সুনামগঞ্জের হাওরে ফসলরক্ষা বাঁধ নির্মাণ সময়সীমার আর মাত্র ১০ দিন বাকি। অথচ এখনও অনেক বাঁধের কাজ অর্ধেকও সম্পন্ন করতে পারেনি সংশ্লিষ্ট পিআইসিরা। হাওরে হাওরে চলছে অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা। হাওর বাঁধ যেন লুটপাটের এক নতুন ক্ষেত্র। এরই ধারাবাহিকতায় অধিক হাওর বাঁধের ক্ষেত্র জেলার প্রশাসনের চোখের সামনেই চলছে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের হাওর বাঁধ নির্মাণে পিআইসিদের নীতিমালা লঙ্ঘন ও সীমাহীন অনিয়ম-দুর্নীতি।
Advertisement
প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায় থেকে হাওর দুর্নীতি রোধে তোড়জোড় দেখালেও বাস্তবে প্রশাসনিক কঠোরতার কোনো সাফল্য দেখা যাচ্ছে না। প্রত্যেকটি প্রকল্পে বাঁধের একেবারে কাছে থেকে মাটি উত্তোলন করা হচ্ছে। এর আগেও এরকম অনিয়ম হয়েছে এসব প্রকল্পে। এভাবে বছরে বছরে একই স্থানে বাঁধের একেবারে গোড়া থেকে মাটি উত্তোলন করার কারণে বাঁধের পাশে বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হচ্ছে। জেলার সবকটি বাঁধে সমান তালে বাঁধের নীতিমালা লঙ্ঘন ও সীমাছাড়া অনিয়ম চলছে।
বাঁধের অতি কাছ থেকে মাটি উত্তোলন বন্ধ হচ্ছে না, ধুরমুজ দেয়া হচ্ছে না মোটেই। প্রশাসনের সতর্ক বার্তাকে গ্রাহ্যই করছেনা পিআইসিরা। এসব অনিয়মের ব্যাপারে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড সুনামগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী-২ খুশী মোহন সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, বাঁধের সকল ত্রুটি ও অনিয়ম দূর করতে সংশ্লিষ্ট ইউএনও এবং এসওদের চিঠি দেয়া হয়েছে।
কাবিটা-২০১৭ কর্মসূচির নীতিমালা অনুযায়ী হাওর বাঁধ নির্মাণের ধারে কাছেও থাকছে না কোনো পিআইসি। কচ্ছপ গতিতে চলছে হাওর বাঁধের কাজ। বাঁধে বাঁধে বাসা বেঁধেছে নীতিমালা লঙ্ঘন ও অনিয়ম। অনেক বাঁধেই অদ্যাবধি সাইনবোর্ড পৌঁছেনি। এ বছর হাওর বেষ্টিত সুনামগঞ্জে ৫০টি হাওরে ফসল রক্ষায় বাঁধের কাজ হচ্ছে। এ জন্য গঠন করা হয়েছে ৯৬৪টি পিআইসি। প্রতিটি পিআইসি সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকার কাজ করতে পারে। এ কাজে এখন পর্যন্ত বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ১২২ কোটি টাকা।
Advertisement
বিগত ২০১৭ সালের অকাল প্লাবনে ফসলহানির আতঙ্কে সম্ভাব্যতা যাচাই না করেই প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে যেখানে সেখানে অপরিকল্পিত বাঁধের নামে দেয়া হয়েছে বিপুল অর্থ বরাদ্দ। বেছে বেছে কেবল দলীয় লোকেরাই প্রকল্প পেতে প্রাধান্য পাচ্ছে। হাওর বাঁধ নির্মাণে এসব অনিয়ম-দুর্নীতিতে পর্দার অন্তরালে পরোক্ষভাবে জড়িত থাকা রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের ভয়ে প্রকাশ্যে কেউ কথা বলতে রাজি হননি না।
স্থানীয়রা বলছেন, প্রতি বছর হাওর বাঁধ নির্মাণ যেন একটা লাভজনক মৌসুমী ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। আর এতে লাভবান হচ্ছে এক শ্রেণির সুবিধাবাদী রাজনৈতিক ব্যবসায়ী। স্থানীয়দের অভিযোগ, রাজনৈতিক প্রভাব বলয়ে কারণে-অকারণে প্রকল্প সাজানো হয়েছে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে অনেক বাঁধে।
এদিকে যথাসময়ে বাঁধের কাজ শুরু না হওয়া এবং বৃষ্টি শুরু হওয়ায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন সুনামগঞ্জের কৃষক। সরেজমিনে, সুনামগঞ্জের বিভিন্ন হাওরে ঘুরে দেখা যায়, বাঁধের কাজগুলো ঠিকমতো হচ্ছে না। অনেকটা দায়সাড়াভাবে কাজ করছেন পিআইসি কমিটির লোকেরা। তাছাড়া কোনো বাঁধেই পিআইসি’র কেউ উপস্থিত থাকেন না। ভাড়া করা লোক দিয়ে চালাচ্ছেন বাঁধের কাজ। এস্কেভেটর দিয়ে বাঁধগুলোতে মাটি উত্তোলনের কাজ করায় এস্কেভেটর চালকরা তাদের নিজেদের ইচ্ছামতো করে বাঁধ নির্মাণ করছে। এস্কেভেটর দিয়ে কম সময়ে কম খরচে বাঁধের কাজ সেরে ফেলার জন্য পিআইসিরা এই পদ্ধতি বেছে নিয়েছেন বলে কৃষকরা জানান। অনেক বাঁধেই তথ্য সংযুক্ত সাইনবোর্ড নেই। আবার কোনো কোনো সাইনবোর্ডে পিআইসির ভুল মোবাইল নম্বর দেওয়া হয়েছে।
হাওর বাঁচাও সুনামগঞ্জ বাঁচাও আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক বিজন সেন রায় বলেন, বাঁধের কাজ খুব ধীর গতিতে চলছে। সরকারি নিয়মে ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে বাঁধের কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও আমার মনে হয় না কাজ শেষ হবে। তাছাড়া বৃষ্টিতে বাঁধের মাটিগুলো ডেবে যাচ্ছে। আমরা ইতোমধ্যে জেলা প্রশাসক ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের অবহিত করেছি।
Advertisement
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আহাদ বলেন, বিগত বছরের থেকে এবছর বাঁধের কাজের অগ্রগতি ১৫-২০ শতাংশ এগিয়ে আছে। নির্দিষ্ট সময়ের ভেতরে বাঁধের কাজ সম্পূর্ণ করার জন্য সংশ্লিষ্টদের অবহিত করা হয়েছে। বাঁধের কাজে অনিময় দুর্নীতি হলে আমরা কাউকে ছাড় দেব না।
মোসাইদ রাহাত/এমএএস/জেআইএম