দেশজুড়ে

এই বয়সেও রিকশা চালিয়ে জীবন চলছে তাদের

১০ বার বছর বয়সে বাবাকে হারানোর পর সংসারের দায়িত্ব কাঁধে পড়ে ভোলা সদর উপজেলার চর সেমাইয়া ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ডের মমতাজ সরদার বাড়ির আব্দুর রবের (৬৫)। তার বাবা আব্দুল মজিদ কৃষি শ্রমিক ছিলেন। তিনি কিছুই রেখে যেতে পারেননি। তখন মা ও ভাইবোন নিয়ে পাঁচ জনের সংসার। আব্দুর রব বড় ছেলে। তাই দুই বেলা দুমুঠো খাবার জোটানোর জন্য ওই বয়সেই আব্দুর রবকে কাজে নামতে হয়। কখন যে রিকশার চাকা আর প্যাডেলের সঙ্গে তার জীবন আটকে যায় তা তিনি নিজেও জানেন না।

Advertisement

আব্দুর রব জানার, তার সংসারে স্ত্রী, দুই ছেলে ও দুই মেয়ে রয়েছে। ছেলে-মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন। মেয়েরা চলে গেছে অন্যের সংসারে আর ছেলেরা স্ত্রী-সন্তান নিয়ে আলাদা হয়ে গেছে। এখন বুড়ো-বুড়ি দুজনের সংসার। শরীর আর আগের মতো ঠিক নেই। আগে প্যাডেলের রিকশা (বাংলা রিক্সা) চালাতেন। শরীরে আগের মতো জোর না পাওয়ায় গত তিন বছর আগে ৫০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে ব্যাটারিচালিত রিকশা কিনেছেন।

তিনি বলেন, একদিকে সুদের টাকা পরিশোধের চাপ, অন্যদিকে রোজগারও ভালো না। প্রায়ই অসুস্থ থাকি। অনাহারে অর্ধাহারে দিন চলে। সরকারি কোনো সহায়তাও পাচ্ছি না। বয়স্কভাতা কিংবা এ ধরনের কোনো সহায়তা পেলে শেষ জীবনের কয়েকটি দিন শান্তিতে কাটাতে পারতাম।

ভোলা সদর উপজেলার কাচিয়া ইউনিয়নের পরানগঞ্জ এলাকার মৃত মো. হানিফের ছেলে মো. সিরাজ। পেশায় রিকশাচালক। মাত্র ৫৭ বছর বয়সেই তিনি মনে করছেন শেষ জীবনে এসে পৌঁছেছেন। চার ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে তিন ছেলে বিয়ে করার পর নিজের সংসার নিয়ে ব্যস্ত। বাবা-মায়ের মুখে খাবার তুলে দেয়া তো দূরের কথা তাদের খবর রাখে না তারা।

Advertisement

তিনি ও তার স্ত্রী প্রায়ই অসুস্থ থাকেন। প্রতিদিনই ৩০/৪০ টাকার ওষুধ খেতে হয় তাদের। তারপরও বাধ্য হয়ে এই দুর্বল শরীরেও রিকশা চালিয়ে সংসার চালাতে হয়। স্ত্রীর ভরণপোষণ ছাড়াও ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ুয়া ছোট ছেলে এবং নবম শ্রেণিতে পড়ুয়া ছোট মেয়ের লেখাপড়ার খরচ জোগাতে হিমসিম খেতে হচ্ছে তাকে। তারপরও তিনি তার জীবন সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন।

মাত্র ১৫ বছর বয়সেই রিকশা নিয়ে জীবন যুদ্ধে নামতে হয় ভোলা সদর উপজেলার ধনিয়া ইউনিয়নের ৯ নং ওয়ার্ডের নবীপুর গ্রামের মৃত রাজা মিয়ার ছেলে রতন মিয়াকে (৬০)। কারণ রিকশাচালক বাবার মৃত্যুর পর মা ও ৮ ভাইবোনের মুখে খাবার জোটাতে হবে। তাই বাবার রিকশাটি নিয়ে নেমে পড়েন রাস্তায়। সময় গড়িয়েছে অনেক। ভাই বোনদের বিয়ে দিয়েছেন। নিজেও বিয়ে করে সংসার পেতেছেন।

রতন মিয়া জানান, তিন ছেলে ও এক মেয়ের সংসার। স্ত্রী দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ। দেখতে দেখতে ৪০ বছরেরও অধিক সময় গড়িয়েছে। এখন আর পায়ে চাপা রিকশা চলে না। সবাই ইঞ্জিন লাগানো রিকশা চালায়। যাত্রীরাও ওইগুলো পছন্দ করে। তাই বাধ্য হয়ে অন্যের ইঞ্জিনচালিত রিকশা ভাড়ায় চালাচ্ছেন। দেড় এক বছর আগে অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। ঢাকায় অপারেশন করতে হয়। এতে অনেক টাকা খরচ হয় তার। তাই বাধ্য হয়ে নিজেদের ঘর ভিটা বিক্রি করে অপারেশন করান।

তিনি আরও জানান, অসুস্থ থাকার পরও রিকশা চালান তিনি। তার তিন ছেলে এখন বিয়ে করেনি। তারা অন্যের জমিতে কাজ করে। অভাবের কারণে পড়াশোনা করতে পারেনি। শিশুকাল থেকেই বাবার পাশাপাশি সংসারের হাল করে তারা।

Advertisement

রতন মিয়া বলেন, সম্প্রতি ছেলেদের কথায় বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে ৫ শাতাংশ জমি কিনেছি। এটাই আমার সার্থকতা।

আব্দুল খালেক মিয়া, বয়স ৫৭। বাড়ি ভোলা সদর উপজেলার শিবপুর ইউনিয়নের রতনপুর গ্রামে। শেষ জীবনে এসে এভাবে অসুস্থ শরীরে রিকশা চালাতে হবে তা স্বপ্নেও ভাবেননি তিনি। নিজের জমি, বাড়ি সবই ছিল আব্দুল খালেক মিয়ার। রিকশা চালিয়ে কাজ করে চার ছেলে এক মেয়ের সংসার বেশ ভালোই চলছিল। ছেলে-মেয়েদের বিয়ে দেয়ার পর এখন নিজে চরম বিপাকে পড়েছেন। কারণ ছেলেরা বাড়ির জমি সব দখল করে খালেক মিয়া আর তার স্ত্রীকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছেন। তারপরও তাদের বিরুদ্ধে তার কোনো অভিযোগ নেই। সবই কপালের দোষ বলে মেনে নিয়েছেন। তাই বাসা ভাড়া নিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে বসবাস করছেন।এ অবস্থায় সরকারি সহযোগিতার আশা করছেন তিনি।

আরেকজন আব্দুল মালেক, বয়স ৬৫ বছর। বাড়ি ভোলা সদরের ইলিশা ইউনিয়নের চর আনন্দ গ্রামে। আগে অন্যের ক্ষেতে কাজ করতেন। তাও প্রতিদিন পেতেন না। একদিন কাজ করলে চারদিন বসে থাকতে হতো। বিয়ের পর ঢাকায় রিকশা ভাড়া নিয়ে চালাতেন। গত ১০ বছর ধরে ভোলা শহরে রিকশা চালাচ্ছেন তিনি। এটাই তার আয়ের একমাত্র উৎস। স্ত্রী ও পাঁচ ছেলে নিয়ে তার সংসার। ছেলেদের পড়াশোনা করানোর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তারা পড়েনি। ছেলেরা এখন ঢাকায় রিকশা চালায়।

আব্দুল খালেক বলেন, আমার ছেলেরা আমার মত যেন সারা জীবন রিকশা না চালায়। কারণ এ পেশার মানুষকে কেউ সম্মান দেয় না। এজন্য তিনি তার রোজগার থেকে ছেলেদের জন্য ঢাকায় টাকা পাঠান। বাড়িতে তিনি ও তার স্ত্রী ছাড়া আর কেউ নেই। তিনিও জানেন না সরকারি বয়স্ক ভাতা সম্পর্কে।

ভোলা সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মো. কামাল হোসেন বলেন, বয়স্ক ভাতার বিষয়ে আমাদের কাছে ইউপি চেয়ারম্যানরা তালিকা পাঠান। ইউপি চেয়ারম্যানদের বলা আছে- যারা বয়স্ক ভাতা পাওয়ার যোগ্য তাদের নাম তালিকাভুক্ত করার জন্য।

তিনি আরও বলেন, আমাদের কাছে যদি কেউ এসে বলে যে সে বয়স্ক ভাতা পাওয়ার যোগ্য, কিন্তু পাচ্ছেন না । অবশ্যই আমরা তার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

আরএআর/এমকেএইচ