আমিনুল ইসলাম বুলবুল বাংলাদেশের ক্রিকেটে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তার ক্রিকেট ক্যারিয়ার নিয়ে নতুন করে কিছু লেখার নেই। পুরোদস্ত ক্রিকেটার হওয়ার আগে তিনি যে ঘরোয়া ফুটবলের সর্বোচ্চ পর্যায়েও খেলেছেন তা অনেকের কমবেশি জানা আছে। তবে এই জানা কাহিনীর মধ্যে কিছু অজনা গল্পও আছে ‘ফুটবলার বুলবুলে’র। যে গল্পটা তিনি প্রথম প্রকাশ করলেন বৃহস্পতিবার।
Advertisement
কী সেই গল্প বুলবুলের, যা এতদিন তিনি ছাড়া কেউ জানতেন না? এমনকি তার পরিবারেরও কেউ নয়। ফুটবলকে তিনি এতটাই ভালোবাসতেন যে, উচ্চ মাধ্যমিকে অর্থনীতি বিষয়ের পরীক্ষা না দিয়েই হল থেকে বের হয়ে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে ছুটে গিয়েছিলেন ফুটবল ম্যাচ খেলতে। যে কারণে, তাকে দ্বিতীয়বার পরীক্ষা দিয়ে এইচএসসি পাস করতে হয়েছিল।
আমিনুল ইসলাম বুলবুল ক্রীড়াবিদ হিসেবে ফুটবল ও ক্রিকেট খেলেছেন যখন, তখন স্টেডিয়ামের গ্যালারি থাকতো দর্শকে টইটুম্বুর। বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে অর্ধ লক্ষাধিক দর্শকের সামনে ফুটবল ও ক্রিকেট খেলে ক্রীড়াবিদ হয়েছিলেন তিনি। দেশের খেলাধুলার প্রাণকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের সঙ্গে তার প্রাণের সম্পর্ক। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলের (আইসিসি) ডেভেলপমেন্ট ম্যানেজার এশিয়ায় কর্মরত বুলবুল বেশিরভাগ সময়ই থাকেন অস্ট্রেলিয়া এবং দুবাইয়ে। দুই দিনের জন্য ঢাকায় আসলেও তার একবার ঢু-মারা চাই বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে।
বুধবার তার প্রিয় ক্লাব মোহামেডানের প্রিমিয়ার ফুটবল লিগের ম্যাচ দেখেতে এসেছিলেন বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে। এসেছিলেন বৃহস্পতিবার দুপুরেও অন্য একটি কাজে। তখনই দেশের সর্বকালের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার কিছু সময় কাটিয়েছেন বাংলাদেশ ক্রীড়ালেখক সমিতির কার্যালয়ে। নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে দীর্ঘ আলাপচারিতায়ই বেরিয়ে আসে স্বল্প ফুটবল ক্যারিয়ারের কিছু মজার গল্প।
Advertisement
‘১৯৮৬ সালে প্রিমিয়ার ফুটবল লিগের ম্যাচ ছিল মুক্তিযোদ্ধা ও ইস্টএন্ড ক্লাবের। আমি তখন ইস্টএন্ডে খেলি। এ ম্যাচটি ছিল ইস্টার্ন ক্লাবের রেলিগেশন সেভের ম্যাচ। ওইদিন আমার এইচএসসির অর্থনীতি পরীক্ষাও ছিল। আমি হলেও (নটরডেম কলেজে) গিয়েছিলাম; কিন্তু পরীক্ষা দিতে বসার আগেই সতীর্থ লিটন মটর সাইকেলে বসে বারবার হর্ণ বাজিয়ে আমাকে আসার জন্য সংকেত দিচ্ছিল। আমি পরীক্ষা দেয়া বাদ দিয়ে লিটনের মটর সাইকেলে চড়ে চলে আসি বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে; কিন্তু রেলিগেশন থেকে ইস্টার্ন ক্লাবকে বাঁচাতে পারিনি। আমার দল ১-০ গোলে হেরে নেমে যায় প্রথম বিভাগে। আমি সেদিন ম্যাচের পর অনেক কেঁদেছিলাম’- ৩৩ বছর আগের কাহিনী এভাবেই প্রথম প্রকাশ করলেন বুলবুল।
এইচএসসির ফাইনাল পরীক্ষা না দেয়া জীবনের বড় এক ঘটনা। এতদিন তা চেপে রেখেছিলেন কেন? বুলবুলের জবাব, ‘আমার পরিবারের সবাই জানতো আমি এইচএসসি পাশ করতে পারিনি। একটি পরীক্ষা না দেয়ার কারণে যে এমন হয়েছে তা আর বলতে পারিনি। বললে সবাই রাগ করতেন, কষ্ট পেতেন। আসলে ফুটবলকে এতটাই ভালোবাসতাম যে, আমার কাছে পরীক্ষার চেয়ে দলের রেলিগেশন সেভটাই বড় মনে হয়েছিল। যদিও দল জেতাতে পারিনি, একাডেমিক ক্যারিয়ারেও পিছিয়ে পড়ি এক বছর।’
ফুটবলে স্ট্রাইকার ছিলেন বুলবুল। পাইওনিয়ার লিগে গেন্ডারিয়া ফেমাসের হয়ে সর্বোচ্চ গোলদাতাও হয়েছিলেন। ঘরোয়া ফুটবল লিগের সিঁড়ি বেয়ে তিনি তখনকার সর্বোচ্চ আসর প্রিমিয়ারেও খেলেছেন; কিন্তু ফুটবলার হওয়ার স্বপ্নটা বুলবুলের নিভে যায় ১৯৮৭ সালে। ইস্টএন্ড ক্লাব প্রথম বিভাগে নেমে যাওয়ার পরের বছর বুলবুল নাম লিখিয়েছিলেন প্রিমিয়ারের দল ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাবে। মোাহমেডানের বিরুদ্ধে ম্যাচে বড় ধরণের ইনজুরিতে পড়েন বুলবুল। মোহামেডানের সফিকুল ইসলামের সঙ্গে আঘাতে পায়ের লিগামেন্ট ছিড়ে গেলে দাঁড়ি পড়ে বুলবুলের ফুটবল ক্যারিয়ারে।
ক্রিকেটার হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেলেও আমিনুল ইসলাম বুলবুলের চোখে এখনো ফুটবল বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা। ‘আমি মনে করি না যে, বাংলাদেশের ফুটবল শেষ হয়ে গেছে। তবে এটা ঠিক, আমাদের ফুটবল এগোয়নি। এক জায়গায় থেমে আছে। বিশ্ব ফুটবল এগিয়ে যাওয়ায় আমাদের এ অবস্থা। আমাদের ফুটবল না আগানোর অনেক কারণের একটি হলো, পাতানো খেলা। আমি এটাও বলবো যে, যারা ফুটবলের পাতানো খেলার হোতা, তারা ক্রিকেটেও আছেন।’
Advertisement
বুধবার তার প্রিয় ক্লাব মোহামেডানের ম্যাচ দেখে লজ্জার এক স্বাক্ষীই হয়েছেন আমিনুল ইসলাম বুলবুল। লিগে টানা চার হারের পর ব্যথিত মনেই গেন্ডারিয়ার বাসায় ফিরেছিলেন বাংলাদেশের অভিষেক টেস্টে সেঞ্চুরি করা এই অলরাউন্ডার। ‘আমার খুব খারাপ লেগেছে মোহামেডানের ম্যাচ দেখে। বোঝাই যাচ্ছিল না, এটা মোহামেডান। কী মাঠে, কী ডাগআউটে- সবক্ষেত্রেই মোহামেডানকে অচেনা লেগেছে আমার কাছে। মোহামেডানের এমন হাল বিশ্বাস করতেই কষ্ট হচ্ছিল।’
আপনি ঢাকায় আসলেই কী বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে আসেন? বুলবুলের জবাব ‘হ্যাঁ। আমি দুই দিনের জন্য ঢাকায় আসলেও একবার বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে ছুটে আসি। খেলা থাকলে আসি। খেলা না থাকলে এখানে ক্রিকেটের যে অফিস আছে ওখানে এসে সবার সঙ্গে দেখা করে যাই। আসলে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে আমি ছুটে আসি প্রাণের টানেই। এই স্টেডিয়ামে গ্যালারি ভর্তি দর্শক-সমর্থকের সামনে ফুটবল ও ক্রিকেট খেলেছি। এই স্টেডিয়ামের মাটিই যে আমাকে আমিনুল ইসলাম বুলবুল বানিয়েছে! এ স্টেডিয়াম ভুলি কী করে?’
আরআই/আইএইচএস/এমকেএইচ