সাফ অনূর্ধ্ব- ১৬ প্রতিযোগিতায়। সাম্প্রতিক সময়ে ফুটবলে যে প্রাণের ছোঁয়া এর পেছনে গত কয়েক বছরের ধারাবাহিক চেষ্টার ফল। ১৯৯০ এর মাঝামাঝি থেকে গতি হারাতে থাকে বাংলাদেশ ফুটবল। এসময়ে ক্রিকেট যতই এগিয়েছে ঠিক ততটাই পিছিয়েছে ফুটবল। নতুন শতাব্দীতে এসে বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয় বাংলাদেশ ফুটবলের।  চলতি দশকের আগের দশকে বাংলাদেশ ফুটবল সীমিত হয়ে পড়ে ঐতিহ্যের ধারক-বাহক মোহামেডান-আবাহনী ম্যাচের উত্তাপকে ঘিরে। আবাহনী-মোহামেডান বৃত্তবন্দী দশা থেকে বেরিয়ে এসেছে হালের ফুটবল। ঘরোয়া ফুটবলে আবাহনী-মোহামেডানের চেয়েও শক্তিশালি দল গড়ছে শেখ জামাল ও শেখ রাসেল। পুরোনোদের মধ্যে লড়াইয়ে থাকছে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, ব্রাদার্স ইউনিয়ন। সামনে ঘরোয়া আসরের উত্তাপ যে আরও বাড়বে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এবার বড় চমক নিয়ে হাজির হতে যাচ্ছে চট্রগ্রাম আবাহনী। সর্ব্বোচ্চ সাফল্য তুলে নেয়ার জন্য ইতিমধ্যেই আটঘাট বেঁধে নেমেছে ক্লাবটি। মাঝের কয়েকটা বছরে ঘরোয়া ফুটবলে একচেটিয়া রাজত্ব করেছে বিদেশী ফুটবলাররা। এখন পরিস্থিতি পাল্টাচ্ছে একটু একটু করে। মামুনুল ইসলাম, জাহিদ হোসেন, হেমন্ত ভিনসেন্ট বিশ্বাস কিংবা এনামুল হকরা বিদেশীদের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছেন সমানতালে। সব কথার এক কথা ঘরোয়া আসর আগের থেকে এখন অনেক বেশি জমজমাট।আধুনিক  ফটুবলে উন্নতি করতে হলে শুধু ক্লাবভিত্তিক লিগ কিংবা টুর্নামেন্টগুলো আয়োজনই যথেষ্ট নয়। একটু দেরিতে হলেও এই বাস্তবতা অনুধাবন করতে পেরেছে আমাদের ফুটবল ম্যানেজম্যান্ট। ফুটবলার তৈরির অংশ হিসাবে একাডেমি তৈরি করা হয়েছে সিলেটে। এবারের সাফ অনূর্ধ্ব-১৬ আসরে সাফল্যের পেছনে এই একাডেমির ভূমিকা আছে যথেষ্টই। সাফ জয়ী দলের অর্ধেক ফুটবলার এসেছে  বিকেএসপি থেকে। বাকি অর্ধেক কিন্তু এই একাডেমিরই ফসল। তবে একটিমাত্র একাডেমি যে যথেষ্ট নয় সেটা চ্যাম্পিয়ন ক্ষুদে ফুটবলারদের কথা থেকেই সুস্পষ্ট। সাফ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন অ্যাটাকার সাদ উদ্দীন। চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর এই ক্ষুদে তারকা বলেন- ‘যদি আরও একাডেমি থাকত, আর অনূর্ধ্ব-৮ কিংবা অনূর্ধ্ব-১০ সময়গুলোতে একাডেমির সঙ্গে থাকার সুযোগ পাওয়া যেত তাহলে আমরা অনেক দূর যেতে পারতাম।’ফুটবলে উন্নতি করতে হলে  প্রয়োজন বিশাল বিনিয়োগ। এই বাস্তবতা খুব ভালোভাবেই অনুধাবন করতে পারছেন বাফুফে সভাপতি কাজি সালাউদ্দিন। কিছুদিন আগে বলেছিলেন- ‘অবকাঠামো উন্নয়ন কি দিয়ে করব কোচের টাকা দিতেই তো  হিমশিম খেতে হচ্ছে।’ টাকার অভাবে ডাচ কোচ ডি ক্রইফকে জাতীয় দলের জন্য স্থায়ীভাবে নিয়োগ দিতে পারছে না বাফুফে (বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন)। দেয়া হয়েছে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ। বড় আসরকে সামনে রেখে জাতীয়দলের সঙ্গে কাজ করেন ক্রুইফ। আবার তৃণমূল থেকে ফুটবলার তৈরির জন্য অবকাঠামো নির্মাণ করতে বিশাল অংকের বিনিয়োগ প্রয়োজন। এই দুইয়ের একটা মাঝামাঝি পথ বের করাটা এখন বাফুফের প্রাণের দায়। সাফ জয়ী অনূর্ধ্ব-১৬ দল ও এফসি কাপে প্রাথমিক বাধা পেরুনো শেখ জামাল প্লেয়ারদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে নতুন এক পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন কাজি সালাউদ্দিন। একাডেমিকে একটা পেশাদার ফর্ম্যাটে নিয়ে আসার কথা বলেছেন তিনি। এই নতুন পরিকল্পনা অনুযায়ী, ক্লাবগুলোর কাছে ফুটবলার বিক্রি করবে একাডেমি। এতে করে আর্থিকভাবে একাডেমির চলার পথ সহজ হবে। এবারের ঘরোয়া আসর থেকেই এই  প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার কথাও বলেছেন বাফুফে সভাপতি।ফুটবলে উন্নতি করতে হলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ক্লাব। জার্মান ফুটবল মানেই যেমন বায়ার্ন মিউনিখ, স্প্যানিশ জাতীয় দলের প্রায় সব ফুটবলাররাই খেলেন বার্সেলোনা কিংবা রিয়াল মাদ্রিদে। এটা খুবই সত্যি যে ফুটবলে সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা জনপদ উপমহাদেশ। তারপরও ভারতীয় ফুটবল যে উপমহাদেশ শাসন করছে এর পেছেনে আছে তাদের ক্লাবগুলো।   কলকাতার তিন প্রধানের  (মোহনবাগান, মোহামেডান, ইস্ট বেঙ্গল) ছাড়াও ভারতের প্রায় প্রতিটা প্রদেশেই আছে প্রতিষ্ঠিত ক্লাব। দিনে দিনে বাংলাদেশ ফুটবলে সেই জায়গাটি নিচ্ছে শেখ জামাল। গত বছর ঐতিহ্যবহুল আইএফ শিল্ড প্রতিযোগিতায় পুরো ভারতকে চমকে দিয়েছিল জামাল। ইস্ট বেঙ্গল, মোহনবাগানকে হারিয়ে দলটি উঠে আসে ফাইনালে। শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচে কিছুটা ভাগ্যের দোষে আর কিছুটা বাজে রেফারিংয়ের শিকার হয়ে রানার্সআপ হয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয় শেখ জামালকে। ফাইনালে নিরঙ্কুশ প্রাধান্য বিস্তার করে খেলে শেষ পর্যন্ত টাইব্রেকারে হারে ধানমন্ডির ক্লাবটি। তবে থেমে থাকেনি শেখ জামালের স্বপ্নযাত্রা। সপ্তাহ দুয়েক আগে এফসি কাপ বাছাইয়ের প্রাথমিক পর্বে প্রথম ম্যাচে ম্যাকাওয়ের কাসা বেনফিকাকে ৪-১ গোলে হারিয়েছে ক্লাবটি। এরপর দ্বিতীয় ও শেষ ম্যাচে শক্ত প্রতিপক্ষ কিরগিজস্থানের এফসি আলগার সঙ্গে ১-১ গোলে ড্র করে দলটি। আর এই সুবাদে প্লে অফ রাউন্ডের ছাড়পত্র পেয়ে যায় শেখ জামাল।ভাল খেলেও প্রত্যাশিত ফল ঘরে তুলতে না পারার একটা ধারাবাহিক ব্যর্থতা বাংলাদেশ ফুটবলের একটা ঘনিষ্ঠ অনুষঙ্গ। টাইব্রেকার ট্রাজেডি, লিড নিয়েও শেষ মুহুর্তে গোল খাওয়া, সেট পিস থেকে গোল হজম করা ইত্যাদি ইত্যাদি। সাফ অনূর্ধ্ব- ১৬ আসরের ফাইনাল ম্যাচটি টাইব্রেকারে গড়ালে সেই পুরনো ছবিটিই ভেসে উঠছিল সবার মনে। কিন্তু সব শংকা উড়িয়ে দিলেন আমাদের ক্ষুদে ফুটবলাররা। নিপুণ দক্ষতায় টানা চার শটেই লক্ষ্যভেদ করলেন সবাই। আগেই জয় নিশ্চিত হয়ে যাওয়াতে আর প্রয়োজন পড়ল না পঞ্চম শটটি নেয়ার। ফাইনালের আগে বেশ বড় একটা ধাক্কাও সামলাতে হয় স্বাগতিক বাংলাদেশকে। দুদুটো হলুদ কার্ডের কারণে শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচে খেলতে পারেননি দলের মধ্যমাঠের মূল কারিগর নিপু। ফাইনাল ম্যাচের আগের দিন কোচ গোলাম জিলানি বলেছিলেন- ‘নিপু নাই এটা দুর্ভাগ্যজনক। সে অসাধারণ ফুটবলার। তবে বাংলাদেশ দল শুধু একজনের উপর নির্ভরশীল নয়।’ শিরোপা জিতেই কোচের কথার সত্যতার প্রমাণ দিলেন জিলানির শিষ্যরা। বলা বাহুল্য টুর্নামেন্টের সেরা প্লেয়ারের পুরস্কার জিতেছেন নিপু।মাঠের সাফল্য ও ফুটবলের টানে দর্শকদের মাঠমুখো হওয়াকে বিচ্ছিন্ন করে দেখার কোন সুযোগ নাই। গত কয়েকবছর ধরে নিয়মিতভাবে মাঠে গড়াচ্ছে বাংলাদেশের ফুটবল। আন্তর্জাতিক আঙ্গিনায় ছোট ছোট সাফল্যও আসছে। ফুটবলের প্রতি সেই পুরনো আবেগ জেগে উঠছে ফুটবলপ্রেমীদের মধ্যে। সাফ অনূর্ধ্ব- ১৬ আসরকে ঘিরে ফুটবলভক্তদের এই উচ্ছ্বাস যেন স্মরণ করিয়ে দিল ফুটবলেল সেই সোনালী সময়গুলোকেই। এইচআর/আরআইপি

Advertisement