খেলাধুলা

সবার আগে দরকার টপঅর্ডারের ‘দাওয়াই’

নেপিয়ার থেকে ক্রাইস্টচার্চ- শহর বদলেছে, ভেন্যু, মাঠ- উইকেটও ভিন্ন। কিন্তু টাইগারদের পরিণতি আর ভাগ্য বদলায়নি একটুও। দুই ম্যাচে একই ফল- ৮ উইকেটের পরাজয় সঙ্গী। স্কোরলাইনও প্রায় এক; নেপিয়ারে ২৩২ রানে সবাই আউট আর ক্রাইস্টচার্চে ২২৬।

Advertisement

ব্যাটিং ও বোলিংয়ের সামগ্রিক চালচিত্রও খুব খারাপ, ভীষণ অনুজ্জ্বল, নিস্পৃহ। ‘ব্যাটসম্যান’ তকমাধারিদের মধ্যে মিঠুন আর সাব্বির ছাড়া সবাই যেন কোথায় হারিয়ে গেছেন।

আঙুলে চির ধরায় বাইরে সাকিব আল হাসান। তার অনুপস্থিতিতে যে তিনজনের জ্বলে ওঠা একান্তই দরকার, সেই তামিম, মুশফিক আর মাহমুদউল্লাহ ভাল খেলে সব ঘাটতি ও দূর্বলতা পুষিয়ে দেবার বদলে যেন পাল্লা দিয়ে খারাপ খেলতে শুরু করেছেন। আর ওপরে লিটন দাস নিজেকে হারিয়ে খুঁজছেন।

দুই ম্যাচেই টপ অর্ডার চরম ব্যর্থ। ওপরের দিকে মানে প্রথম চার জনের কারো ব্যাটই কথা বলছে না। পাঁচ নম্বর মিঠুন আর সাতে খেলা সাব্বির যথাক্রমে পঞ্চাশ ও চল্লিশের ঘরে পা রাখায় স্কোরটা দু'শো পার হচ্ছে।

Advertisement

তবে যে রানটা হচ্ছে, তা নিয়ে লড়াই চলে না। নিউজিল্যান্ডের পিচে ২৩০/২৪০-২৫০ রান মোটেই লড়িয়ে পুঁজি নয়। তাই ২৩২ ও ২২৬ করে এতটুকু লড়াই করা সম্ভব হচ্ছে না। ৮ উইকেটে হারতে হচ্ছে। খেলা শেষ হয়ে যাচ্ছে অনেক আগেই।

বিপিএল শেষে অগোছালো অবস্থায় নিউজিল্যান্ড যাওয়া, পুরো দল একসঙ্গে একদিনের নামমাত্র অনুশীলনে ওয়ানডে সিরিজ খেলতে নেমে পড়া এবং মাঠে নেমে করুণ অবস্থা।

দেশ ছাড়ার আগের রাতে বিপিএল ফাইনালে আন্দ্রে রাসেল, রুবেল হোসেন, সাকিব আর সুনিল নারিনদের মুড়ি মুড়কির মত উড়িয়ে ঝড়ো শতরান করা তামিম নিজেকে খুঁজে পাচ্ছেন না কিছুতেই। লম্বা ইনিংস খেলা বহুদূর, দু'অংকেই পৌঁছতে পারছেন না।

লিটনের অবস্থা সবচেয়ে করুণ। যেন গভীর সমুদ্রে দিশে হারিয়ে ফেলা এক নাবিক। সৌম্য শুরুতে খানিকটা সময় আলো ছড়াচ্ছেন। কিন্তু তারপরই দপ করে নিভে যাচ্ছেন। বিপিএলে স্লো উইকেটে যে সাঈফউদ্দীনকে মনে হয়েছে খুব ভালো, তাকে নেপিয়ার-ক্রাইস্টচার্চে দেখে ‘অতি সাধারণ’ মনে হচ্ছে।

Advertisement

অধিনায়ক মাশরাফির গড়পড়তা ১২৫ কিলোমিটার গতির বলও কাজে দিচ্ছে না। লাইন ও লেন্থ পুঁজি করা মাশরাফি কিছু ডেলিভারি ভাল জায়গায় পড়লেও তার একচুল লেন্থে খাট ডেলিভারি গতি কম থাকার কারণে মার খাচ্ছে। যে কারণে নেপিয়ার ও ক্রাইস্টচার্চের ফাস্ট ও বাউন্সি উইকেটে মাশরাফি ‘দাওয়াই’ কাজে দিচ্ছে না।

কাটার মাস্টারের সব ‘জারি জুরিও’ শেষ। আসলে নেপিয়ার ও ক্রাইস্টচার্চে যে দুই উইকেটে খেলা হয়েছে, সেখানে বাড়তি গতি বড্ড প্রয়োজন। ১৪০ কিলেমিটার গতির ডেলিভারি একটু-আধটু খাট লেন্থে পড়লে স্বাভাবিকের চেয়ে বাড়তি উচ্চতায় উঠে আসছে। তা কখনো ব্যাটসম্যানকে বেসামালও করে দিচ্ছে।

কিউই ফাস্ট বোলার ট্রেন্ট বোল্ট, ম্যাট হেনরি আর লকি ফার্গুসনের সেই সব ডেলিভারির মুখে নাভিশ্বাষ টাইগারদের। সেখানে মোস্তাফিজের ১৩০'র আশপাশের ডেলিভারিগুলো আর যাই হোক বিপদ ও চিন্তার উদ্রেক ঘটাচ্ছে না কিউইদের।

সাকিব না থাকায় স্পিন বোলিংটাও হয়েছে কমজোরি। মিরাজ একার কুলিয়ে উঠতে পারছেন না। সব মিলে জেতা তো অলিক কল্পনা, এতটুকু লড়াই করাও সম্ভব হচ্ছে না। বারবার চোখে পড়ছে সেই চিরচেনা দৃশ্য, জানা গল্প- ব্যাটিংয়ে তামিম শুরুতে কিছু করতে না পারলেই টপঅর্ডার তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়া।

নেপিয়ার এবং ক্রাইস্টচার্চে যে দুই উইকেটে খেলা হয়েছে, নিউজিল্যান্ড যতোই ভারতের কাছে ওয়ানডে সিরিজে যতোই খাবি খাক না কেন (১-৪ এ সিরিজ হার), ওইসব পিচে কিউইদের ব্যাটিং ও বোলিং বাংলাদেশের তুলনায় বেশ সমৃদ্ধ এবং কার্যকর।

ট্রেন্ট বোল্ট, ম্যাট হেনরি, লকি ফার্গুসনদের বাড়তি গতি এবং ন্যাচারাল বাউন্সের বিপক্ষে শুরুতে উইকেট আগলে রাখা এবং পরিবেশ-পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে ধীরে ধীরে ইনিংস এগিয়ে নেয়ার কাজটি হচ্ছে না। কারণ শুরুর ব্যাটসম্যানদের মধ্যে কেবল তামিমই ধরে খেলতে পারেন।

বিপিএলের ফাইনালে যে তামিমের দেখা মিলেছে সেটা আসলে গত কয়েকবছরের তামিম থেকে আলাদা। যেন অন্য এক তামিম! ৮ ফেব্রুয়ারি শেরে বাংলায় ঢাকা ডায়নামাইটসের বিপক্ষে দেখা মিলেছে ‘ঝড়ের পাখি তামিমের’। সেটা ছিল চট্টগ্রামের খান পরিবারের কনিষ্ঠ সদস্যের ব্যাটিংয়ের আদিরূপ।

শুরুর দিকে কয়েক বছর ওভাবেই খেলতেন তামিম। সেই যে ২০০৭ সালের বিশ্বকাপে ভারতের সাথে গ্রুপ ম্যাচে ভারতীয় ফাস্ট বোলার জহির খানকে দু'পা সামনে বেরিয়ে দুম করে বিশাল ছক্কা হাঁকানোর দৃশ্যটি ছিল তখনকার তামিমের ব্যাটিংয়ের বড় বিজ্ঞাপন। কিন্তু সময়ের প্রবাহে সেই রুপ পাল্টে এখন অনেক পরিণত, ধীর স্থির ও দায়িত্ব সচেতন তামিম। স্ট্রোক প্লে, চটকদার মার, চার-ছক্কার অবাধ প্রদর্শনী তথা যাকে তাকে দুম করে এদিক ওদিক দিয়ে উড়িয়ে মারার চেয়ে উইকেটে বেশী সময় থেকে, ধৈর্য্য আর মনোযোগ-মনোসংযোগের মিশেলে লম্বা ইনিংস খেলাই এখন ব্রত তামিমের।

হিসেব করলে দেখা যাবে তিন ফরম্যাট মিলিয়ে গত তিন বছর বাংলাদেশের যতো জয় কিংবা সাফল্য তার শুরুর ভীতটা রচিত হয়েছে তামিমের ব্যাটেই। উদাহরণস্বরূপ ২০১৭ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি কিংবা ২০১৮ সালের ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে তামিম একাই হয়েছিলেন বাংলাদেশের ত্রাণকর্তা।

কিন্তু নেপিয়ার ও ক্রাইস্টচার্চে সেই তামিম শুরুই করতে পারেননি। সেটাই সবচেয়ে ভোগাচ্ছে। তামিম শুরুতে অল্প রানে আউট হওয়ায় পরের দিকের ব্যাটসম্যানরা সাহস ও খেই হারিয়ে ফেলছেন।

লিটন দাসকে মনে হচ্ছে শিক্ষানবীশ। কোয়ালিটি ফাস্ট বোলিংয়ের বিপক্ষে আস্থা ও আত্ববিশ্বাস নিয়ে খেলার জন্য যে সুন্দর টেকনিক-স্কিল প্রয়োজন তাতে ঘাটতি আছে। সত্যি বলতে কি বোল্ট, হেনরি আর ফাগুর্নসের প্রচন্ড গতি ও গড়পড়তা বুক সমান উচ্চতায় থাকা ডেলিভারির বিপক্ষে লিটন দাসকে বেশ আড়ষ্ট লাগছে। সৌম্য সরকারের টেকনিক কিংবা সামর্থ্যের কমতি নেই। কিন্তু শট সিলেকশন ও টেম্পারমেন্টে রয়েছে প্রচুর ঘাটতি। মুশফিককে মনে হচ্ছে কেমন ছন্নছাড়া। সেই ধাক্কা এসে লেগেছে ভায়রা মাহমুদউল্লাহর গায়েও।

তবু রক্ষা, মিঠুন দুই ম্যাচেই দায়িত্ব সচেতনতার পরিচয় দিয়েছেন। নিজের সামর্থের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা নিয়ে খেলছেন। অযথা ও অপ্রয়োজনীয় বা বাড়তি কিছু করার কোনো চেষ্টা নেই। তার চেয়ে উইকেটে থেকে ব্যাটিংয়ের সবচেয়ে বড় বেসিক বা মৌালিক ব্যাকরণ অনুসরণ করে বলের মেধা ও গুণ বিচার করে খেলছেন। তাতে সাফল্যও আসছে। এশিয়া কাপের মত ইতিমধ্যে একজোড়া হাফ সেঞ্চুরিও জমা পড়েছে নামের পাশে।

অনেক নাটকীয়তার পর সাসপেন্সন কাটিয়ে দলে ফেরা সাব্বির আহামরি কিছু করতে না পারলেও সাত নম্বরে নেমে ৪০'র ঘরে (৪৩) পা রেখেছেন। মিঠুনের সাথে সাব্বির রান করাতেই স্কোর ২২৫ + হচ্ছে। কিন্তু সেটা যথেষ্ট নয় মোটেই। নিউজিল্যান্ডের পিচে আসলে এই ২৩০/২৪০-২৫০ রান কিছুই না।

নেপিয়ার, ক্রাইস্টচার্চ ও ডানেডিনে ২৮০’র কম স্কোর নিয়ে লড়াই করা সম্ভব নয়। কিউই ব্যাটিংয়ের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে, মার্টিন গাপটিল, রস টেলর আর টম লাথামদের অগ্নি পরীক্ষায় ফেলতে হলে অবশ্যই ৩০০'র আশপাশে পুঁজি দরকার। তখন বোলারদের কিছু করার থাকবে। এমনিতেই বোলিং কমজোরি, ধারহীন।

ঘরের মাঠে স্লো পিচে যত কার্যকরই হোক না কেন বাড়তি গতি ও ভাল বাউন্সি উইকেটে মাশরাফি সাইফউদ্দীন আর মোস্তাফিজের মাঝারী গতি ও লাইন-লেন্থ নির্ভর বোলিং দিয়ে ২২৫/২৩০ রানকে ডিফেন্ড করা খুব কঠিন।

তাই শেষ কথা, রান চাই রান। ব্যাটসম্যানদের ব্যাট কথা না বললে সেই রানের দেখা মিলবে না। ওপরের দিকে তামিম, লিটন, সৌম্য আর মুশফিকের ব্যাট থেকে একজোড়া হাফ সেঞ্চুরি কিংবা একজন সেঞ্চুরি করতে পারলে আপনা আপনি ৫০ থেকে ৬০ রান বেড়ে যাবে। তখন এই স্কোরটাই ২৮০+ হয়ে যাবে। দেখা যাক ডানেডিনে তা হয় কি না?

এআরবি/এসএএস/এমএস