জাতীয়

দুদকের দায়মুক্তিতে হতবাক সংসদীয় কমিটি

রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বেসিক ব্যাংকের টাকা লুটের সঙ্গে জড়িত প্রতিষ্ঠানটির সাবেক চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ সংশ্লিষ্টরা দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) আইনে দোষী স্বাব্যস্ত না হওয়ায় হতবাক হয়েছে সংসদীয় কমিটি। কোনোভাবেই এসব দুর্নীতিবাজরা যাতে পার পেয়ে যেতে না পারে সে বিষয়ে সতর্ক থেকে যে আইনে তাদের দোষী সাব্যস্ত করে শাস্তি নিশ্চিত করা যায় সেই আইনেরই প্রয়োগ করার তাগিদ দেয়া হয়েছে কমিটির পক্ষ থেকে। জাতীয় সংসদ ভবনে বুধবার বিকেলে অনুষ্ঠিত অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এ তাগিদ দেয়া হয়। প্রতিষ্ঠানটির তৎকালীন পরিচালনা বোর্ডের সদস্য ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের শাস্তি নিশ্চিত করতে না পারায় তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করে কমিটি। এই অনিয়মের সঙ্গে ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান এবং এমডিসহ বোর্ডের কর্মকর্তারা কে কতটুকু জড়িত ছিলেন তার সুনির্দিষ্ট করে বিস্তারিত তথ্য প্রমাণাদি পরবর্তী বৈঠকে উপস্থাপনের নির্দেশনা দিয়েছে কমিটি। পাশাপাশি দেশের প্রচলিত আইন এবং ব্যাংক কোম্পানি আইনের আওতায় তাদের বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেয়া যায় সে বিষয়েও একটি প্রতিবেদন উপস্থাপনের কথা বলা হয়েছে। কমিটির সভাপতি ড. মো. আব্দুর রাজ্জাকের সভাপতিত্বে বৈঠকে কমিটির সদস্য অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, অর্থ প্রতিমন্ত্রী এম. এ. মান্নান, নাজমুল হাসান, টিপু মুন্শি, ফরহাদ হোসেন, মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী এবং মো. শওকত চৌধুরী অংশ নেন। অর্থ মন্ত্রণালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব, বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নরসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।সংসদীয় কমিটিতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের উপস্থাপিত এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন এই ব্যাংকটিকে ধ্বংস ও ফতুর করে দিতে অনিয়ম, দুর্নীতি আর জালিয়তির সব ধরনের প্রক্রিয়াই প্রয়োগ করেছেন ব্যাংকটির অর্থলোভী পরিচালনা পর্ষদ ও সংশ্লিষ্ট দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা। একটি কিংবা দুটি শাখা নয়, রাজধানীর প্রায় প্রতিটি শাখাতেই প্রতিষ্ঠানটির হর্তাকর্তাদের নির্দেশে গঠিত কর্মকর্তাদের সিন্ডিকেট ঋণের নামে বিলিয়ে দিয়েছেন হাজার হাজার কোটি টাকা। নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে শুধুমাত্র রিলেশনশিপের ভিত্তিতে কোনো ধরনের কাগজপত্র কিংবা জামানত ছাড়াই মাত্র একদিনে অনুমোদন দেয়া হয়েছে বিশাল অঙ্কের এসব ঋণ। ঋণ আবেদন পত্রের সঙ্গে সিকিউরিটি ফরমের ব্যবহার বাধ্যতামূলক থাকলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই ফরম আংশিক পূরণকৃত কোনো কোনো ক্ষেত্রে একদম ফাঁকাই রাখা হয়েছে। অনেক ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে আবেদনপত্র গ্রহণ না করারও নজির রয়েছে। জামানত দেখানোর ক্ষেত্রে জাল দলিল অনেক ক্ষেত্রে আগে ঋণ উত্তালন করে সেই টাকায় জমি কিনে তা বন্ধক রাখার ঘটনাও ঘটেছে। মূলত প্রতিষ্ঠানটি লুটপাটে এমন কোনো জালিয়াতি নেই যা করা হয়নি। যেসব গুরুতর অনিয়ম হয়েছেঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে ব্যাংকটিতে যেসব গুরুতর অনিয়ম হয়েছে সেগুলো হচ্ছে- শাখার ক্রেডিট কমিটির দেয়া নেতিবাচক বিষয়গুলো গুরুত্ব না দিয়ে প্রধান কার্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ বোর্ডের কাছে ঋণ প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য পেশ করা হয়েছে এবং বোর্ডের মাধ্যমে ক্রটিপূর্ণ ঋণ প্রস্তাবগুলো অনুমোদন করিয়ে নেওয়া হয়েছে। কোনো কোনো ঋণ মঞ্জুরীর ক্ষেত্রে তৃতীয় পক্ষের জাল দলিল বন্ধক হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। ঋণ প্রস্তাব গ্রহণের পূর্বে গ্রাহকের ব্যবসায়িক অভিজ্ঞতা, সামর্থ ও ব্যবসাস্থল পরিদর্শন না করেই প্রস্তাব পেশ করা হয়েছে। ঋণ মঞ্জুরীর ক্ষেত্রে গ্রাহকের হালনাগাদ সিআইবি প্রতিবেদন সংগ্রহ করা হয়নি।  ঋণ মঞ্জুরীর আবেদন গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে তড়িঘড়ি করে চলতি হিসাব খুলে কোনো যাচাই বাছাই না করে অতি অল্প সময়ের মধ্যে এমনকি একদিন পরেই শাখা থেকে ঋণ অনুমোদনের জন্য প্রেরণ করা হয়েছে। মঞ্জুরীকৃত ঋণের মধ্যে কোনো কোনো ক্ষেত্রে আবেদন পত্র না থাকা এবং ঋণের মঞ্জুরীপত্রে উল্লেখিত শর্তাদি যথাযথ ভাবে পালন না করেই অর্থ ছাড় করা হয়েছে। ঋণ বিধিমালা উপেক্ষা করে প্রয়োজনীয় জামানত ব্যতিরেকে ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করা এবং প্রস্তাব অনুমোদনের পর অর্থ ছাড়ের পূর্বে নির্দেশিত জামানত গ্রহণ না করেই করা হয়েছে ঋণ বিতরণ। মঞ্জুরীকৃত ঋণের টাকা ব্যবসায় ব্যবহার না করে ভূমি ক্রয় করে ওই ভূমিই ব্যাংকের কাছে জামানত হিসেবে প্রদান করা হয়েছে এবং ব্যাংক কর্মকর্তা তা গ্রহণও করেছেন। ব্যাংকটিতে ঋণ আবেদনের জন্য নির্ধারিত ফরম নেই। ঋণ গ্রহীতারা নিজেদের পছন্দ ও সুবিধামতো তথ্য দিয়ে আবেদন করেছেন। সব ক্ষেত্রেই রিলেশনশিপের ওপর ভিত্তি করে ঋণ প্রদান করা হয়েছে। ঋণ আবেদনে বর্ণিত তথ্যাদি যাচাই বাছাই/তদন্ত প্রতিবেদন দেননি ম্যানেজার। প্রতিটি ঋণ কেসের সঙ্গে ব্যাংকের নির্ধারিত সিকিউরিটি ফরম পূরণ করে সংযুক্ত করার কথা। বেশিরভাগ ঋণের ক্ষেত্রে সংযুক্ত সিকিউরিটি ফরম খালি অথবা অসমাপ্ত রাখা হয়েছে। এমনকি পেনসিল দিয়ে পূরণকৃত ও স্বাক্ষরবিহীন সিকিউরিটি ফরম সংযুক্ত করা হয়েছে। এইচএস/এসএইচএস/আরআইপি

Advertisement