প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘ভবিষ্যতে তরুণদের সুযোগ করে দিতে চাই। এ কারণে বর্তমান ও টানা তৃতীয় মেয়াদই যেন হয় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আমার শেষ মেয়াদ।’
Advertisement
জার্মান সংবাদ মাধ্যম ডয়চে ভেলের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেয়া শেখ হাসিনা এমন মন্তব্য করেন। টানা তৃতীয় মেয়াদে দায়িত্ব নেয়ার পর প্রথম কোনো আন্তর্জাতিক সম্প্রচার মাধ্যমকে দেয়া সাক্ষাৎকারে আওয়ামী লীগ সভাপতি এটা নিশ্চিত করেন যে, পরবর্তী মেয়াদে আর প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য চেষ্টা করতে চান না তিনি।
ডয়চে ভেলেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘এটা আমার তৃতীয় মেয়াদ। এর আগেও প্রধানমন্ত্রী হয়েছি (১৯৯৬-২০০১)। সব মিলিয়ে চতুর্থবার। আমি আর চাই না। একটা সময়ে এসে সবারই বিরতি নেয়া উচিত বলে মনে করি, যেন তরুণ প্রজন্মের জন্য জায়গা করে দেয়া যেতে পারে।’ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশে গত এক দশকে ব্যাপক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে এবং নিম্ন-মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। বছরে গড়ে ছয় থেকে সাত ভাগ হারে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছে। বাণিজ্য বেড়েছে। বিদেশি বিনিয়োগও এসেছে। এমন উন্নয়নের পরও বিশ্বব্যাংকের হিসাবে বলা হয়েছে, এখনও বাংলাদেশের প্রতি চারজনের একজন দরিদ্র। শেখ হাসিনা তার সম্ভাব্য শেষ মেয়াদে এই দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াই আরও বেগবান করতে চান।
ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘খাদ্য নিরাপত্তা, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, কর্মসংস্থান– এসব মৌলিক চাহিদা। প্রত্যেক মানুষই তার অবস্থার উন্নতি ঘটাতে চায়। আমাদের সেটাই নিশ্চিত করতে হবে।’
Advertisement
তার সরকার বাক স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করেন এবং মুক্তচিন্তা ও মুক্তচিন্তকদের ওপর আঘাত থামাতে খুব বেশিকিছু করতে পারেননি- এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে শেখ হাসিনা তা অস্বীকার করেন। বলেন, ‘মুক্ত চিন্তাকে শতভাগ সমর্থন করি। এ কারণে সমালোচনাও তাই স্বাভাবিক। যত কাজ করবেন, তত সমালোচনা শুনবেন।’
‘আপনি আমার দেশের মানুষকে প্রশ্ন করুন, তারা সন্তুষ্ট কিনা? তাদের যা যা প্রয়োজন, সব পাচ্ছে কিনা কিংবা আমি সব দিতে পারছি কিনা?’
‘আওয়ামী লীগবিরোধীদের জন্য রাজনীতির মাঠ সংকুচিত করে রেখেছেন এবং একদলীয় শাসনব্যবস্থা কায়েম করতে চাইছেন’– ডয়চে ভেলের এমন অভিযোগ প্রসঙ্গে সরকারপ্রধান বলেন, ‘জনগণের ভোটের মাধ্যমেই তো ক্ষমতায় আসা, সেটা একদলীয় হয় কী করে? আর দ্বিতীয় কথা হচ্ছে যে, ২০০৮-এ যে নির্বাচন হয়েছিল, সে নির্বাচনেও ৮৪ ভাগ (আসলে ৮৬.৩৪%) ভোট পড়েছিল। এবার তো ৮০ ভাগ ভোট পড়েছে। তখন বিএনপি-জামায়াত জোট পেয়েছিল মাত্র ২৮ সিট। এবারের ইলেকশনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ পেয়েছে ২৬০ সিট (৩০০টির মধ্যে)। বাকি সব অন্য দলগুলো পেয়েছে। সেখানে দল তো আছেই।’
বিরোধী দল প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এখন কোনো দল যদি তাদের কর্মসূচি নিয়ে জনগণের কাছে না যেতে পারে, জনগণের বিশ্বাস, আস্থা অর্জন করতে না পারে, আর যদি ভোট না পায়, সে দায়-দায়িত্ব কার? সে তো ওই দলগুলোর দুর্বলতা।’
Advertisement
‘মৌলবাদীদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের নিবিড় সম্পর্ক আছে বলেও সমালোচনা আছে। বাংলাদেশের উদারপন্থীরা হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগের সুসম্পর্কের সমালোচনা করেন। তাদের অভিযোগ, ওই গোষ্ঠী মৌলবাদী ও তারা নারীর বিকাশের বিরুদ্ধে। সম্প্রতি ওই গোষ্ঠীর নেতা মাওলানা শাহ আহমেদ শফী মেয়েদের স্কুল-কলেজে না পাঠানোর জন্য সমর্থকদের ওয়াদা করিয়েছেন’- ডয়চে ভেলের উত্থাপিত এসব বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি বলেছি যে, এখানে বাক স্বাধীনতা আছে। তাই যে কেউ যেকোনো কিছুই বলতে পারেন। নারীদের বিকাশে চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখা হচ্ছে না। আমি দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত নারীশিক্ষা পুরোপুরি অবৈতনিক করে দিয়েছি। তাদের বৃত্তিও দিচ্ছি।
‘আগে বাবা-মায়েরা চিন্তা করতেন যে, মেয়েকে পড়িয়ে লাভ কী, সে তো অন্যের ঘরে চলে যাবে। এখন সেভাবে চিন্তা করেন না তারা। এখন তারা ভাবেন যে, মেয়েকে শিক্ষিত করা উচিত যেন সে নিজে উপার্জন করতে পারে। এরপর সে বিয়ে করবে। খুব ধীরে ধীরে আমরা পরিবর্তন আনছি। বাল্যবিবাহ এখন অনেক কমে গেছে।’
‘আর নারীশিক্ষা নিয়ে যিনি ওই মন্তব্য করেছেন এর দায়দায়িত্বও তার।’
‘যে লক্ষ্য অর্জনে শেখ হাসিনা কাজ করে যাচ্ছেন, তাতে কি মৌলবাদীরা বাধা হবে’- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘অবশ্যই না। আমি যা করেছি, যা করছি এবং এটা চলবে।’
রোহিঙ্গাদের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসনের পাশাপাশি আওয়ামী লীগ সরকার হাজার হাজার শিশু-কিশোর-তরুণ যারা সেখানে বেড়ে উঠছে, তাদের জন্য মধ্যবর্তী বিকল্প উপায় ভাবার চেষ্টা চলছে।’
‘আমরা একটা দ্বীপ বেছে নিয়েছি। সেখানে আমরা বাঁধ দিয়েছি। সাইক্লোন শেল্টার ও ঘরবাড়ি তৈরি করেছি। আমরা তাদের সেখানে নিয়ে যেতে চাই এবং কাজ দিতে চাই। তাহলে তরুণ ও নারীরা অর্থ উপার্জন করতে পারবে।’
‘নিজ দেশে ফেরত যাওয়াই রোহিঙ্গা সমস্যার দীর্ঘস্থায়ী সমাধান’ উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘মিয়ানমারের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখেই এই দীর্ঘস্থায়ী সমাধানে যেতে চায় বাংলাদেশ। এক্ষেত্রে ভারত ও চীনের সহযোগিতা প্রয়োজন। ইউরোপীয় ইউনিয়নও ভূমিকা রাখতে পারে।’
‘আমরা কিন্তু মিয়ানমারের সঙ্গে ঝগড়া করতে চাই না। আমাদের সঙ্গে একটা চুক্তিও হয়েছে যে, তারা ফেরত নিয়ে যাবে। চীন ও ভারতের সঙ্গেও আমরা কথা বলেছি এবং মিয়ানমারের সঙ্গে যে পাঁচটি দেশের বর্ডার আছে, চীন, বাংলাদেশ, ভারত, থাইল্যান্ড ও লাওস, আমরা সবার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেছি যে, কীভাবে এই সমস্যা সমাধানে তাদের কাজ করা উচিত।’
‘আমরা এটাই চাই যে, তারা মিয়ানমারকে এ কথাটি বুঝাক যে, এরা যখন মিয়ানমারে চলে যাবে, তখন তাদের যা যা সাহায্য দরকার, থাকার বাড়িঘর, তাদের খাওয়ার ব্যবস্থা, এখানে যা যা দিচ্ছে, তা ওখানেই দেবে এবং তাদের একটা নিরাপত্তার ব্যবস্থাও তারা করবে। জাতিসংঘ এ ব্যাপারে কিছু পদক্ষেপ নিতে পারে।’
সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ডয়চে ভেলের প্রধান সম্পাদক ইনেস পোল ও এশিয়া বিভাগের প্রধান দেবারতি গুহ।
এমএআর/পিআর